হঠাৎ বেড়ে গেছে শিশু ধর্ষণের ঘটনা

সামাজিক অস্থিরতা, অপসংস্কৃতি, আকাশ সংস্কৃতি, অশ্লীলতা, ঘুষ, দুর্নীতিসহ নানা কারণে দিনে দিনে সামাজিক অবক্ষয় চরম আকার ধারণ করেছে। পাশাপাশি অশ্লীলতার আগ্রাসনে মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের অভাব ও সামাজিক অবক্ষয়ে ধর্ষণের ঘটনা আশংকাজনক হারে বাড়ছে। ধর্ষণের শিকার যারা, তাদের অধিকাংশই শিশু। স্কুল, কোচিং এমনকি নিজ বাড়িতেও নিরাপদ নয় শিশুরা। বিশ্লেষকরা বলছেন, ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে চরম নৈতিক অবক্ষয়, আকাশ সংস্কৃতি, মাদকের বিস্তার, বিচার প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী শুধু মার্চ মাসেই ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৫ জনের অধিক শিশু।
বাড়ছে শিশু ধর্ষণের ঘটনা
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০১২ সালে ৮৬ জন, ২০১৩ সালে ১৭৯ জন, ২০১৪ সালে ১৯৯ জন, ২০১৫ সালে ৫২১ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ চিত্র থেকেই স্পষ্ট- প্রতিবছরই শিশু ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে। সংস্থাটির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ৬৮৬টি শিশু ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ইভ টিজিং, যৌন হয়রানীসহ বিভিন্ন ধরনের যৌন নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়েছে। ২০১৫ সালে সারা দেশে ৭২৭টি শিশু যৌন নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়েছিল। তবে তাদের জরিপ অনুসারে ২০১৫ সাল থেকেই শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন ও নিপীড়ন আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৪তে সর্বমোট ২২৪টি শিশু যৌন নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়েছিল।
সংবাদ মাধ্যমের চিত্র
মানবাধিকার ও আইন সহায়তাকারী বেসরকারি সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বিভিন্ন গণমাধ্যম পর্যলোচনা করে নারী ও শিশু নির্যাতনের নানা ঘটনা সংরক্ষণ করে। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ৭২৪টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৬ বছরের কম বয়সী শিশু ৬২ জন, ৭ থেকে ১২ বছর বয়সী ১৭৮ জন এবং ১৩ থেকে আঠারো বছর বয়সীর সংখ্যা ২৫১ জন। অর্থাৎ ধর্ষণের শিকার হওয়া প্রায় সবাই অপ্রাপ্তবয়স্ক। আসক-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ১৬ মার্চ পর্যন্ত মোট ২৭ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। যাদের ২০ জনই অপ্রাপ্তবয়স্ক। এ রকম বিভিন্ন সংস্থার হিসাবেও একথা স্পষ্ট যে ধর্ষণের মতো নির্মম ঘটনার শিকার হওয়াদের অধিকাংশই শিশু। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাহমুদা শারমীন বেনু বলেন, নারী-শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে সমবেত সোচ্চার হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আইন দিয়ে কখনোই এমন বর্বর ঘটনা প্রতিরোধ করা যাবে না। দেশে নারী-শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে বহু আইন রয়েছে, তারপরও নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। পারিবারিকভাবেই সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। এখন নারী ও শিশু নির্যাতনের ধরন পাল্টাচ্ছে, যা খুবই উদ্বেগজনক। নির্যাতন প্রতিরোধ কিংবা বন্ধে সামাজিক আন্দোলন আরও জোরদার করতে হবে।
প্রতিদিন গড়ে ২ জন শিশু নির্যাতিত
নারী নির্যাতনের ধরন পাল্টানোর পাশাপাশি সহিংসতাও দিন দিন বাড়ছে। বিশেষত মেয়েশিশুর ক্ষেত্রে এর ভয়াবহতা আরও বেশি। ২০১৬ সালে নির্যাতিত মধ্যে মেয়েশিশু নির্যাতনের হার ২০ শতাংশ। এর মধ্যে ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি (৬০ দশমিক ৬৩ শতাংশ) নির্যাতনের শিকার। ১৮ বছরের নিচে প্রতিদিন গড়ে ২ (১ দশমিক ৭) জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। ১৪ মার্চ মঙ্গলবার ব্র্যাক সেন্টারে ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচি আয়োজিত ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আমাদের করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এ তথ্য জানানো হয়। ব্রাকের এই কর্মসূচির প্রধান ফারহানা হাফিজ বলেন, দেশের ৫৫টি জেলার ১২ হাজারেরও বেশি কমিউনিটিভিত্তিক নারী উন্নয়ন সংগঠন ‘পল্লী সমাজ’ এবং ব্র্যাকের বিভিন্ন কর্মসূচির বিভিন্ন প্লাটফর্মের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে পাওয়া গত বছরের নারী ও শিশু নির্যাতনের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এ ডাটাবেজ তৈরি করেছেন। তিনি বলেন, গবেষণায় গত বছরের ৫৫ জেলায় ৭ হাজার ৪৮৯ নারী ও মেয়েশিশু নির্যাতনের ঘটনা নথিভুক্ত হয়। গড়ে প্রতি মাসে ৬২৪টি, প্রতিদিন ২০ দশমিক ৫টি এবং প্রতি জেলায় মাসে ১১ দশমিক ৩৫টি নির্যাতনের ঘটনা নথিভুক্ত হয়। মোট নথিভুক্ত ঘটনার ৬৭ শতাংশ শারীরিক নির্যাতন, ১৯ শতাংশ যৌন নির্যাতন, ১৪ শতাংশ মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ৫৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে পারিবারিক পর্যায়ে। তিনি বলেন, পারিবারিক সহিংসতা ও নির্যাতন বেড়েই চলছে। নারীরা শারীরিক নির্যাতনের শিকার বেশি হলেও শিশুদের বেলায় সব থেকে বেশি ঘটছে ধর্ষণের ঘটনা।
গত বছর ১ হাজারেরও বেশি ধর্ষণের ঘটনা
নারী ও শিশু মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১৬ সালে এক হাজারেরও বেশি নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। সংগঠনটি নারীদের ওপর নির্যাতনের এমন নির্মম ও নিষ্ঠুর ধরনকে উদ্বেগজনক বলে বর্ণনা করেছে। যুগান্তরসহ বাংলাদেশের ১৪টি দৈনিক পত্রিকার খবর বিশ্লেষণ করে সংগঠনটি বলছে, গত বছর এক হাজার ৫০ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে। নারী ও কন্যা শিশুদের ওপর নির্যাতনের বাৎসরিক এ প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, আগের বছরের তুলনায় সংখ্যা কিছুটা কমেছে। তবে সংগঠনটির সভাপতি আয়েশা খানম বলেন, সংখ্যা কম বেশির চেয়ে বেশি উদ্বেগের ছিল নির্যাতনের ধরন ও মাত্রা। সংস্থাটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৬৬ জন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪৪ জনকে। এ ছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১৬৫ জনকে। শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছে ১২০ জন নারী এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৮০ জন। এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে ৩৯ জন, তার মধ্যে মৃত্যু হয়েছে একজনের। অগ্নিদগ্ধ হয়েছে ৯০ জন, অগ্নিদগ্ধ হয়ে মত্যু হয়েছে ২৩ জনের। অপহরণের ঘটনা ঘটেছে মোট ১৩২টি। নারী ও শিশু পাচার করা হয়েছে ৪৫ জন, তার মধ্যে পতিতালয়ে বিক্রি করা হয়েছে ১১ জনকে। ৭৬২ জন নারী ও শিশুকে হত্যা করা হয়েছে, হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে ৭৬ জনকে। যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৩৬২ জন নারী। এদের মধ্যে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে ১৭৩ জনকে। গৃহপরিচারিকা নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৬৩ জন, তার মধ্যে হত্যা করা হয়েছে ২৫ জনকে এবং নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে সাতজন নারী।
ঝাড়ফুঁক কিংবা চিকিৎসার নাম করে ধর্ষণ
গত বছর নভেম্বরের ঘটনা। নীলফামারীতে জিনের বাদশা সেজে মোটা অংকের টাকার প্রলোভন দেখিয়ে দুই বোনকে ধর্ষণ করেছে এক ভণ্ড প্রতারক। আফজাল নামের ওই প্রতারক টাকা দেয়ার লোভ দেখিয়ে জেলার একটি পরিবারকে তার বাড়িতে ডেকে নেয়। গভীর রাতে আফজাল তার ঘরে জিনকে নিয়ে আসার কথা বলে ওই পরিবারের বড় মেয়ে এক সন্তানের জননী ও ৫ নভেম্বর ছোট মেয়ে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রীকে ধর্ষণ করে। ধর্ষণের পর মেয়ে দুটিকে বোঝানো হয় তোমাদের সঙ্গে যা হয়েছে তা জিন করেছে। এ কথা প্রকাশ করলে তোমাদের মারাত্মক ক্ষতি হবে। ঘটনার পর ছোট মেয়েটি অসুস্থ হয়ে পড়লে ঘটনাটি ফাঁস হয়ে যায়। শহরাঞ্চলে এমন ঘটনা না ঘটলেও গ্রামে অহরহ এ ধরনের ঘটনা ঘটে। যার মধ্যে ২/১টি গণমাধ্যম কিংবা থানা পুলিশ পর্যন্ত গড়ালেও বেশিরভাগই থেকে যায় দৃষ্টির আড়ালে। আবার গ্রামাঞ্চলে সন্তান ধারণে ব্যর্র্থ মহিলাদের চিকিৎসার নাম করেও ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে বিভিন্ন স্থানে।
