ডিজিটাল যুগের নব্য দাসত্ব by আতাউর রহমান

আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ লেখক আলেক্স হেলির বিখ্যাত উপন্যাস রুট্স যাঁরা পড়েছেন কিংবা ওই টিভি সিরিয়ালটি দেখেছেন, সর্বাগ্রে তাঁদের স্মৃতির খুঁটিকে একটু প্রবলভাবে নাড়া দিতে চাই। মিস্টার হেলির সপ্তম পূর্বপুরুষ কুন্তা কিন্তে বিন ওমর ছিলেন আফ্রিকার গাম্বিয়া রাজ্যের জ্যুফুর গ্রামের একজন গর্বিত নাগরিক। তিনি যখন ১৭ বছর বয়সের টগবগে তরুণ, তখন একদিন জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়ে শ্বেতাঙ্গ ‘স্লেইভ-ক্যাচার’ তথা দাস-ধরা এবং ওদের স্থানীয় দোসরদের খপ্পরে পড়ে যান। ওরা তাঁর চিৎকার-চেঁচামেচি উপেক্ষা করে তাঁকে লোহার শিকল পরিয়ে আরও অনেকের সঙ্গে জাহাজে করে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেয়, সময় লাগে মোট আড়াই মাস। ওই সময়টায় জাহাজে তাদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার করা হয়।
জাহাজটি যখন উত্তর আমেরিকার অ্যানোপলিস বন্দরে ভেড়ে, তখন জাহাজের ১৪০ জন দাসের মধ্যে কুন্তা কিন্তেসহ ৯৮ জনকে জীবিত পাওয়া যায়, অবশিষ্ট ৪২ জনের পথেই সলিল সমাধি ঘটে। অতঃপর জীবিত ব্যক্তিদের জীবজন্তুর মতো নিলামে চড়ালে জনৈক শ্বেতাঙ্গ সাহেব তাঁর প্ল্যান্টেশন কাজ করার জন্য কুন্তাকে কিনে নেন। বারাক হোসেন ওবামা স্বেচ্ছায় খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে বারাক ওবামা হয়েছেন, আর কুন্তাকে গায়ের জোরে খ্রিষ্টান বানিয়ে নাম দেওয়া হয়েছিল টবি। কিন্তু তিনি এই নতুন নামকরণ ও দাসত্ব—কোনোটাই মেনে নিতে পারেননি; তাই বারবার পালানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছিলেন। চতুর্থবার ধরা পড়ার সময় তাঁর পায়ের পাতার অর্ধেক কেটে ফেলে তাঁকে নিরস্ত করা গিয়েছিল। মি. হেলি প্রায় ২০০ বছর পর শিকড়ের সন্ধানে জ্যুফুর গ্রামে উপস্থিত হলে তাঁর পরিচয় পেয়ে সেই গ্রামের আবালবৃদ্ধবনিতা যখন তাঁকে ‘মিস্টার কিনতে’ বলে সম্বোধন করতে লাগল, তখনকার মনোভাব হেলি ব্যক্ত করেছেন এভাবে: ‘আমার মনে হলো যেন ইতিহাসে মানুষ-ভাইদের বিরুদ্ধে মানুষের অবিশ্বাস্য নৃশংসতা, যেটা বোধ করি মানব জাতির সবচেয়ে বড় বিচ্যুতি, সেটার জন্য আমি বিলাপ করে কাঁদছিলাম।’
