শরণার্থীদের পাশে আমরা by জুলিয়ান ফ্রান্সিস

এই শরণার্থীদের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল অক্সফাম
আবারও ফিরে এল মার্চ, সঙ্গে নিয়ে এল জ্বলজ্বলে কিছু স্মৃতি। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে আমি অক্সফাম-যুক্তরাজ্যের অর্থায়নে ভারতের বিহারে গান্ধিয়ান গ্রাম উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করছিলাম। বিবিসি ও অন্যান্য সংবাদমাধ্যমের মারফত আমি ইতিমধ্যে ঢাকার অস্থিরতা সম্বন্ধে অবগত ছিলাম। শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কেও আমি তত দিনে জানতে পেরেছি। যদিও গয়ায় কাগজ আসত এক দিন পর।
মার্চের শেষ নাগাদ কী ঘটবে, সে সম্পর্কে কেউই তেমন একটা জানত না। ২৫ মার্চ রাতের পরই অক্সফামের রাঁচি, বিহার কার্যালয় ও অন্যান্য বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার টেলিগ্রাম মারফত জানতে পারি, পূর্ব পাকিস্তান থেকে বানের জলের মতো মানুষ প্রতিদিনই ভারতে ঢুকছে। এর পরই আমরা কয়েকজন সীমান্ত এলাকা সফরে যাই। অক্সফামের সদর দপ্তরে আমরা যে প্রতিবেদন পাঠাই, তা সেখানকার অনেকে বিশ্বাসই করতে পারেনি। একজন তো বলেই বসল, ‘জুলিয়ানের বয়স কম, অভিজ্ঞতাও অল্প। ও ভারতের প্রচারণায় ভেসে গেছে।’ প্রতিদিন শরণার্থীদের আগমন-সংক্রান্ত যে প্রতিবেদন আমরা অক্সফামের সদর দপ্তরে পাঠিয়েছি, তাতে তারা মনে করেছে যে আমরা প্রকৃত সংখ্যার ডান পাশে ভুলক্রমে একটি শূন্য লাগিয়ে দিচ্ছি।
অক্সফামের পূর্ব ভারত ও পাকিস্তানের সদ্য নিয়োজিত ফিল্ড ডিরেক্টর রেমন্ড কৌরনয়্যার বলেছিলেন, শরণার্থীর সংখ্যা ‘এক কোটির মতো’। তার পরও আমাদের সদর দপ্তর সংখ্যাটা বিশ্বাস করতে পারেনি। আমরা যারা বিহারে কাজ করতাম, রেমন্ড তাদের বললেন, তারা যেন কলকাতায় অক্সফামের দপ্তরে গিয়ে খোঁজ করে, আমরা এ বিষয়ে কী করতে পারি। গান্ধীবাদী সংগঠন সর্ব সেবা সংঘ ও গান্ধী পিস ফাউন্ডেশনের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। আমরা তাদের সঙ্গে কথা বললাম, আর অক্সফামের সহায়তার ব্যাপারে প্রস্তাব দিলাম। অন্য দাতা সংস্থাগুলো বিদেশ থেকে কর্মী উড়িয়ে আনছিল, কিন্তু আমরা ভাবলাম, যেসব ভারতীয় সংগঠন সম্পর্কে আমরা জানি, তাদের সঙ্গে কাজ করাই শ্রেয়। (সিদ্ধান্তটি শেষমেশ বিচক্ষণ প্রমাণিত হয়। কারণ, ভারত সরকার পরবর্তীকালে নিরাপত্তার কারণে সীমান্ত এলাকায় বিদেশিদের যাতায়াতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে)।
এ সময় অক্সফামই প্রথম মাদার তেরেসার প্রশিক্ষিত চিকিৎসাকর্মীদের কলকাতার কাছাকাছি শরণার্থী শিবিরগুলোতে যাতায়াতের ব্যাপারটি সমর্থন করে। যদিও এই সিদ্ধান্তটি অক্সফামের মনঃপূত হয়নি। কারণ, সাদা মানুষ এলে তারা সঙ্গে করে টাকা আনে। আবার তারা এলে কিছু প্রচারও হয়। মাদার তেরেসা সে সময় প্রতিদিন সকালে আমাকে ফোন করে ক্রয়তালিকা দিতেন আর কর্মীদের যাতায়াতের জন্য কয়টি ট্যাক্সি লাগবে, সেটাও বলতেন। অক্সফামের তখনো নিজস্ব গাড়ি ছিল না। ফোন ধরার পর তিনি কখনো ‘শুভসকাল’ বলতেন না, তিনি বলতেন, ‘ঈশ্বর তোমাকে আশীর্বাদ করুন’।
