প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশের বিনাশ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ

মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক আদালত বসে ওলন্দাজদের দেশ নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে। এ আন্তর্জাতিক আদালত সম্পর্কে সম্ভবত আমরা কিছুটা শুনেছি এবং জানি। যে আন্তঃরাষ্ট্রীয় চুক্তির ভিত্তিতে এ আদালতটি গঠিত হয়েছে তা ‘রোম চুক্তি’ (Rome Statute of the International Criminal Court) নামে পরিচিত। ইতালির রোমের একটি সভায় ১৯৯৮ সালে অনেক রাষ্ট্র মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেসব অপরাধ নানা কারণে জাতীয় বা দেশীয় আদালত উপেক্ষা করে অথচ ন্যায়বিচার, মানবতার প্রতিষ্ঠা কিংবা মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করার জন্য জরুরি, তাদের বিচারের জন্য জাতীয় বা দেশীয় আদালতের ওপর নির্ভর করা ঠিক নয়। যেসব অপরাধের বিচার অবশ্যই হওয়া দরকার সেসব যেন উপেক্ষিত না হয় তার জন্য আন্তর্জাতিক জবাবদিহিতার একটি প্রতিষ্ঠান থাকা দরকার। এ উপলব্ধি ও তাগিদ থেকেই ‘রোম চুক্তি’ সম্পন্ন হয় এবং রোম চুক্তির ভিত্তিতে ২০০২ সালের ১ জুলাই থেকে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট কার্যকর হতে শুরু করে। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বিচারের আদালত এখন নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে সক্রিয়। আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্ট (ICC) মানবতার বিরুদ্ধে চারটা বিশেষ অপরাধকে শনাক্ত করেছে : গণহত্যা (genocide), মানবতার বিরুদ্ধের অপরাধ (crimes against humanity), যুদ্ধাপরাধ (war crimes) এবং আগ্রাসন (crime of aggression)। আন্তর্জাতিক আইনে এ অপরাধগুলোর সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা আছে। মানে এ অপরাধগুলো আর দশটা অপরাধের মতো নয়। এগুলো গুরুতর অপরাধ। এ অপরাধের বিচার না হলে সভ্যতারও কোনো ভিত্তি থাকে না। সম্প্রতি এ চার ধরনের অপরাধ ছাড়াও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাদের একটি ঘোষিত নীতিনির্ধারক সিদ্ধান্তে জানিয়েছে যে তারা আরও কিছু বিশেষ অপরাধকে বিচারের অধীন গণ্য করার বিষয়টি বিবেচনায় নেবে। সেসব হল, পরিবেশবিধ্বংসী কার্যকলাপ, প্রাকৃতিক সম্পদের অবৈধ বা অনৈতিক ব্যবহার বা অপচয় এবং ভূমিদস্যুতা বা ভূমি দখলগিরি, বিশেষত যখন শক্তিশালী পুঁজি গরিব দেশের বিশাল এলাকা কিনে জনগণকে জমিহারা সর্বহারায় রূপান্তরিত করে (land grabbing)। আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্টের এ নতুন নীতি-নির্দেশনা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
এর মানে হচ্ছে প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশবিধ্বংসী কার্যকলাপ আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্ট মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে বিবেচনার জন্য অভিযোগ হিসেবে গ্রহণ করবে। রাষ্ট্র যদি নাগরিকদের অভিযোগ আমলে নিতে অস্বীকার করে এবং দেশের বিচারব্যবস্থা যদি মানবতার বিরুদ্ধে এ অপরাধগুলোকে আমলে না নেয়- তাহলে আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্টে নাগরিকদের অভিযোগ তোলার সুযোগ থাকবে, আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্ট এ অপরাধগুলোকে আমলে নিতে পারেন বা আমলে নেয়া যায় কিনা সেটা বিবেচনা করবেন- এ নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গত বছরের (২০১৬) একটি দলিলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর ফল কী দাঁড়াবে সেটা