কোরীয় উপদ্বীপে যুদ্ধ কি আসন্ন?

বিশ্ব কি দ্বিতীয় আরেকটি ‘কোরীয় যুদ্ধ’ প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছে? এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন ইউএসএস মিশিগানের উপস্থিতি, জাপান সাগরে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস কার্ল ভিনসন মোতায়েন, আর গত ২৬ এপ্রিল দক্ষিণ কোরিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী THAAD (Terminal High Altitude Area Defense) মোতায়েনের পর জল্পনাকল্পনা বেড়েছে, যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ায় অভিযান পরিচালনা করতে পারে! যদিও বিষয়টি অত সহজ নয়। যে কোনো সামরিক অভিযান এ অঞ্চলে পারমাণবিক যুদ্ধের সূচনা করতে পারে। ইতিমধ্যেই উত্তর কোরিয়ার দেশরক্ষা মন্ত্রী জেনারেল পার্ক ইয়ং সিক মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ‘উসকানিতে’ এ অঞ্চলে পারমাণবিক যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে বলে হুমকি দিয়েছেন। উত্তর কোরিয়া সীমান্তবর্তী উনসান শহরে বড় ধরনের সামরিক কুচকাওয়াজের আয়োজন করেছে। সব মিলিয়ে একটা টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে এ অঞ্চলে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত বুধবার হোয়াইট হাউসে সিনেট সদস্যদের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। ফলে একদিকে উত্তর কোরিয়ার হুমকি, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সমরসজ্জা- সব মিলিয়ে একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব বিরাজ করছে কোরীয় উপদ্বীপ অঞ্চলে। ট্রাম্প তার দায়িত্ব গ্রহণের একশ’ দিনের মাথায় এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছেন। যুদ্ধ না আলোচনা কোনটি বেছে নেবেন তিনি এখন? এখানে বলা ভালো, এ অঞ্চলে আবার যদি যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, তাহলে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় দেখা দেবে।
যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়বে প্রতিটি দেশে। প্রথম কোরীয় যুদ্ধে (১৯৫০-৫৩) দক্ষিণ কোরিয়ার ১ লাখ ৭৮ হাজার ৪০৫ জন নাগরিক প্রাণ হারিয়েছিলেন। আর উত্তর কোরিয়ায় প্রাণহানির সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৬৭ হাজার ২৮৩। যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। মার্কিন নাগরিকের মৃতের সংখ্যা ছিল ৩৬ হাজার ৫৭৪। চীন ছিল উত্তর কোরিয়ার পক্ষে। চীনা নাগরিক মারা গিয়েছিল ১ লাখ ৫২ হাজার। ৬৭ বছর পর নতুন করে যদি যুদ্ধ শুরু হয়, তাতে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র ব্যবহৃত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এর ফলে মৃতের সংখ্যাও বাড়তে পারে। চীন সব পক্ষকে সংযত আচরণ করতে বলেছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে কোনো কোনো ডেমোক্রেটদলীয় কংগ্রেস সদস্যও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ‘ঠাণ্ডা মাথায়’ সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা বলেছেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ২০০৬ সালের অক্টোবরে উত্তর কোরিয়া কর্তৃক পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর থেকেই দেশটি রয়েছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়েই উত্তর কোরিয়া বিশ্বে ৮ম পারমাণবিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। এর পর থেকেই উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে এ অঞ্চলের, বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের আতঙ্ক বাড়তে থাকে। তখন থেকেই আলোচনা শুরু হয় কীভাবে উত্তর কোরিয়াকে পরমাণুমুক্ত করা সম্ভব। একপর্যায়ে চীনের উদ্যোগে ২০০৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি উত্তর কোরিয়া একটি চুক্তি স্বাক্ষরে রাজি হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী দেশটি অবিলম্বে তার ইয়ংবাইওনের (ণড়হমনুড়হ) পারমাণবিক চুল্লিটি বন্ধ করে দেয়, যেখানে পশ্চিমা বিশ্বের ধারণা উত্তর কোরিয়া ৬ থেকে ১০টি পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারত।