বাল্যবিয়ে বেড়েছে
দেশে শিশু ধর্ষণের ঘটনার বাড়াবাড়ির পাশাপাশি বেড়েছে বাল্যবিয়ের সংখ্যা। এছাড়াও বেড়েছে ধর্ষণের চেষ্টা, শিশুদের স্বাস্থ্য সমস্যা, নির্যাতন, অপরাধে জড়িয়ে পড়া, নিখোঁজ, পাচার ইত্যাদি। ১৬ মার্চ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘বাংলাদেশের শিশু পরিস্থিতি ২০১৬ : সংবাদপত্রের পাতা থেকে’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, সংবাদপত্রে প্রকাশিত ২৮২টি সংবাদে ৩০৪ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। এর মধ্যে মারা গেছে ২২ জন, ৬৯ জন গুরুতর আহত হয়েছে। ধর্ষিত শিশুদের মধ্যে ৬টি ছেলে শিশুও রয়েছে, যারা ধর্ষিত হয়েছে স্কুলের কেরানি ও দোকানদারের দ্বারা। আর মেয়ে শিশুরা প্রতিবেশী, শিক্ষক, আত্মীয়স্বজন, বখাটে, অপরিচিত ব্যক্তি, বন্ধু, বাড়িওয়ালা, অফিসের কর্মচারী, বাস ড্রাইভার ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ২০১৫ সালে শিশু ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ২৯০টি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালে শিশু নির্যাতনের ১১৭টি প্রকাশিত খবরে ৪০৮ জন শিশু নির্যাতনের খবর প্রকাশিত হয়। ২০১৫ সালে নির্যাতন সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৪টি এবং ২০১৪ সালে ৯৩টি। নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে নিহত হয়েছে ১১ জন। ২০১৬ সালে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে ৮৩ জন শিশু। এর মধ্যে চার শিশু নিহত হয়েছে। একটি শিশু বাল্যবিয়ে মানতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে। একজনকে বাবা-মা পিটিয়ে মেরেছে, আরেকজনকে শ্বশুরবাড়ির লোক যৌতুকের জন্য মেরে ফেলেছে। অথচ ২০১৫ সালে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে ১১ জন শিশু। ধর্ষণের মামলা চলাকালীন বিভিন্ন বিব্রতকর পরিস্থিতি এবং বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা আইনের আশ্রয় নিতে অনীহা তৈরি করে বলে মনে করেন শিশু অধিকার কর্মীরা। মানবাধিকার কর্মীরা অভিযোগ করেছেন, জামিন অযোগ্য অপরাধ হওয়ার পরও অনেক ক্ষেত্রে জামিন পেয়ে যাচ্ছে অভিযুক্তরা। এ বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জানান, অপরাধ করে সহজে জামিন পাওয়া গেলে অপরাধের মাত্রা বেড়ে যায়। শিশু ধর্ষণের ব্যাপারে যদি আলাদা সেল করা হয়, মামলার গতি তদারকি করা হয়, তাহলে এ ধরনের অপরাধ অনেকটা কমতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট
নারী নির্যাতন সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ রিপোর্ট বলছে, বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন অহরহ। পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধের যেসব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, সেটাও যথার্থ নয়। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বের মোট নারীর ৭ শতাংশই জীবনের যে কোনো সময় ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।শিশুদের ওপর নির্যাতনের নানা দিক নিয়ে গবেষণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং সমাজবিজ্ঞানী মাহবুবা নাসরীন। তিনি বলেন, মূলত দরিদ্র শ্রেণীর শিশুরা শ্রমজীবী বাবা-মায়ের অনুপস্থিতিতে দুর্ঘটনার শিকার হয়। আরেকটি গ্রুপ যারা নিজেরাই কর্মজীবী, ফলে তারা ধর্ষণের ঝুঁকিতে থাকছে বেশি। তিনি বলছেন, অনেকে অজ্ঞতা আর সামাজিক মর্যাদা হানির আশঙ্কায় আদালত বা পুলিশের দোড়গোড়ায় পৌঁছাচ্ছেন না। ফলে এসব অপরাধ ঘটছেই। অনেকে শিশু বা অভিভাবকই জানে না কোথায় অভিযোগ জানাতে হয়। আর অনেকে দেখছেন অনেক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে কিন্তু ঠিক মত বিচার হচ্ছে না। বাইরে মিটমাট হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে অপরাধীরা আসকারা পেয়ে যাচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.