মানব পাচারের বিরুদ্ধে কাজ করার আহ্বান

রাজধানীর একটি হোটেলে গতকাল সাংবাদিকদের সঙ্গে
মতবিনিময় করেন নোবেলজয়ী কৈলাশ সত্যার্থী l প্রথম আলো
মানব পাচারকে বিশ্বমানবতার জন্য লজ্জা হিসেবে মন্তব্য করেছেন নোবেলজয়ী কৈলাশ সত্যার্থী। তিনি বলেছেন, বিশ্বে মানব পাচারের অর্থনীতি ১২ হাজার কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে অনেক ক্ষমতাধর ব্যক্তি এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছেন। ফলে এর বিরুদ্ধে বিশ্বের নাগরিক সমাজকে একত্রে কাজ করতে হবে।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর একটি হোটেলে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে কৈলাশ সত্যার্থী এসব মন্তব্য করেন। গণসাক্ষরতা অভিযান আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে মানব পাচার রোধে তিনি সুশিক্ষার প্রচার এবং উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে নিজ দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।
১৯৮০ সাল থেকে শিশুশ্রম রোধে আন্দোলন করে যাওয়া এই মানবাধিকার কর্মী গতকাল বিকেলে ঢাকায় পৌঁছান। আজ ও কাল খাদ্য অধিকার এবং শিক্ষা অধিকারবিষয়ক দুটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেবেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গেও দেখা করবেন কৈলাশ।
শিশুদের হাতে বন্দুক আর গুলি না দিয়ে বই তুলে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে কৈলাশ সত্যার্থী বলেন, বিশ্বে সমরাস্ত্রের পেছনে এবং শুধু ইউরোপে প্রসাধনসামগ্রীর পেছনে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়, তার এক-চতুর্থাংশ ব্যয় করলে সব শিশুর শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব। এখনো বিশ্বের ১২ কোটি শিশু শিক্ষার সংস্পর্শ পায় না জানিয়ে তিনি বলেন, সুশিক্ষাই সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে। কেননা, শিক্ষার অভাবেই মৌলবাদসহ নানা ধরনের নিরাপত্তাঝুঁকি তৈরি হয়।
কৈলাশ বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশেই শিক্ষকের চেয়ে সৈনিকের সংখ্যা বেশি। কিন্তু শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হলে একটি দেশে শিক্ষকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি থাকতে হবে। সব ধরনের মৌলবাদীরা তাই চায় না শিক্ষার প্রসার ঘটুক। যে কারণে আফগানিস্তান-পাকিস্তানে এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর হামলা বেশি হচ্ছে।
মতবিনিময়ের সময় কৈলাশ সত্যার্থীর সঙ্গে আরও উপস্থিত ছিলেন তাঁর স্ত্রী সুমেধা সত্যার্থী ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী।
রাশেদা কে চৌধূরী দেশের শিক্ষা আন্দোলন নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে কৈলাশ সত্যার্থীর সহযোগিতা পেয়েছেন উল্লেখ করে বলেন, নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর প্রথম এক মাসের মধ্যে কৈলাশ ৩০ হাজার আমন্ত্রণ পান। কিন্তু বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ পাওয়ার পর তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান।
শিশুশ্রম ও পাচার রোধে কৈলাশের কর্মতৎপরতা তুলে ধরতে গিয়ে রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, সুমেধা ও কৈলাশ সত্যার্থী দম্পতি মিলে ভারতে পাচার হওয়া শিশুদের উদ্ধার করে তাঁদের আশ্রমে নিয়ে আসেন। তাঁদের আশ্রমে এ পর্যন্ত ৮৫ হাজার শিশুকে আশ্রয় দিয়ে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। পাচার হওয়া শিশুদের উদ্ধার করতে গিয়ে দুর্বৃত্তদের হাতে তিনি একবার গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন।
বাংলাদেশকে প্রতিবেশী দেশ নয়, নিজের বাড়ি হিসেবে উল্লেখ করে কৈলাশ বলেন, বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ অনেক শক্তিশালী। এখানকার সমাজের মধ্যেও যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে, যা সংগঠিত করতে পারলে বাংলাদেশ থেকে মানব পাচার বন্ধ হবে, শিশুশ্রম দূর হবে এবং সব শিশুর জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
গণমাধ্যম এবং চলচ্চিত্রে উন্নত দেশের উন্নত জীবনযাপনের চিত্র দেখে অনেকে নিজের দেশে কিছু করার চেষ্টা না করে বিদেশে পাড়ি জমান—এই মন্তব্য করে কৈলাশ বলেন, এ পরিস্থিতি থেকে বের হতে হলে পরিবারগুলোকে সচেতন হতে হবে। উদ্যোক্তাদের আরও বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। আর রাষ্ট্রের দায়িত্ব কৃষি ও শিল্পশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ঠিক করে দেওয়া। যাতে তাঁরা নিজের দেশে ভালোভাবে জীবনযাপনের সুযোগ পান।
মতবিনিময় সভার উদ্যোক্তারা জানান, ভারতে বাচপান বাঁচাও আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা কৈলাশ সত্যার্থী এর আগে ২০০৯ ও ২০১০ সালে গণসাক্ষরতা অভিযানের আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসেছিলেন। শিশু ও তরুণদের নির্যাতনের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ায় গত বছর পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজাইয়ের সঙ্গে যৌথভাবে কৈলাশকে নোবেল কমিটি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়।
১৯৫৪ সালে ভারতের মধ্যপ্রদেশে জন্ম নেওয়া কৈলাশ শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক প্রচারণায় বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করেন।

No comments

Powered by Blogger.