এখনই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না; কিন্তু এটা পরিষ্কার, প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ বিনাশী কার্যকলাপ, প্রাকৃতিক সম্পদের অবৈধ বা অনৈতিক ব্যবহার বা অপচয় এবং ভূমির অন্যায় দখলদারি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে ক্রমশ মানবতার বিরুদ্ধে চরম অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করছে। মূলত আধুনিক রাষ্ট্র এবং বহুজাতিক কোম্পানি উভয়েই এ ক্ষেত্রে আসামি বা ক্রিমিনাল হিসেবে চিহ্নিত। এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে পরিবেশবাদীদের লড়াই এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত করছে বলে মানবাধিকার কর্মীরা যে আইনি লড়াই চালাচ্ছেন, তা সমান্তরালে এসে দাঁড়াচ্ছে। এখানেই আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্টের সাম্প্রতিক নীতিনির্দেশনামূলক ঘোষণার তাৎপর্য।
দুই মানবাধিকার আন্দোলনের স্ববিরোধিতা হচ্ছে এই যে, যেখানে খোদ রাষ্ট্রই মানবাধিকার লংঘনকারী কিংবা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করে নিজেই আসামি সেখানে জাতিসংঘ বা রাষ্ট্রগুলোর চুক্তি, সনদ বা ঘোষণার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আন্তর্জাতিক আইন ও প্রতিষ্ঠান দিয়ে রাষ্ট্রের অপরাধ বিচার করা কীভাবে সম্ভব? সে চেষ্টা অসম্ভবই বটে। রাষ্ট্র যদি গুম করে, গুম-খুন করে, পুলিশি হেফাজতে পিটিয়ে হত্যা করে, সভা-সমাবেশ-কথা বলার অধিকার হরণ করে- তাহলে জনগণের কাছে রাষ্ট্রের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার উপায় কী? এ ক্ষেত্রে জবাব হল, মানবাধিকার আন্দোলন যে ব্যক্তি অধিকার রক্ষার জন্য লড়াই করে, আধুনিক রাষ্ট্রও সেই ব্যক্তি অধিকার সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েই গড়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের এ দায় বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে মানবাধিকার আন্দোলন হিংস্র রাষ্ট্রের আচরণে কিছুটা সংস্কার আনতে পারে বটে; কিন্তু এ আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, আইন ও বল প্রয়োগের সংঘবদ্ধ প্রতিষ্ঠান- আধুনিক রাষ্ট্র-মানবিক অধিকার ও মানবিক মর্যাদা সুরক্ষার জন্য যে আদর্শ প্রতিষ্ঠান, মূলত সেটাই প্রমাণ করা। যাতে আধুনিক কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রগুলো এবং তাদের সংঘশক্তির (জাতিসংঘ) বাইরে মানবিক নীতি-নৈতিকতা ও অপর ব্যক্তির প্রতি একজন স্বাধীন ব্যক্তির দায়িত্ববোধ ও সংবেদনা চর্চার মধ্য দিয়ে নতুন ধরনের আন্তর্জাতিক চৈতন্যসম্পন্ন মানুষের উদ্ভবের শর্ত তৈরি করা যায়। মানবাধিকার আন্দোলনের উদ্দেশ্য রাষ্ট্রের কাছ থেকে সুবিচার আশা করা নয় বরং তথাকথিত জাতিরাষ্ট্রের ইতিহাস অতিক্রম করে জনগণের আন্তর্জাতিক সমাজ তৈরির তাগিদ ও সম্ভাবনা তৈরি করা। যাতে ব্যক্তি ও সমষ্টির স্বার্থের মধ্যে সমন্বয় ঘটানোর নৈতিক ও রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা তীব্রতর করা যায়। উল্লেখ করা যায়, ‘দুনিয়ার মজদুর এক’ হওয়ার মধ্য দিয়ে জাতিরাষ্ট্র অতিক্রম করে যাওয়ার আন্তর্জাতিক সাধনা নতুন কিছু নয়। বলাবাহুল্য, সেটা আন্তর্জাতিক পুঁজির বিনাশের মধ্য দিয়েই কেবল গড়ে উঠতে পারে।