মে মাসের শেষের দিকে গান্ধীবাদী উন্নয়নকর্মী বিকাশ ভাই আমাদের সঙ্গে যোগ দেন। তিনি ছিলেন বিশালদেহী মানুষ, তাঁর ব্যক্তিত্বও ছিল ততোধিক বড়। তাঁকে আদর করে ডাকা হতো ‘হিজ হেভিনেস’ বলে। আমার মনে আছে, অক্সফাম ল্যান্ডরোভার পাঠানোর আগে আমরা একটি পুরোনো উইলিস জিপ কিনেছিলাম। বিকাশ সেটা নিয়ে প্রায়ই বের হতেন।
আমরা এটা বুঝলাম যে অধিকাংশ দাতা সংস্থাই কলকাতার কাছাকাছি অবস্থিত শরণার্থী শিবিরগুলোতে কাজ করছে। তাই আমরা অক্সফামকে প্রস্তাব করলাম, আমরা দূরের শিবিরগুলোতে কাজ করি। সে সময় কলেরার মারাত্মক হুমকি ছিল। ফলে ভারতীয় চিকিৎসা দলগুলোকে কীভাবে সংগঠিত করা হবে এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ কীভাবে নিশ্চিত করা হবে, সেটা নিয়েই আমরা ভাবিত ছিলাম। বিকাশ ভাই আমাদের জানান, ডাকসাইটে গান্ধীবাদী নেতা নারায়ণ দেসাইয়ের মেয়ে সংঘমৈত্র দেশাই (উমা) কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করছেন। আমরা তাঁর সঙ্গে দেখা করি।
আমার মনে আছে, কী আগ্রহ ও উদ্দীপনা নিয়ে উমা ও তাঁর সহপাঠীরা শরণার্থী শিবিরে মেডিকেল ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণের অনুমতি জোগাড় করেন। এমনকি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁদের এই অংশগ্রহণকে এমবিবিএস কোর্সের সামাজিক ও প্রতিরোধমূলক ওষুধ কোর্সের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। উমার বিরামহীন কাজের ফলে কলকাতার অন্যান্য মেডিকেল কলেজও মেডিকেল দল পাঠাতে সম্মত হয়। জুনের শেষের দিকে অক্সফাম ত্রিপুরায়ও তার কাজ বিস্তৃত করে। স্বেচ্ছাসেবীর প্রয়োজনীয়তাও ছিল অনিঃশেষ। ভারতের অন্যান্য স্থান থেকেও মেডিকেল দল আসতে শুরু করে।
গান্ধীবাদী নানা সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক পাঠাতে থাকে। এই স্বেচ্ছাসেবকেরা শরণার্থী শিবিরগুলোতে প্রাণের সঞ্চার করে। তারা সেখানে স্কুল স্থাপন করে। সাপ্তাহিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, বিশেষত গানের অনুষ্ঠান। তারা নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা অভিযান ও খাওয়ানোর কাজও জারি রাখে।
এই তরুণেরা সত্যিই এক কঠিন কাজে অবতীর্ণ হয়, এ কাজ খুব ক্লান্তিকরও বটে। সে বছর বর্ষাও আসে আগেভাগে, আবার বৃষ্টিও হয়েছে প্রচুর। ফলে শিবিরগুলোর অবস্থা খারাপ হয়। কলেরা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য বিভাগের মহাপরিচালক আমাকে ফোন করে অনুরোধ করেন, আমি বিদেশ থেকে কলেরার টিকা আনিয়ে দিতে পারব কি না, যাতে কলকাতার আশপাশে আপৎকালীন টিকা অঞ্চল গড়ে তোলা যায়। অক্সফাম এক মিলিয়ন ডোজ কিনে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তা কলকাতায় পাঠাতে সক্ষম হয়।
ওদিকে সীমান্তেও অক্সফাম গণকলেরার টিকা প্রদানের ব্যবস্থা করে। উচ্চচাপে ‘প্যানজেট’ ও ‘পেডোজেট’-এর মাধ্যমে ইন্ট্রা ডারমাল স্প্রে ব্যবহার করে এই টিকা প্রদান করা হয়েছে। আরেকটি সমস্যা ছিল তখন, কলেরা রোগীদের চিকিৎসার জন্য শিরাভ্যন্তরীণ স্যালাইনের বোতলের অভাব ছিল। কলকাতায় নিরাপদে স্যালাইন বানানো যেত, কিন্তু যথেষ্ট পরিমাণে খালি বোতল ছিল না। সে কারণে অক্সফাম যুক্তরাজ্য থেকে বিমানে বোঝাই করে বোতল এনে সেগুলো রিসাইকেল করে ব্যবহার করতে থাকে। স্যালাইন না থাকলে চিকিৎসকদের দেখেছি ডাবের পানি ব্যবহার করতে। এরপর শিবিরগুলোতে আরেক মহামারি ছড়িয়ে পড়ে, কনজাঙ্কটিভাইটিস। সে সময় এটাকে ‘জয় বাংলা’ বলা হতো। ফলে যুক্তরাজ্য থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন টিউব ওষুধ আনা হয়েছে।