চুক্তির শর্ত অনুযায়ী উত্তর কোরিয়া ৬০ দিনের মধ্যে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের তার পারমাণবিক চুল্লিগুলো পরিদর্শনেরও সুযোগ করে দেয়। বিনিময়ে উত্তর কোরিয়াকে ৫০ হাজার টন জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হয়। এর পর ২০০৭ সালের অক্টোবরে দুই কোরিয়ার মধ্যে একটি শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট রোহ মু হিউম ২ অক্টোবর উত্তর কোরিয়া সফর করেন এবং সেখানে দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কিম জং ইলের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠক করেন। এটা ছিল দুই কোরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে দ্বিতীয় শীর্ষ বৈঠক। এর আগে ২০০০ সালের ১২ জুন দুই কোরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান প্রথমবারের মতো একটি শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। কোরিয়া বিভক্তকারী অসামরিক গ্রাম পানমুনজমে সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম দাই জং মিলিত হয়েছিলেন উত্তর কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম জং ইলের সঙ্গে। এটি ছিল এ অঞ্চলের গত ৫৩ বছরের রাজনীতিতে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এর আগে দুই কোরিয়ার নেতারা আর কোনো শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হননি। স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থা এবং দুই জার্মানির একত্রীকরণের (১৯৯০) পর রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি এখন কোরীয় উপদ্বীপের দিকে। সেই থেকে দুই কোরিয়ার পুনঃএকত্রীকরণের সম্ভাবনাও দেখছেন অনেকে। অনেকেরই মনে থাকার কথা, ২০০০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম দাই জংকে ‘দুই কোরিয়ার পুনঃএকত্রীকরণের অব্যাহত প্রচেষ্টার’ জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়েছিল। কোরিয়া একটি বিভক্ত সমাজ। দুই কোরিয়ায় দুই ধরনের সমাজব্যবস্থা। উত্তর কোরিয়ায় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু রয়েছে।
আর দক্ষিণ কোরিয়ায় রয়েছে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা। ১ লাখ ২০ হাজার ৫৩৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট উত্তর কোরিয়ার লোকসংখ্যা মাত্র ২ কোটি ২৫ লাখ। আর ৯৯ হাজার ২২২ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট দক্ষিণ কোরিয়ার লোকসংখ্যা ৪ কোটি ২৮ লাখ। একসময় যুক্ত কোরিয়া ছিল চীন ও জাপানের উপনিবেশ। ১৯০৪-০৫ সালে রাশিয়া ও জাপানের মধ্যে যুদ্ধের পর কোরিয়া প্রকৃতপক্ষে জাপানের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয়। ১৯১০ সালের ২৯ আগস্ট জাপান আনুষ্ঠানিকভাবে কোরিয়াকে সাম্রাজ্যভুক্ত করে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর মার্কিন ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনাবাহিনী কোরিয়ায় ঢুকে পড়ে এবং জাপানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করার জন্য কৌশলগত কারণে কোরিয়াকে দু’ভাগ করে। এক অংশে মার্কিন বাহিনী এবং অপর অংশে সোভিয়েত বাহিনী অবস্থান নেয়। সোভিয়েত বাহিনীর উপস্থিতিতেই কোরিয়ার উত্তরাঞ্চলে (আজকের যা উত্তর কোরিয়া) একটি কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৬ সালে নিউ ন্যাশনাল পার্টির সঙ্গে নবগঠিত কোরিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি একীভূত হয়ে কোরিয়ান ওয়ার্কার্স পার্টি গঠন করে। জাতিসংঘের আহ্বানে সেখানে নির্বাচনের আয়োজন করা হলেও দেখা গেল নির্বাচন শুধু দক্ষিণ কোরিয়াতেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৪৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর উত্তর কোরিয়া