বহুপাক্ষিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান যেমন বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পুঁজি একদিকে, আর অন্যদিকে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে নানান দ্বিপাক্ষিক চুক্তি, উভয়ের ডামাডোলে আধুনিক রাষ্ট্রের তথাকথিত ‘সার্বভৌমত্ব’ নামক ব্যাপার তুমুল তামাশায় পরিণত হয়েছে বটে; কিন্তু সমান্তরালে আন্তর্জাতিক পুঁজি আধুনিক রাষ্ট্রকে দেশে দেশে তার পুঞ্জীভবন ও আত্মস্ফীতির হাতিয়ারে খুবই সফলভাবেই রূপান্তরিত করতে পেরেছে। আশির দশক থেকে কাছাখোলা অবাধ বাজারব্যবস্থা এবং লগ্নি পুঁজির অবিশ্বাস্য উত্থানের মধ্য দিয়ে আধুনিক রাষ্ট্রের যে রূপান্তর ঘটেছে, তার দ্বারা আমরা অনায়াসেই সেটা এখন বুঝতে পারি। পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক শুরুতে সাধারণ রূপ পরিগ্রহণের কাল পর্বে কমিউনিস্ট বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলন আশা করেছিল, শ্রমিক আন্দোলন জাতিবাদ ও আধুনিক রাষ্ট্রের সীমানা অতিক্রম করে যেতে মতাদর্শিক ও সাংগঠনিকভাবে সক্ষম হবে। সেটা ঘটেনি। শ্রমিক আন্দোলন ও সমাজতন্ত্র মার্কস-এঙ্গেলসের নিজেদের দেশে উগ্র জাতিবাদ ও ফ্যাসিবাদের জন্ম দিয়েছে। সোভিয়েত বা চীনা বিপ্লবের পরিণতি ঘটেছে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষার কর্তব্যে। কার্ল মার্কস জার্মান ভাবাদর্শে অবশ্য স্পষ্টই ঘোষণা করেছিলেন, দুনিয়াব্যাপী পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ববাজার বা বিশ্বব্যবস্থার পতন না ঘটলে কমিউনিজম অর্থাৎ আন্তর্জাতিকতা অসম্ভব। জাতিবাদের যুগ পার হয়ে যাওয়া সহজ কাজ নয়। তার দাবি ছিল, এটা শুধু শ্রমিক আন্দোলন দিয়ে হবে না (বা বলা যায় এটা একা কমিউনিস্টদের কাজ নয়), ইতিহাসকেও মানুষের ইচ্ছা-নিরপেক্ষ কিছু কারবার ঘটাতে হবে। বাজার যেমন ‘বৈশ্বিক’ রূপ নিয়ে বিশ্ববাজারে পরিণত হচ্ছে, সেই বিশ্ববাজারেই নতুন বিশ্বমানবের আবির্ভাব ঘটবে। এটা ঘটতে হবে কমিউনিস্ট নৈতিকতা কিংবা ইসলামী ইমানের জোরে নয়, বিশ্ব বাস্তবতাই বিশ্বমানবের আবির্ভাবের শর্ত তৈরি করবে। তার আগে সমাজতন্ত্র কায়েমের চেষ্টা যে হবে না তা নয়। হবে। কিন্তু সেটা পুঁজির আত্মস্ফীতি ও পুঞ্জীভবনের তোড়ে টিকবে না। প্রশ্ন তোলা যায়, একইভাবে ইসলামের ঝাণ্ডা নিয়ে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে মানুষ কি লড়বে না? অবশ্যই লড়বে। সে লড়াই ঠিক নাকি বেঠিক সেটা ফালতু তর্ক। এ লড়াই অনিবার্য, কারণ বাস্তবতাই এ লড়াইয়ের চরিত্র নির্ণয় করে দেবে। পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের সেই পর্বটা আমরা এখন পার করছি। দার্শনিক প্রজ্ঞা মানুষকে কী অসাধারণ দূরদৃষ্টি দিতে পারে কার্ল মার্কস তার দুর্দান্ত উদাহরণ। পুঁজি ‘বিশ্ব-ঐতিহাসিক’ স্রেফ এ ধারণার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠন কিংবা চীনা বিপ্লবের বহু আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, কমিউনিস্টরা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বানানোর চেষ্টা করবে বটে, আর সেই চেষ্টা ঐতিহাসিকভাবে অনিবার্য- সেটাও ঠিক- কিন্তু তাদের সে চেষ্টা টিকবে না। তাদের চেষ্টা পুঁজি নিজের স্বভাবের কারণেই ভণ্ডুল করে দেবে। ইসলামপন্থীরাও ইসলামী রাষ্ট্রের নামে আরেকটি আধুনিক রাষ্ট্র বানানোর চেষ্টা করবে; কিন্তু চীনাদের মতো সেটাও আধুনিক পুঁজিতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অধিক কিছু হবে না। সব ইহলৌকিক স্বার্থ ত্যাগ করা সম্মানিত আয়াতুল্লাহরা পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার পতন ঘটাতে না পারলে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পারবেন কিনা সন্দেহ।
