উড়ছে বেলুন ভাষার, আশার by তারিক মনজুর

প্রতিযোগিতা নয়, হাসি–আনন্দের উৎসব। চট্টগ্রাম, ১৫ মে ২০১৫
জাতীয় পতাকার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন। টাঙ্গাইল, ৯ মে ২০১৫
ভাষা প্রতিযোগ যে প্রাণের মেলায় পরিণত হয়েছে, এবার বেশ ভালোই টের পাওয়া যাচ্ছিল। ফেব্রুয়ারিতেই ফোন আসতে শুরু করল—এবার কবে শুরু হবে? মার্চে ফোন এল—এবার কি হবে না ভাষা প্রতিযোগ? এপ্রিলে প্রশ্ন এল—এবার কি আমাদের অঞ্চলে হবে না?
সব প্রশ্নের জবাব নিয়ে এবার ভাষা প্রতিযোগ শুরু হলো ২ মে। কিন্তু অনেকের দাবি মেটাতে পারিনি আমরা। সেগুলো না পারার পেছনে সংগত কারণও ছিল। এমনকি, গতবারের চেয়ে আঞ্চলিক উৎসব আমরা কমাতেও বাধ্য হয়েছি। সারা দেশের নয়টি অঞ্চলে উৎসব হচ্ছে এবার।
২০০৫ সালে জন্ম হয়েছিল এই প্রতিযোগিতার। অনেক ছাত্রছাত্রী প্রশ্ন করে ‘প্রতিযোগিতা’ না হয়ে এর নাম ‘প্রতিযোগ’ হলো কেন? আমরা তখন জবাব দিই, ‘প্রতিযোগ’ আর ‘প্রতিযোগিতা’ দুটোই কিন্তু বিশেষ্য, দুটোই একই অর্থ বহন করে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, যিনি কি না এই উৎসবের আহ্বায়ক, এই ‘প্রতিযোগ’ শব্দটি অভিধান থেকে তুলে এনেছেন আমাদের জন্য।
এই উৎসবের উদ্বোধন হয় জাতীয় পতাকা আর ভাষা প্রতিযোগের পতাকা তোলার মধ্য দিয়ে। যে স্কুল বা কলেজের মাঠে অনুষ্ঠান হয়, সেখানকার প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষ জাতীয় পতাকা তোলেন। একজন বিশিষ্ট শিক্ষক বা ভাষাবিদ তোলেন ভাষার পতাকা। এবার কিন্তু উদ্বোধনে অংশ নিয়েছে অংশগ্রহণকারীরাও রং-বেরঙের বেলুন উড়িয়ে। বেলুন যখন আকাশে উড়ে যেতে থাকে, ছাত্রছাত্রীরা তখন পরীক্ষার হলে ঢোকে ৪০ নম্বরের পরীক্ষা দিতে।
পরীক্ষা শেষ করে আবার সবাই এসে প্যান্ডেলের নিচে বসে। শিক্ষকেরাও এসে বসেন মঞ্চে। এরপর শুরু হয় শিক্ষার্থীদের প্রশ্নবাণ। তাদের নানা মাত্রার প্রশ্ন আর কৌতূহলের জবাব দেন মঞ্চে বসে থাকা শিক্ষকেরা। ‘প্রশ্নোত্তর পর্ব’ চলার সময় প্রতিযোগীদের খাতা মূল্যায়নের কাজ চলতে থাকে। এরপর শুরু হয় পুরস্কার বিতরণ। মোটামুটি এই হলো অনুষ্ঠানের কাঠামো।
এ বছর ২ মে সিলেট, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা নিয়ে ‘হবিগঞ্জে’ বসেছিল প্রথম আসর। আমরা তো হবিগঞ্জে ভয়ই পেয়ে গেলাম। সকাল থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। এরপর তোমাদের হাসির সঙ্গে সূর্যের হাসিও দেখা দিল। সবকিছু হলো ঠিকঠাক মতো।
টাঙ্গাইলে আসর বসেছিল ৭ মে ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, শেরপুর, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও জামালপুর জেলার প্রতিযোগীদের নিয়ে। ঢাকা থেকে বিশাল দলের পাশাপাশি টাঙ্গাইলে গিয়ে হাজির হলেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। তাঁর উপস্থিতি ও কথা অনুষ্ঠানকে আরও জমিয়ে তুলেছিল।
এরপর ১৫ মে কুমিল্লা, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম ও রাঙামাটি জেলার অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হলো এ বছরের তৃতীয় আঞ্চলিক উৎসব। অন্য সব অঞ্চলের মতো এখানেও ঢাকা থেকে উড়ে এল ভাষা প্রতিযোগের দল, যে দলে শিক্ষকেরা থাকেন, আয়োজকেরা থাকেন, থাকেন আয়োজনকে সফল করে তোলার জন্য একদল কর্মী। কিন্তু আঞ্চলিক অনুষ্ঠানগুলো মূলত সফল হয়ে ওঠে জেলা প্রতিনিধি আর বন্ধুসভার অক্লান্ত পরিশ্রমে।
ভাষা প্রতিযোগের বয়স এখন ১১। একজন দুরন্ত বালকের সমান বয়স। সারা দেশের চতুর্থ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির যেকোনো ছাত্রছাত্রী অংশ নিতে পারে এই প্রতিযোগিতায়। আমরা একে প্রতিযোগিতা না বলে অবশ্য প্রতিযোগ বলতেই পছন্দ করি। এই ‘প্রতিযোগ’ প্রতিযোগিতার জন্য নয়, এই প্রতিযোগের অর্থ করেছি আমরা একের সঙ্গে অন্যের যোগ, ভাষার সঙ্গে তোমাদের যোগ। তোমাদের আগ্রহ, কৌতূহল আর ভাষা-বিষয়ক প্রশ্ন শুনে আমরা মুগ্ধ হই। ভাবি, আমাদের বাংলা ভাষা নিয়ে তোমরাও ভাবছ।
লেখক: ভাষা প্রতিযোগের সমন্বক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক

No comments

Powered by Blogger.