ভোক্তা সুরক্ষা আইন ভোক্তাবান্ধব নয়‌

ভোক্তার সুরক্ষায় তৈরি ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯’ও পুরোপুরি ভোক্তাবান্ধব নয়। খাদ্যে ভেজাল মেশানোর অপরাধে ভারতে যাবজ্জীবন, পাকিস্তানে ২৫ বছর কারাদণ্ড, যুক্তরাষ্ট্রে সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশে। এখানে ভেজাল পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সহায়ক আইন নেই। যে আইনটি তৈরি করা হয়েছে ওই আইনে ভোক্তার সুরক্ষায় কি কি সুবিধা দেয়া হয়েছে, আইন লংঘনকারীদের বিরুদ্ধে কি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা রয়েছে, কারা এটি প্রয়োগ করবে কিংবা কোথায় অভিযোগের জন্য যেতে হবে এসব দিক-নির্দেশনা জানে না খোদ ভোক্তারাও। এ কারণে ১৬ কোটি জনগোষ্ঠীর একটি দেশে গত প্রায় ৮ বছরে ভোক্তা অধিকার লংঘনের দায়ে প্রতিকার চাইতে আসা অভিযোগকারী মাত্র ৪ হাজার ২৪৫ জন। যেখানে নিষ্পত্তির হার আরও কম মাত্র ৩ হাজার ৮৭৩ জনের। যার মধ্যে এখনও তদন্তাধীন রয়েছে ৩৭২টি অভিযোগের। এ সময়ে মূল্য কারসাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে ২৪ হাজার ৬৫২টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়েছে। আর্থিক দণ্ড হিসেবে এসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর ক্ষতিপূরণ আদায় করেছে মাত্র ১৮ কোটি টাকা। কিন্তু এ সময়ে অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে সশ্রম কারাদণ্ডের মতো শাস্তি দিতে পারেনি সংস্থাটি। কারণ আইনেই এর সীমাবদ্ধতা দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে।
এর থেকেই দেশে ভোক্তা অধিকার সুরক্ষার প্রকৃত চিত্রের ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে আইনে যেটুকুই অধিকারের স্বীকৃতিই দেয়া হয়েছে সেটি সারা দেশে ভোক্তাপর্যায়ে পৌঁছে দিতেও জনসচেতনামূলক পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। এসব কারণে দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময়ের দাবির মুখে ২০০৯ সালে জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ, ভোক্তা-অধিকার বিরোধী কার্য প্রতিরোধ ও তৎসংশ্লিষ্ট বিধান প্রয়োগে আইনটি পাস করা হয়।’ কিন্তু আইনটি পাসের পর প্রায় ৯ বছর অতিবাহিত হতে চললেও মাঠপর্যায়ে এ আইনটির কার্যকারিতার উল্লেখযোগ্য কোনো নজির নেই। যার কারণে এর সুফলও পাচ্ছে না ভোক্তারা। জানাযায়, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯-এ সর্বোচ্চ ৩ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। আইনি বিধানে এসব দুর্বলতার কারণেই মাঠপর্যায়ে এর তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। বর্তমান ভোক্তা অধিকার আইনে মোট ৮২টি ধারা রয়েছে। এ ধারার কোনোটির আবার কয়েক অনুচ্ছেদ উপ-ধারায় বিভক্ত। আইনে বিক্রেতা মানে কোনো পণ্যের উৎপাদনকারী, প্রস্তুতকারী, সরবরাহকারী, পাইকারী ও খুচরা বিক্রেতাকে বোঝানো হয়েছে। ‘নকল’ অর্থে বোঝানো হয়েছে বাজারজাতকরণের জন্য অনুমোদিত কোনো পণ্যের অননুমোদিত অনুকরণে অনুরূপ পণ্যের সৃষ্টি বা প্রস্তুত, যার মধ্যে ওই পণ্যের গুণাগুণ, উপাদান, উপকরণমান বিদ্যমান থাকুক বা না থাকুক। অপরদিকে আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি জেল-জরিমানা। যার আওতায় সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে বিনাশ্রম ও সশ্রম কারাদণ্ড রাখা হয়েছে। আইন অনুযায়ী ভোক্তা অধিকারবিরোধী কার্যের জন্য কোনো বিক্রেতার বিরুদ্ধে যে কোনো ভোক্তা আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর’র মহাপরিচালকের কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ দায়ের করতে হয়।
অপরদিকে বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ, ১৯৫৯ (সংশোধিত ২০০৫)-এ সর্বোচ্চ ১ বছর সশ্রম কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ডের বিধান রয়েছে। এ ছাড়া নতুন প্রণীত নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩-তে জরিমানা ও শাস্তির পরিমাণ বৃদ্ধি করে অনুর্ধ্ব ৫ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান করা হলেও এখানে সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়নি। অথচ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে খাদ্যে ভেজাল মেশানোর অপরাধে কঠোর শাস্তি দেয়া হয়। এ ছাড়া ফরমালিনের অপব্যবহার রোধে ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৩ প্রণয়ন করা হয়েছে। এতেও অপরাধ দমনে কঠোর সাজার বিধান নেই। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, দেশে ভোক্তা স্বার্থ রক্ষায় কঠোর আইনের অভাবের পাশাপাশি বিদ্যমান আইনের সঠিক বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে ভেজাল প্রতিরোধে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, আইনি দুর্বলতা থাকলেও যেটুকুই হয়েছে তাও মন্দের ভালো। কিন্তু অভাব শুধু কার্যকারিতার। এর জন্য সবার আগে জোর দিতে হবে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরির ওপর। সারা দেশে ভোক্তার স্বার্থ সুরক্ষার বার্তা পৌঁছে দেয়াটা জরুরি। সেটি কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের একক প্রচেষ্টা কিংবা সক্ষমতা দিয়ে সম্ভব হবে না। সরকারের আন্তরিকতা থাকতে হবে। পাশাপাশি সুশীল সমাজকেও উদ্যোগী হতে হবে।
এগিয়ে আসতে হবে সাধারণ মানুষকেও। নতুবা আইন যেটুকুই আছে তারও সুফল আসবে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু আইনি সীমাবদ্ধতাই শেষ কথা নয়। খাদ্য তদারকি ও পরিদর্শনে প্রয়োজনীয় জনবলেরও অভাব রয়েছে। পাশাপাশি পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ, লজিস্টিকস ও যানবাহনের অভাব প্রকট। রয়েছে প্রণোদনা ও প্রশিক্ষণের ঘাটতি। খাদ্যের নমুনা সংগ্রহ-রক্ষণাবেক্ষণেরও নেই পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত সুবিধা। এর ফলে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা ইচ্ছা সত্ত্বেও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করতে পারেন না। এ ছাড়া নজরদারির কার্যক্রম শুধু মহানগরীগুলোতে দৃশ্যমান হলেও উপজেলা বা গ্রাম পর্যায়ে তা মোটেই লক্ষ করা যায় না। অথচ খাদ্যে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার দেশের সব নাগরিকের সমানভাবে রয়েছে। এ প্রসঙ্গে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম লসকর দাবি করেন, এখনও অনেক ভোক্তা তাদের অধিকার বা আইন সম্পর্কে অবহিত নয় এটা সত্য। তবে সচেতনতা বাড়াতে আমরা বিভিন্ন স্থানে এই আইন সম্পর্কে সভা-সেমিনারের আয়োজন করছি। যাতে ভোক্তারা তাদের অধিকার ও আইন সম্পর্কে আরও সচেতন হতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.