এ পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের সাফল্য ও সম্ভাবনার সীমার বিচার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সন্দেহ নাই। মার্কসের কথা থেকে বোঝা যায়, পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন ও বিশ্ববাজারের আবির্ভাব যে অনিবার্য এটা পদ্ধতিগতভাবেই তিনি বুঝেছিলেন। অর্থশাস্ত্রের পর্যালোচনা করতে গিয়েই তিনি ইতিহাসের এ পরিণতি সম্পর্কে আগাম নিশ্চিত হয়েছিলেন। এখানেই তার অসামান্য প্রতিভা। তবে দাবি করেছেন, বিশ্ববাজারের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে মানুষও নিজেকে জাতিবাদী অহমিকা ও স্থানীয় কূপমণ্ডূকতা- অর্থাৎ নিজ নিজ গর্তে কুয়ার ব্যাঙ হয়ে না থেকে নিজেকে বৈশ্বিক বা আন্তর্জাতিকভাবে ভাবতে সক্ষম হতে পারে। বাস্তবতাই সেই শর্ত তৈরি করবে। তার এ সিদ্ধান্ত বর্তমান বাস্তবের সঙ্গে মেলে কিনা আমরা তা নিয়ে তর্ক করতে পারি; কিন্তু এটা পরিষ্কার, আন্তর্জাতিকতার বিপরীতে তিনি স্থূল জাতিবাদ বা স্থানীয় কূপমণ্ডূকতার চরম বিরোধী ছিলেন। কার্ল মার্কসকে ঠিক এ কারণেই এখনও মানবেতিহাসের সাম্প্রতিক টানাপোড়েনের মধ্যেও চিন্তার জগৎ নির্ণয় করার গৌরব থেকে এক ইঞ্চিও টলানো যাচ্ছে না। তিনি আগের মতোই যথারীতি দাড়িভর্তি দরবেশ; আমাদের প্রতি করুণামিশ্রিত দৃষ্টি নিয়েই তাকিয়ে আছেন। সেখানে কৌতুক ও প্রগলভতা দুটোই বিদ্যমান। মানবাধিকার আন্দোলনকে যদি পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ববাজারের যুগে আন্তর্জাতিক মানুষের আবির্ভাব নিশ্চিত করার জন্য নতুন নীতি-নৈতিকতা কায়েমের লড়াই হিসেবে দেখি, তখন এর আন্তর্জাতিক তাৎপর্য অনেক পরিচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্ট সংকীর্ণ মানবাধিকারের ক্ষেত্রকে এখন যখন আরও প্রসারিত করার নীতি গ্রহণ করছে তখন বোঝা যাচ্ছে, শুধু ব্যক্তির অধিকার নয়, মানবাধিকার একইসঙ্গে বহুজাতিক কোম্পানি বা আন্তর্জাতিক পুঁজির বিরুদ্ধে সমষ্টির অধিকার নিয়েও ভাবছে। এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
তিন এ পরিপ্রেক্ষিতে বহুজাতিক কোম্পানি মনসান্তোর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের শুনানির জন্য ২০১৬ সালে যে একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছিল তার তাৎপর্য আমরা বুঝতে পারব। সেই ট্রাইব্যুনালে মনসান্তোর অপরাধের সাক্ষী হিসেবে বাংলাদেশও উপস্থিত ছিল। ২০১৬ সালের ১৪ থেকে ১৬ তারিখের মধ্যে পাশাপাশি আরেকটি জনসভারও (People's Assembly) উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। ট্রাইব্যুনালের পাশাপাশি একই সময়ে ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও এশিয়ার প্রতিনিধিরা Peoples' Assembly তে অংশগ্রহণ করেন। এ সমাবেশে বীজের ওপর দখলদারি প্রতিহত করে বীজের স্বাধীনতার (Seed Freedom) দাবি উঠে আসে জোরালোভাবে। বীজের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় আগামীতে তাদের কাজ কী হবে তার পরিকল্পনাও করে নেয় (যারা আরও জানতে চান তারা ubinig.org ওয়েব পাতায় ‘মনসান্তো ট্রাইব্যুনাল : গণআদালতে প্রাণ ও প্রকৃতি হত্যাকারীর বিচার’ নিবন্ধটি পড়ে দেখতে পারেন)। মনসান্তো বিশ্বব্যাপী পরিবেশ, প্রকৃতি ও প্রাণের যে ক্ষতি সাধন করেছে তার দুটো দিক আছে : এক. ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’- মনসান্তোর কর্মকাণ্ডে মানুষের প্রাণের ক্ষতি হবে জেনেও কোম্পানি নিজ স্বার্থে সেই ক্ষতি করে যাচ্ছে। দুই. ইকোসাইড (Ecocide) বা প্রাণের ব্যবস্থাপনার বিনাশ, যে অর্থে ‘জেনোসাইড’ বা গণহত্যা কথাটা আমরা বুঝি ঠিক সেভাবেই প্রাণ ও প্রকৃতি হত্যাকে বুঝতে হবে। মানুষ হত্যা যে মাত্রায় অপরাধ, তার চেয়ে শতগুণ বড় অপরাধ হচ্ছে ইকোসাইড বা প্রাণের বিনাশ। কারণ এ ক্ষেত্রে শুধু মানুষ নয়, যা টিকে না থাকলে কোনো প্রাণই বাঁচতে পারে না সেই জগৎটাকেই ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। বলাবাহুল্য, এ দুই ভয়ানক অপরাধের বিচার হওয়া উচিত। তারই নৈতিক ও রাজনৈতিক যৌক্তিকতা তুলে ধরার