একটি আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে তার অস্তিত্বের কথা ঘোষণা করে। ১৯৫০ সালের ২৫ জুন উত্তর কোরিয়ার বাহিনী ৩৮তম সমান্তরাল রেখা অতিক্রম করে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রবেশ করলে যুদ্ধ বেঁধে যায়। জাতিসংঘ এ যুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়াকে সমর্থন করার জন্য সব রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানায়। জাতিসংঘ বাহিনী মাঞ্চুরিয়া সীমান্তে উপস্থিত হলে ১৯৫০ সালের ২৬ নভেম্বর চীন উত্তর কোরিয়ার পক্ষে যুদ্ধে জড়িয়ে যায় এবং চীনা সেন্যরা দক্ষিণ কোরিয়ার অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। ১৯৫১ সালের এপ্রিলে জাতিসংঘ বাহিনী ৩৮তম সমান্তরাল রেখা পুনরুদ্ধার করে। ১৯৫১ সালের ২৩ জুন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয়।
কিন্তু যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব কার্যকর হয় দু’বছর পর, ১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই। এর পর থেকে কার্যত উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া দুটি রাষ্ট্র হিসেবে তাদের অস্তিত্ব বজায় রেখে আসছে। ১৯৫৩ সালে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি বলে দক্ষিণ কোরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকলেও উত্তর কোরিয়ায় কোনো চীনা সৈন্য নেই। উত্তর কোরিয়া চীনের সঙ্গে ১৯৬১ সালে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। গত ৭০ বছরে দক্ষিণ কোরিয়ায় একাধিক সরকার গঠিত হলেও উত্তর কোরিয়ায় ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়েছে দু’বার- ১৯৯৪ সালে কিম উল সুং-এর মৃত্যুর পর তার পুত্র কিম জং ইল ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। এর পর দীর্ঘদিন তিনি অসুস্থ ছিলেন। তার মৃত্যুর পর ২০১১ সালে তার ছোট সন্তান কিম জং উনকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে নানা কারণে উন বিতর্কিত হয়েছেন। আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি তার আস্থা কম। প্রচলিত আইনকানুন তিনি মানেন না। কিছুটা খ্যাপাটে স্বভাবের মানুষ তিনি। বালকসুলভ চেহারা। ধারণা করা হয় মধ্য ত্রিশের ঘরে তার বয়স। কিন্তু প্রচণ্ড হিংস্র প্রকৃতির তিনি। নিজের সৎ ভাইকে পর্যন্ত ‘খুন’ করতে দ্বিধা করেননি। এমনকি তাকে পরিপূর্ণ সম্মান না দেয়ায় সিনিয়র জেনারেল ও দেশরক্ষা মন্ত্রীকে পর্যন্ত ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠিয়েছিলেন তিনি। সুতরাং পশ্চিমা বিশ্ব তার সঙ্গে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ প্রশ্নে আলোচনা করলে কোনো ফল পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। এমনকি দুই কোরিয়ার মধ্যে পুনঃএকত্রীকরণের আলোচনার সম্ভাবনাও ক্ষীণ।
অনেকেই বলার চেষ্টা করছেন, এটা এক ধরনের ‘প্রক্সি ওয়ার’। এই ‘প্রক্সি ওয়ারে’ একদিকে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, অন্যদিকে চীন ও রাশিয়া। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, মার্কিন যুদ্ধজাহাজ যখন কোরীয় উপদ্বীপের আশপাশে অবস্থান করছে ঠিক তখনই উত্তর কোরীয় সীমান্তে সেনা সমাবেশ করেছে রাশিয়া। লন্ডনের ডেইলি মেইল জানিয়েছে, পুতিনের আশঙ্কা যদি ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ায় হামলা চালান, তাহলে দেশটির নাগরিকদের একটা বিশাল অংশ শরণার্থী হয়ে রাশিয়ায় ঢুকে পড়তে পারে। এর আগে চীন তার উত্তর কোরীয় সীমান্তে ১ লাখ ৫০ হাজার সৈন্য মোতায়েন করেছিল। এর অর্থ হচ্ছে, শরণার্থী ঠেকাতে চীন ও রাশিয়া তাদের নিজ নিজ সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করলেও পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটি একটি ‘হুমকি’; অর্থাৎ যুদ্ধ যদি শুরু হয়, তাহলে তারা উত্তর কোরিয়ার পক্ষেই দাঁড়াবে। ইতিমধ্যে উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার সমালোচনা