প্রাথমিকভাবে অক্সফাম পাঁচ লাখ শরণার্থীকে সেবা দেয় (এক কোটির মধ্যে)। ত্রিপুরা, মেঘালয়, আসাম, কোচবিহার, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, পশ্চিম দিনাজপুর, বালুরঘাট, বনগাঁও ও বারাসাতে অক্সফাম এ সেবা দেয়। নভেম্বরের শেষের দিকে সেই সংখ্যাটা ছয় লাখে উন্নীত হয়।
সে সময়ের বহু ব্যক্তিগত স্মৃতি এখনো আমার হৃদয়ের মণিকোঠায় জ্বলজ্বল করছে:
জলপাইগুড়িতে কলেরায় মারা যাওয়া শরণার্থীর জন্য কবর খুঁড়েছি।
সে বছর প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তার পরও শরণার্থীরা যে মর্যাদাবোধ নিয়ে তাদের শিবিরগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রেখেছে, তা আমার মনে আছে। এই ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে অক্সফামকে উভচর যান ব্যবহার করতে হয়েছে।
আমার যে ৩৬ জন কর্মী ছিল, তাদের বেশির ভাগই ছিল সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আসা শরণার্থী। এদের অনেকেরই পরিবারের সদস্য আসার পথে হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছে। আমার অন্য কর্মীরা ছিল পশ্চিম বাংলার, যাদের আবার পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল।
আমার মনে আছে, ১ লাখ ২৫ হাজার শাড়ি, সমসংখ্যক লুঙ্গি, গেঞ্জি ও শিশুদের বিভিন্ন আকারের সাড়ে তিন লাখ জামা কিনেছি। বাণিজ্যিক দিক থেকে এটা ছিল দুঃস্বপ্নের মতো, কিন্তু আমরা সেটা অর্জন করতে পেরেছিলাম।
অক্সফাম কীভাবে মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির শরণার্থী শিবির সফর সহজ করেছে, তা আমার মনে আছে। এই সফরের প্রভাবও ছিল দারুণ।
ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের বিবৃতি সংগ্রহে আমি সহযোগিতা করেছি। এসব বিবৃতি অক্সফামের হৃদয়গ্রাহী প্রকাশনা এ টেস্টিমনি অব সিক্সটিতে সংকলিত হয়েছে।
১৯৭১-৭২ সালের শীতের কথা আমার স্মরণে আছে। আমরা শরণার্থীদের কম্বল ও কাপড় সরবরাহ করেছি।
যুদ্ধের পুরো সময়েই অক্সফাম দামি বিদেশি উপকরণ না এনে ভারতের মধ্য থেকেই সব সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছে। আমরা ভারতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখার চেষ্টা করেছি, যতটা সম্ভব। টনের পর টন ব্লিচিং পাউডার ও খোসপাঁচড়ার জন্য হাজার হাজার লিটার অ্যাস্কাবিয়ল কিনতে হয়েছে। কলকাতায় এসব জিনিসের চাহিদা সব সময়ই ছিল। ফলে কলকাতার ব্যবসাও ছিল সরগরম।
জুলিয়ান ফ্রান্সিস: উন্নয়ন পরামর্শক। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নকাজে যুক্ত রয়েছেন। ‘মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু’ পুরস্কারে ভূষিত। যুক্তরাজ্যের নাগরিক।

No comments

Powered by Blogger.