জন্য মনসান্তোর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল বা ‘আন্তর্জাতিক গণআদালত’ গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল। একালে মানুষসহ সব প্রাণের চরম হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে গুটিকয়েক বহুজাতিক কর্পোরেশন। তাদের বিষ, রাসায়নিক দ্রব্য ও নানান ক্ষতিকর পণ্য উৎপাদন এবং এর ব্যবহার প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংস করছে। প্রকৃতি ও পরিবেশ তারা বিষাক্ত করে তুলছে। প্রাণ আজ সর্বত্রই বিপন্ন। আগে তাদের প্রধান ব্যবসা ছিল ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ এবং বিশেষভাবে কীটনাশক বা বিষ বিক্রি। এখন তারা বীজের ব্যবসা ও কৃষিতে ঢুকেছে। সারা দুনিয়ার খাদ্যব্যবস্থা তারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার জন্য উন্মাদ হয়ে উঠেছে। মানুষ না খেয়ে বাঁচতে পারবে না। খাদ্যব্যবস্থা- অর্থাৎ উৎপাদন থেকে শুরু করে বিপণন ও ভোগের প্রতিটি চক্রের ওপর তারা তাদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে চাইছে। তাদের বিপণনব্যবস্থা আগ্রাসী। শক্তিশালী রাষ্ট্র, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে দুর্বল দেশে তারা ক্ষতিকর বিষ, রাসায়নিক পদার্থ এবং পরিবেশ ও প্রকৃতির জন্য ক্ষতিকর নানান পণ্য ও টেকনোলজি চাপিয়ে দিচ্ছে। বিশ্বব্যাপী এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছে।
ইরাক যুদ্ধের পর মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি ইরাকের কৃষি এবং বিশেষ করে বীজের ওপর দখল প্রতিষ্ঠা করেছে। এদের সাম্প্রতিক তৎপরতা হল জেনেটিক কারিগরি দ্বারা ফসলের প্রকৃতির মধ্যে বিকৃতি ঘটিয়ে ‘জিএমও’ বা বিকৃত বীজ বাজারজাতকরণ। জিএমও প্রাণ ও প্রকৃতির জন্য ধ্বংসাত্মক বিপদ হয়ে দেখা দিয়েছে। খোদ কৃষির জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। জিএমও বা বিকৃত বীজের বিপদ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক মহল সতর্ক, প্রাণের জেনেটিক পর্যায়ে বিকৃতির সম্ভাব্য বিপদ আছে বলেই এর জন্য অতিরিক্ত সতর্কতার কথা আধুনিক বিজ্ঞান বলে থাকে। কিন্তু বহুজাতিক কোম্পানি তা মানতে চায় না। বিকৃত বীজ প্রবর্তনের আন্তর্জাতিক বিধি-বিধান ও বৈজ্ঞানিক সতর্কতা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বাংলাদেশে বিকৃত বেগুনের (বিটি বেগুন) চাষ করা হয়েছে। বিকৃত বেগুন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিদারুণ ব্যর্থ হওয়ার পরও কৃষক ও পরিবেশবাদীদের তীব্র প্রতিবাদের মুখে তা জোর করে কৃষকের ওপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। বহুজাতিক কোম্পানির এ ধরনের চরম অনৈতিক ভূমিকার কারণে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ দীর্ঘদিনের। প্রাণের সুরক্ষার লড়াই এখন গুটিকয়েক বহুজাতিক কোম্পানির বিরুদ্ধে জনগণের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে রূপ নিচ্ছে। ক্রমে ক্রমে তা বৈশ্বিক রূপ পরিগ্রহণ করছে। দেখা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক সচেতনতা ও নতুন রাজনৈতিক কর্তার উদ্ভবের প্রশ্ন বহুজাতিক কোম্পানির মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার চাইবার দাবির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে মানবাধিকার আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক করে তোলার এ ক্ষেত্রটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতটুকু বোঝা গেলে আমরা অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারব। ২৮ এপ্রিল ২০১৭/ ১৫ বৈশাখ, ২০১৭, রিদয়পুর

No comments

Powered by Blogger.