কুন্তার দাসত্ব শুরুর সাল ছিল ১৭৬৭; আর এটা ২০১৫ সাল, ডিজিটাল যুগ। পেছনে ফেলে আসা আড়াই শ বছরে মিসিসিপি-মিসৌরি আর পদ্মা-যমুনা দিয়ে কত সহস্র কোটি কিউসেক পানি প্রবাহিত হয়েছে; মহাত্মা আব্রাহাম লিংকন ১৮৬৭ সালে আমেরিকায় দাস প্রথার বিলোপও সাধন করেছেন, যে কারণে কুন্তার উত্তরসূরিরা স্বাধীন ও সুশিক্ষিত হতে পেরেছে। দাসত্ব প্রথা আজ পৃথিবী থেকে বিলুপ্তপ্রায়; কিন্তু কিছু লোভাতুর অমানুষের কারণে আজও সেটা নব্যরূপে বিদ্যমান। পত্রিকার প্রতিবেদনে প্রকাশ, থাইল্যান্ডের সংখলা প্রদেশের সাদাও উপকূল হচ্ছে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ তথা সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের বেচাকেনার হাট। সমুদ্রপথে ট্রলারে করে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে যাওয়া লোকদের জঙ্গলে জিম্মি করে দালালরা মুক্তিপণ আদায় করে এবং যাদের বেলায় মুক্তিপণ আদায় করা সম্ভব হয় না, তাদের হয় বিক্রি করে দেয় নতুবা মেরে ফেলে। অনুজার নামের জীবিত উদ্ধার এক বাংলাদেশি যুবক বলেছেন, তাঁকে নাকি কক্সবাজার থেকে অপহরণ করা হয়েছে, ঠিক যেমন কুন্তা কিন্তেকে তাঁর গ্রাম থেকে অপহরণ করা হয়েছিল। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়েই থাকে এবং ইতিহাস প্রায়ই বড় নির্মম।
প্রসঙ্গত মনে পড়ে গেল, আমি সৌদি আরবের রিয়াদের বাংলাদেশ দূতাবাসে লেবার কাউন্সিলর পদে কর্মরত থাকাকালে এক মধ্যবয়সী নারী আমার কাছে ঘটনাচক্রে এলেন, যাঁর দেশের বাড়ি ফরিদপুর জেলায়। তিনি বাংলাদেশে প্রথম সৌদি রাষ্ট্রদূত কর্তৃক গৃহকর্মী হিসেবে সে দেশে নীত হন এবং ওই সময়ে রাষ্ট্রদূতের মেয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দেড় দশক যাবৎ তিনি দেশের খবরাখবর পান না, দেশে যেতেও পারেন না। দেশে তাঁর দুই ভাই আছেন, যাঁদের কেবল ডাকনাম তিনি জানেন। তবে নিকটতম শাখা ডাকঘরটির নাম তাঁর জানা থাকায় আমি ক্লু পেয়ে গেলাম। সরাসরি পোস্টমাস্টারের কাছে চিঠি লিখলাম, ভাইদের খুঁজে বের করে বোনের উদ্দেশে লেখা তাঁদের চিঠি আমার কাছে পাঠাতে। ১৫ দিনের মধ্যেই ঈপ্সিত ফল পাওয়া গেল। ওই নারীকে দূতাবাসে ডেকে এনে আমি যখন তাঁর ভাইয়ের দীর্ঘ চিঠি পড়ে শোনাচ্ছিলাম, তখন পুঁথির ভাষায়, তাঁর ‘কপোল বহিয়া যায় নয়নের জলে’। সে দৃশ্য আমি আজও ভুলতে পারিনি এবং বলাই বাহুল্য, আমি ডাক বিভাগের ওপরতলার কর্মকর্তা ছিলাম বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। সৌদিরা ফিলিপাইন আর নেপাল থেকে ইদানীং নারী গৃহকর্মী না পেয়ে আমাদের দিকে হাত বাড়িয়েছে এবং আমরাও সম্মতি জ্ঞাপন করেছি। ভবিষ্যতে কত ধরনের মানবিক ঘটনার উদ্ভব হবে, কে জানে!