করে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যে নিন্দা প্রস্তাব এনেছিল, রাশিয়া তাতে ভেটো দিয়েছে। বলা ভালো, এ ব্যাপারে জাতিসংঘের সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই উত্তর কোরিয়া ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে। কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের সিউল সফরের পরও দক্ষিণ কোরিয়ার নিরাপত্তা সংকট কাটেনি। এদিকে একদল মার্কিন মনোবিজ্ঞানী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ‘মানসিক রোগী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বস্তুত একজন ব্যক্তি (ডোনাল্ড ট্রাম্প) যখন গত ১২ এপ্রিল মার্কিন সংবাদপত্র ওয়াল স্ট্রিটের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সমগ্র কোরিয়াকে চীনের অংশ হিসেবে চিহ্নিত করেন, তখন ইতিহাস সম্পর্কে তার অজ্ঞতার চেয়ে তার মানসিক সুস্থতার বিষয়টিই বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয়। উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উনও অনেকটা একই মানসিকতার মানুষ। ফলে তাদের দু’জনের কারণে কোরীয় উপদ্বীপে যে কোনো সময় ‘যুদ্ধ’ শুরু হয়ে যেতে পারে! ভয়টা হচ্ছে, ক্ষ্যাপাটে স্বভাবের উন কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করেই দক্ষিণ কোরিয়ায় পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করতে পারেন। চীন উত্তর কোরিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র হলেও চীনের সংযত আচরণের আহ্বান কিম জং উন কতটা শুনবেন, সেটিও একটা প্রশ্ন। অতীতে উত্তর কোরিয়া যুক্তি দেখিয়েছিল, তাদের পারমাণবিক প্রযুক্তির উদ্দেশ্য হচ্ছে অভ্যন্তরীণভাবে জ্বালানির চাহিদা মেটানো। সেক্ষেত্রে পশ্চিম বিশ্ব উত্তর কোরিয়াকে অতিরিক্ত জ্বালানি সরবরাহ করেছিল। খাদ্যশস্য সরবরাহ করেছিল। এরপর উত্তর কোরিয়া তাদের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো পশ্চিমা বিশেষজ্ঞদের জন্য খুলে দিয়েছিল। এখন তেমনই একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে হয়তো।
পশ্চিমা বিশ্ব যদি আবার খাদ্য ও জ্বালানি সরবরাহের আশ্বাস দেয়, আমার ধারণা, সেক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়া তার পারমাণবিক কর্মসূচি ‘আপাতত’ পরিত্যাগ করতে পারে! কিন্তু এটা কোনো সমাধান নয়। এমনিতেই উত্তর কোরিয়া রাষ্ট্রটির বহির্বিশ্বে তেমন কোনো মর্যাদা নেই (বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের টাকা হ্যাকিংয়ে উত্তর কোরিয়ার নাম এসেছে)। রাষ্ট্রটিকে Sopranos State হিসেবে উল্লেখ করা হয় (দেখুন, Sheena Chestnut, International Security, 23 July 2007)। উল্লেখ্য, যে রাষ্ট্র ও শাসকবর্গ ক্রিমিনাল তৎপরতার সঙ্গে জড়িত, তাদের Sopranos State হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এর অর্থ হচ্ছে, উত্তর কোরিয়া একটি মর্যাদাহীন রাষ্ট্র। তাকে যদি আরও ‘চাপের’ মধ্যে রাখা হয়, তাহলে দেশটি আরও অপতৎপরতার সঙ্গে জড়িয়ে যাবে। এখন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ায় THAAD মোতায়েন করেছে (একটি ‘থাড’ ব্যাটারি স্থাপনের ব্যয় ১ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার)। সঙ্গত কারণেই উত্তর কোরিয়া তার পারমাণবিক কর্মসূচির ব্যাপ্তি বাড়াবে। ফলে আপাতত যদি উত্তেজনা হ্রাসও পায়, এক ধরনের আস্থাহীনতার সংকট থেকে যাবে। তাই উত্তর কোরিয়াকে চাপে না রেখে বরং আলোচনার মাধ্যমেই এ সমস্যার সমাধান করা মঙ্গলজনক। একইসঙ্গে মার্কিন সাবমেরিন ইউএসএস মিশিগান ও বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ কার্ল ভিনসনকে যদি প্রত্যাহার করে না নেয়া হয়, তাহলেও আস্থা ফিরে আসবে না। যুদ্ধ যে কোনো সমাধান নয়, এ উপলব্ধিটুকু যদি উত্তর কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতাদের মধ্যে থাকে, তাহলে তা সবার জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahamanbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.