কৃষকের স্বপ্নের সমাধি : শনির হাওরের পর বাঁধ ভেঙ্গে পাকনা হাওরও প্লাবিত

শনির হাওরের পর জামালগঞ্জের পাকনা হাওরও প্লাবিত হয়েছে। এই হাওর প্লাবিত হওয়ার মধ্য দিয়ে সুনামগঞ্জের কৃষকের সকল স্বপ্নের সমাধি হলো।  সুনামগঞ্জে জামালগঞ্জ উপজেলার সর্ববৃহৎ বোরো ফসলের ভান্ডার বলে খ্যাত ফেনারবাঁক ইউনিয়নের পাকনা হাওরের উরার বন্দ বাঁধ ভেঙ্গে হাওরের প্রবেশ করছে পানি। আর কয়েক দিন পরই কৃষকের ঘরে ঘরে উঠতো সোনালী ফসল। পাহাড়ি ঢল ভারি বৃষ্টি পাউবোর বাঁধ ভেঙ্গে তলিয়ে গেছে হাওরের কাঁচা ধান। সব কিছু হারিয়ে নি:স্ব হয়ে পড়েছে হাওরের কৃষকরা। হাওরের গ্রামে গ্রামে এথন চলছে হাহাকার আর অর্তনাদ। পাকনা হাওরে আবাদ কৃত বোরো ছিল ৯৪৫৫ হেক্টর (২৩,৩৫৫ একর)। ওই হাওরে পানি প্রবেশ করায় পাকনা সংলগ্ন জামালগঞ্জ সদও ইউনিয়ন ও ভীম খালী ইউনিয়নসহ প্রায় ১৭ হাজার হেক্টর বোরো জমি পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। জামালগঞ্জ উপজেলা সর্ববৃহৎ ফসলী এলাকা বোরো ধানের ভান্ডা বলে খ্যাত পাকনা হাওরের উরার বন্দ বাঁধ, ডাইল্লা স্লুইচ গেট ও কাউয়াবাদা বাঁধে কয়েক দিন ধরে এলাকার কৃষকদের স্বেচ্ছাশ্রমে অক্লান্ত পরিশ্রমেও শেষ রক্ষা হয়নি। সোমবার ভোর সাড়ে ৫ টায় উরার বন্দ বাঁধ ভেঙ্গে তলিয়ে যাচ্ছে হাওরের ফসল। কয়েক দিনের ভাতি বৃষ্টির কারণে পাকনা হাওরের কাউয়ারবাদা বাঁধ থেকে ঢাইল্যা স্লুইচ গেইট ও কাইল্যানী বাঁধ পর্যন্ত ২ কিলোমিটার জায়গা মরন ফাঁদে পরিণত হয়েছিল। এলাকার হাজার হাজার কৃষক স্বেচ্ছা শ্রমে ওই বাঁধে দিন রাত কাজ করেও কোন কুর কিনারা পাননি।
হাওরের কৃষক-কৃষানীদের কান্নয় ভারি হয়ে উঠেছে আকাশ-বাতাস। পাকনা হাওরের বাঁধভাঙ্গার খবরে উপজেলাবাসীর মাঝে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। ফেনারবাঁক ইউপি সচিব অজিত কুমার রায় বলেন, বেশ কিছু দিন ধরে উপজেলা প্রশাসনের সহযোগীতায় পাকনা হাওরের উরার বন্দ বাধ টিকানোর জন্য এলাকার হাজার হাজার কৃষক ভাইদের নিয়ে হাওরে কাজ করছি। গত রাতেও বাঁধে পাহারা দিয়েছি, কিন্ত শেষ রক্ষা হয়নি আজ ভোর সাড়ে ৫ টায় উরার বন্দ বাঁধটিভেঙ্গে পাকনা হাওরে পানি প্রবেশ করছে। গজারিয়ার গ্রামের কৃষক প্রবেল মিয়া বলেন, বাঁধে স্বেচ্ছা শ্রমে কাজ করে ফসল রক্ষা করতে না পারাটা মনে থাকবে সারা জীবন। পাকনা হাওরের বাসিন্দা কৃষক হরমুজ আলী চোখের জল ছেড়ে আক্ষেপ করে বলেন “চোখের সামনে কাঁচা ধান ফানির নীছে গেছে। গেলবার বার হিলে (শীলাবৃষ্টি) মারছে আর অহন মেঘের লাইগ্যা বাঁধ (বেড়ি বাঁধ) ভাইংগা সব জমি পানির নীছে। দেনা কইরা কৃষিজমি করছিলাম, দেনাই দিমু কেমনে আর বউ-বাচ্চা নিয়া কেমনে বাঁচমু এই চিন্তায় আছি। ৫০ বয়সের কিষাণী