বাংলাদেশের হাওরে জলজপ্রাণীর মৃত্যুর কারণ ইউরেনিয়াম! by রিয়াজ আহমেদ ও পিনাকী রায়

প্রতিবছর আকস্মিক বন্যা বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়। এতে ফসলহানীও কৃষকদের খুব একটা ব্যাকুল করে না। কিন্তু আকস্মিক বন্যা যখন মাছ, ব্যাঙ ও জলচর পাখির মতো অসংখ্য প্রাণীর প্রাণ হরণ করে তখন অবাক না হয়ে পারা যায় না। সম্প্রতি এমন আকস্মিক বন্যার পর সিলেট অঞ্চলের হাওরগুলোতে জলপ্রাণীর ব্যাপক মৃত্যুর ঘটনা সবাইকে অবাক করার পাশাপাশি শংকিতও করে তুলেছে।
ভারতের একটি ‘ওপেন পিট’ ইউরেনিয়াম খনির সঙ্গে একটি নদীর সংযোগের কারণে সেখানে নদীর মাছ মারা যাচ্ছে বলে সীমান্তের ওপারে বেশ হৈচৈ চলছে। তাই এর সঙ্গে হাওড়ে জলজপ্রাণী মৃত্যুর সংযোগ থাকতে পারে বলে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা আশংকা প্রকাশ করেছেন। এই প্রাণী মৃত্যুর সঙ্গে যদি ইউরেনিয়ামের সত্যিই সংযোগ পাওয়া যায় তাহলে তা হবে বাংলাদেশের জলাশয় ও নদী ব্যবস্থার ওপর এটি গুরুতর আঘাত। মানুষসহ জল ও স্থল নির্বিশেষে সর্বত্র প্রাণীকুল এর শিকার হবে বলে বিশেষজ্ঞরা হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা সুনামগঞ্জের ঠিক ওপাশে ভারতে রাণীকর নদীর অববাহিকায় মূলত খাসি জনগোষ্ঠীর বাস। সম্প্রতি সেখানকার নদীনালায় মাছসহ বিভিন্ন জলজপ্রাণী ব্যাপক হারে মারা যাচ্ছে। এ নিয়ে সেখানে হৈচৈ চলছে। স্থানীয়দের ধারণা কাছাকাছি এলাকায় থাকা ইউরেনিয়াম খনি থেকে সৃষ্ট দূষণের ফলে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ইউরেনিয়াম উত্তোলনের জন্য যেসব কূপ খোঁড়া হয় সেগুলো উন্মুক্ত অবস্থায় থাকে। ফলে আশপাশের বস্তু সহজেই ইউরেনিয়াম দূষণের শিকার হতে পারে।
মার্চ মাসের শেষ দিকে প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ নিচু এলাকা তলিয়ে যায়। হাওর ও জলাভূমিগুলো প্লাবিত হয়।
এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও অন্যান্য হাওর এলাকা এমনকি আরো ভাটিতে মৌলভীবাজারের মানুষ অগনিত মাছ, ব্যাঙ এমনকি হাঁস পর্যন্ত মৃত অবস্থায় হাওরের পানিতে ভাসতে দেখে। এই মৃত্যুর পেছেনে ইউরোনিয়াম দূষণের সংযোগ থাকতে পারে এমন আশংকায় তারা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। আশংকা সত্যি হলে এশিয়ার সর্ববৃহৎ দুই হাওর হাকালুকি ও টাঙ্গুয়ার-এ জলজপ্রাণীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।
মেঘালয়ের পশ্চিম কাশি পার্বত্য এলাকার অধিবাসীরা সম্প্রতি রাণীকর নদীর পানির রং বদলে যাওয়া লক্ষ্য করেছেন। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর সীমান্তে প্রবাহিত যদুকাটা নদী থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার ভাটিতে রাণীকর নদী প্রবাহিত।
এ ব্যাপারে ঢাকায় বাংলাদেশ এটমিক এনার্জি সেন্টার’র রসায়ন বিভাগের প্রধান ড. বিলকিস আরা বেগম জানান যে কাশি পর্বত এলাকায় খনি থেকে ভারতের ইউরেনিয়াম উত্তোলনের বিষয়টি তারা অবগত। তার মতে, আমাদের হাওর এলাকায় উজান থেকে নেমে আসা পানিতে ইউরেনিয়াম মিশে যাওয়ার আশঙ্কা অত্যন্ত প্রবল। আর এমনটা ঘটলে বাংলাদেশের জন্য তা বিপর্যয় ডেকে আনবে।
তিনি আরো জানান যে নদীর পানির রং পরিবর্তনের জন্য ইউরেনিয়াম সরাসরি দায়ি না হলেও এর পরোক্ষ সংযোগ থাকতে পারে। তবে, কারণ নির্ণয়ের আগে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