যাকগে। ফিরে আসি রুট্স-এ। কুন্তাকে শৈশবে তাঁর দাদি আয়িশা একটা মজার গল্প শুনিয়েছিলেন: একটি বাচ্চা ছেলে একদিন নদীর পাড় দিয়ে হাঁটতে গিয়ে দেখতে পেল যে এক কুমির শিকারিদের পাতা জালে আটকা পড়েছে। কুমির তাকে সাহায্যের আবেদন জানালে সে কাছে যেতেই কুমিরটা খপ্ করে দাঁতের ফাঁকে তাকে আটকে দিল। ‘তুমি কি এভাবে ভালোকে মন্দ দিয়ে প্রতিদান দিতে চাও?’ ছেলেটি এই প্রশ্ন করতেই কুমির জবাব দিল, ‘অবশ্যই, এটাই তো সংসারের নিয়ম।’ ছেলে এটা মানতে রাজি না হওয়ায় কুমির ওই পথ দিয়ে গমনরত প্রথম তিনজন সাক্ষীর মতামত না নিয়ে তাকে খাবে না বলে আশ্বস্ত করল। প্রথমেই এল এক বুড়ো গর্দভ। গর্দভ ছেলেটার মুখে সবটা শুনে শুধু বলল, ‘আমি বুড়ো হয়ে গেছি এবং কাজ করতে পারি না বলে আমার মালিক আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে, যাতে আমি চিতাবাঘের পেটে যাই।’ অতঃপর এল এক বুড়ো ঘোড়া। সেও একই কথা বলল। ‘দেখলে তো?’ কুমির ছেলেটিকে বলল। এই সময়ে এগিয়ে এল এক স্পষ্টভাষী খরগোশ। সে সবটা শুনে বলল, ‘বেশ তো, আমি প্রথম থেকে ব্যাপারটা যেভাবে ঘটেছে সেটা না দেখে মতামত দিতে পারব না।’ কুমির তাতে অখুশি হয়ে সজোরে প্রতিবাদ করার জন্য যেই না মুখ খুলেছে, অমনই ছেলেটি লাফ দিয়ে ডাঙায় উঠে এল।
শৈশবে আমি দাদিকে পাইনি, তবে আমার মা অনুরূপ একটি মজার গল্প বলেছিলেন, যেটা চূড়ান্ত বিশ্লেষণে প্রমাণ করে যে পৃথিবীতে আমরা সবাই আদম ও হাওয়ারই সন্তান:
ব্রাহ্মণ ঠাকুর সকালে জঙ্গলে ঢুকেই দেখতে পেলেন এক বাঘ। শিকারিদের পাতা ফাঁদে আবদ্ধ। বাঘ তাকে মুক্ত করার জন্য মিনতি জানালে ব্রাহ্মণ দয়াপরবশ হয়ে বাঘকে মুক্ত করে দিতেই সে ব্রাহ্মণকে দিয়ে সকালের নাশতা সারতে চাইল এবং যুক্তি দেখাল, ‘তোমাদের মনুষ্য সমাজে এটাই তো নিয়ম, তোমরা উপকারীর অপকার করে উপকারের শোধ দাও।’ ব্রাহ্মণ এটা মানতে রাজি না হওয়ায় তিনজন সালিসের রায় নেওয়ার মতৈক্যে পৌঁছা গেল। তো প্রথমে যাওয়া হলো এক বিরাট বৃক্ষের কাছে। বৃক্ষ সবটা শুনে বলল, ‘আমি মানুষকে ছায়া দিই, ফল-ফসল দিই, অথচ তোমরা আমার বুকের ভেতর দিয়ে করাত চালাও। বাঘ তোমাকে খাবে।’ এরপর এক গাভির কাছে গেলে গাভিও বলল, ‘আমি মানুষকে দুধ দিই, বাছুর দিই, সেই বাছুর বড় হয়ে হালচাষে সাহায্য করে। অথচ তোমরা আমাকে শান্তিতে মরতেও দাও না, একটু বয়স হলেই গলায় চাকু চালাও। বাঘের কথাই সঠিক।’
অতঃপর তৃতীয় সালিসের মতামতের আর তেমন প্রয়োজনই ছিল না। কিন্তু ব্রাহ্মণ মরিয়া হয়ে এক শিয়ালের কাছে যেতেই শিয়াল সবটা শুনে বলল, ‘আমি সরেজমিনে সবকিছু প্রত্যক্ষ না করে কিছু বলতে পারব না। যে যে অবস্থানে ছিলে সেখানে ফিরে যেতে হবে, তারপর আমি বুঝে-শুনে রায় দেব।’ বাঘ রাজি হয়ে ফাঁদের ভেতর ঢুকতেই শিয়াল ব্রাহ্মণকে পালিয়ে যেতে ইশারা করল। এভাবে বুঁদিয়াল বুদ্ধি প্রয়োগে বোকা মানুষটিকে বাঁচিয়ে দিল।
আতাউর রহমান: রম্য লেখক৷ ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক৷

No comments

Powered by Blogger.