জুলেখা বেগম বলেন, বান ভাইঙ্গা (বাঁধ) আমরার আওর ফানিতে সাদা অইয়া গেছে কি খাইয়া বাঁচমুগো কি খাইয়া বাঁচমু। মাঝারী কৃষক (গৃহস্ত) ফেনারবাঁক গ্রামের তোফায়েল আলম ছানা বলেন, দেনা কইরা জমি করছিলাম, ধান তো পাকে নাই, কিছু ধান পানির ভয়ে কাটছি আধা পাকা কিয়ারে ৪ মণের মতো হবে কাজের লোকের বেতন দিমু কেমনে আমরাই কি খাইমু। আমরা তো আর লাইনেও দাঁড়াতে পারিনা সইতেও পারিনা কইতেও পারিনা আমাদের কি হবে। সব ক্ষেত ফানির নীছে চইলা গেছে। আর ধান হওয়ার আশা নাই। কৃষক রহিম মিয়া বলেন, আমরার ভাগ্য নিয়া পাইবোর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, ঠিকাদার আর পিাাইসি কমিটির লোক জন ছিনিমিনি খেলছে। হেরা আমরার পেটে লাথি দিছে আল্লায় যেন এরার বিচার করে। চৈত্রের শেষ দিকে অতিবর্ষণে প্রথম দফায় পানিতে তলিয়ে গেছে হাজার-হাজার হেক্টর বোরো জমি। াাংশিক জমি ভাসমান থালেও এবার বাঁধ ভাঙ্গার কারনে এগুলোও পানির নীচে তলিয়ে যাচ্ছে। বছরের একটি মাত্র বোরো ফসল বৈশাখে কাটা ও মাড়াই শুরু হয় এই অঞ্চলে।
এবার হাওরের ফসল ডুবে কৃষকদের স্বপ্ন ও মেরুদন্ড ভেঙ্গে গেছে। হাজার হাজার কৃষকের কান্নায় হাওর এলাকার আকাশ এখন ভারি হয়ে উঠেছে। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী চলতি বোরো মওসুমে উপজেলার ১৩ টি হাওরে বোরো ফসল আবাদ হয়েছিল প্রায় ২০ হাজার হেক্টর (৪৮ হাজার ৩৪৫ একর) জমিতে। কিন্তু কৃষকদের বেসরকারী হিসেব মতে আমন ছাড়াই বোরো জমি প্রায় ২৮ হাজার হেক্টর চাষ হয়েছে। এরম মধ্যে উপজেলার সর্ববৃহৎ ফসলী এলাকা ফেনারবাঁক ইউনিয়নের পাকনা হাওরের ৯৪৫৫ হেক্টর (২৩,৩৫৫ একর), হালির হাওরে ৫৪৯০ হেক্টর (১৩৫৭৫ একর), শনির হাওর আংশিক ৬৪০ হেক্টর (১৫৮০ একর), মহালিয়া হাওরে ২৫০ হেক্টর (৬২০ একর), চাঁদরা হাওর ৮০ হেক্টর (১১৫ একর), ধয়লার হাওর ১৫০ হেক্টর (৩৭০ একর), গজারিয়ার হাওর ৮১৫ হেক্টর (২০১৫ একর), দিরাই চাতল হাওর ৪ হেক্টর (৯৮৮ একর), সনোয়ার হাওর ২৩০ হেক্টর (৫৭০ একর), রৌয়ার হাওর ৪০০ হেক্টর (৯৮৮ একর), ডাকুয়ার হাওর ৫০০ হেক্টও (১২৩৫ একর), জোয়ার ভাঙ্গার হাওর ৩৪৫ হেক্টর (৮৫৫ একর), ঘনিয়ার হাওর ৪০০ হেক্টর (৯৮৮একর) জমিতে বোরো ধান চাষাবাদ হয়েছিল। জামালগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রসূন কুমার চক্রবর্তী বলেন, পাকনা হাওরের বাঁধ রক্ষায় আমি কয়েকবার সরেজমিন পরিদর্শন করেছি। এলাকার কৃষকদের সেচ্ছায় শ্রম দেখে আমার বিশ্বস ছিল বাঁধ ভাংগবেনা, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সকল প্রকার প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদী প্রেরণ করেও শেষ রক্ষা হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.