মৎস্য বিভাগের একটি দল বৃহস্পতিবার (২০ এপ্রিল) হাওর এলাকা পরিদর্শন করে দেখতে পায় হাওরের পানি অত্যন্ত বিষাক্ত। এতে জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু পানি বিষাক্ত হওয়ার কারণ তারা এখনো নির্ণয় করতে পারেনি।
প্রাণীসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তারা হাওরা এলাকা থেকে মৃত হাঁস সংগ্রহ করে তা পরীক্ষার জন্য পরীক্ষাগারে পাঠিয়েছেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন সিলেট অঞ্চলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, হাওরে মাছ ও হাঁসের এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর সঙ্গে ইউরেনিয়াম দূষণের সংযোগ থাকার সম্ভাবনা খুবই বেশি। যদি উজান থেকে ইউরেনিয়াম মিশ্রিত পানি এসে আমাদের হাওরগুলো প্লাবিত করে তাহলে তার সবার জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে।
সীমান্তের ওপারে কাশি শিক্ষার্থীরা ইউরেনিয়াম খনিগুলোর কুপ খোলা রাখার প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। ওই অঞ্চলে নদীগুলো ব্যাপকহারে মাছের মৃত্যুর সঙ্গে ইউরেনিয়াম কূপগুলোর সংযোগ রয়েছে বলে তাদের সন্দেহ প্রবল।
কাশি ছাত্ররা বাংলাদেশে হাওরের পরিস্থিতি জানতে যোগাযোগ করেছে বলে করিম জানিয়েছেন।
অবশ্য মেঘালয় রাজ্য সরকার মাছের মৃত্যুর সঙ্গে ইউরেনিয়াম দূষণের সংযোগ থাকার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছে। খনিজ বিভাগের দায়িত্বে থাকা রাজ্যের উপ-মুখ্যমন্ত্রী বিন্দো এম লানং বলেন, যদি ইউরেনিয়ামের সংযোগ থাকতো তাহলে শুধু মাছ নয় অন্য জলজ প্রাণীও মারা যেতো।
সুনামগঞ্জের কৃষক সোনাই মিয়া জানান, শুধু মাছ নয়, হাওরে ব্যাঙ, জোঁকসহ আরো অনেক প্রাণী মারা গেছে।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, পানিতে তলিয়ে যাওয়া ফসল পচে গেলে তাতে জলজ প্রাণীর মৃত্যু ঘটে না। আগে কখনোই বন্যায় এমনটা হয়নি।
মৎস্য ও পশুসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তারা দেখেন হাকালুকি হাওরের পানিতে অম্লতা (এসিড) বেড়ে গেছে এবং অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
পশ্চিম কাশি পর্বতে যে খনি রয়েছে সেগুলো থেকে উন্মুক্ত কূপ পদ্ধতিতে ইউরেনিয়াম তোলা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
স্থানীয় জনগণের প্রবল প্রতিবাদের মুখে ইউরেনিয়াম কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া লি. ১৯৯২ সালে একটি পাইলট ইউরেনিয়াম খনি থেকে উত্তোলন বন্ধ করতে বাধ্য হয়।
রাণীকর নদীর পানির রং পরিবর্তনের বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে আনতে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি মেঘালয়ের কাশি স্টুডেন্ট ইউনিয়ন (কেএসইউ) এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। নদীতে হাজার হাজার মাছ মারা গেছে বলেও তারা অভিযোগ করে। বর্তমানে রাণীকর একটি মৃত নদীতে পরিণত হয়েছে। এতে মাছ ও জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব নেই বলে কেএসইউ জানায়।
সুনামগঞ্জ জেলার টাঙ্গুয়ার হাওরের পাশে তাহিরপুরের মতিয়ান হাওরে ভেসে ওঠা মরা মাছ

No comments

Powered by Blogger.