নর-নারীর সমান অধিকার by এবনে গোলাম সামাদ

বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির -কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর
মানুষ স্তন্যপায়ী প্রাণী। নারী তার গর্ভে সন্তান ধারণ করে। পুরুষ করে না। মাতৃদুদ্ধ পান করে বাঁচে মানবশিশু। মায়ের ওপর তারা নির্ভর করে খাদ্যের জন্য। কেবল খাদ্যের জন্যই নয়, মানসিক পুষ্টির জন্যও। মায়ের অনুপস্থিতিতে কেঁদে ওঠে সন্তান। কিন্তু বাবার অনুপস্থিতিতে এতটা কান্নাকাটি করে না। সন্তানের ভালোবাসাতেই মা আটকা পড়ে গৃহকর্মে। যদিও এখন বলা হচ্ছে, পুরুষ শাসিত সমাজে মেয়েরা বাধ্য হয় গৃহকর্মে লিপ্ত থাকতে। নারী-পুরুষের মধ্যে আরো অনেক বিষয়ে পার্থক্য আছে। যেমনÑ গড়পড়তা পুরুষ যতটা ভার উত্তোলন করতে পারে, মেয়েরা তা পারে না। পেশিশক্তিতে ছেলেরা মেয়েদের চেয়ে অনেক বেশি মতাসম্পন্ন। এই পার্থক্য নারী-পুরুষের মধ্যে এনে দিয়েছে শ্রমবিভাজন। যাতে বেশি কায়িক শক্তি প্রয়োজন হয়, সেসব কাজ করেছে ছেলেরা, মেয়েরা তা করেনি। যেসব সমাজ এখনো পড়ে আছে আদিম জীবনধারায়, সেখানে মেয়েদের দেখা যায় গৃহকর্মে নিযুক্ত থাকতে। কিন্তু ছেলেরা যায় বনেজঙ্গলে শিকার করতে। যেসব সমাজে মানুষ প্রধানত মৎস্যজীবী, সেখানে নৌকা করে ছেলেদের দেখা যায় দূর সমুদ্রে মাছ ধরতে। কিন্তু মেয়েরা থাকে ঘরে, যায় না দূর সমুদ্রে মাছ ধরতে। নর-নারীর শ্রমবিভাজনকে তাই বলা যায় না পুরুষ ষড়যন্ত্রের ফল। এর আছে একটি বাস্তব দৈহিক ভিত্তি। যেটাকে বিবেচনায় না নিলে ভুল করা হয়।
মানসিক দিক থেকেও নর-নারীর মধ্যে পার্থক্য পরিলতি হয়। যেমন গড়পড়তা মেয়েদের সৌন্দর্যচেতনা ছেলেদের চেয়ে বেশি। তাই তারা ঘরদোর অনেক সুন্দর করে গুছিয়ে রাখতে পারে। ছেলেরা যা পারে না। সব দেশেই গড়পড়তা মেয়েরা ফুলদানিতে ছেলেদের তুলনায় সুন্দর করে ফুল সাজাতে পারে। মেয়েদের বর্ণসমাবেশের প্রবণতা ছেলেদের তুলনায় হতে দেখা যায় উন্নত। তাই তারা সেলাইয়ের কাজে নানা রঙের সুতা দিয়ে অনেক সহজে সেলাই করতে পারে, নানা রঙের ফুলের নকশা। এ ছাড়া ছেলে-মেয়ের মধ্যে আরো অনেক জন্মগত পার্থক্য আছে। যেমনÑ মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় কথা বলতে শেখে অনেক তাড়াতাড়ি। গড়পড়তা মেয়েরা তাদের জীবনে ছেলেদের চেয়ে বেশি কথা বলে থাকে। ছেলেরা মেয়েদের চেয়ে কম দিন বাঁচে। কিন্তু মেয়েদের জীবনে বার্ধক্য আসে তাড়াতাড়ি। পৃথিবীতে তাই বৃদ্ধের তুলনায় বৃদ্ধার সংখ্যা হতে দেখা যায় বেশি।
এসব পার্থক্য পরিবেশগত কারণে ঘটে না। এসব পার্থক্য হলো জন্মগত।
মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় কম খেয়ে বাঁচে, কেননা তাদের শরীর থেকে তাপ ছড়ায় কম। কিন্তু ছেলেরা মেয়েদের মতো অত কম খেয়ে বাঁচতে পারে না। কারণ তাদের দেহ থেকে তাপ ছড়ায় বেশি। তাদের দেহে তাপ ধরে রাখবার মতো চর্বির স্তর থাকে না। মেয়েরা যত কম খেয়ে যত কাজ করতে পারে, পুরুষেরা তাই তা পারে না। এসব পার্থক্যকে ভুলে গিয়ে নর-নারীর সমান অধিকারের কথা ভাবতে গেলে ভুল করা হয়। এসব কথা আমার মনে হচ্ছিল ক’দিন আগে নারী দিবস উপলে প্রকাশিত বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার ক্রোড়পত্র পড়ে। যাতে আলোচিত হয়েছিল মেয়েদের অধিকার নিয়ে অনেক কথা। আর বলা হয়েছিল পুরুষ শাসিত সমাজে মেয়েদের অধিকারবঞ্চনার কথা। কিন্তু মেয়েরা কি পুরুষের মতো সব কাজ করতে সম? না পুরুষেরাই মেয়েদের মতো সব কাজে দেখাতে পারেন একই রকম পারদর্শিতা। সব দেশেই দেখা যায় মেয়েরা ছোট ছেলেমেয়েকে যেভাবে লেখাপড়া শেখাতে পারছেন, ছেলেরা সেটা পারছেন না। অনেক দেশে তাই প্রাথমিক শিার ব্যাপারে মেয়ে শিককে পুরুষ শিকের চেয়ে দেয়া হচ্ছে অগ্রাধিকার। এই বৈষম্য করা হচ্ছে নারী-পুরুষের পার্থক্যকে নির্ভর করে। প্রাথমিক শিায় অর্থাৎ লিখতে, পড়তে ও গুনতে শেখার েেত্র প্রয়োজন হয় যথেষ্ট ধৈর্যের। যেটা মেয়েরা পারেন অনেক সহজে ধারণ করতে। ছেলেরা নয়।
আমাদের দেশে মেয়েরা এখন রাজনীতি নিয়ে খুব বেশি মাতামাতি করছেন। যেটা আগে ছিল না। এ প্রসঙ্গে ভারতের এককালের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কিছু উক্তি উদ্ধৃত করা যেতে পারে। ইন্দিরা গান্ধী বলেছেন, ‘এই কাজের (প্রধানমন্ত্রিত্বের) ব্যাপারে আমি নিজেকে নারী হিসেবে চিন্তা করি না। কোনো নারীর যদি যেকোনো পেশার জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা থাকে, তবে তাকে সেই পেশায় কাজ করার সুযোগ দেয়া উচিত।... আমি নারীবাদী নই, আমি একজন মানবসন্তান। যখন আমি নিজের কাজ করি, তখন নিজেকে নারী হিসেবে চিন্তা করি না।...’ কিন্তু আমাদের দেশে মেয়েরা দাবি করছেন এমপি হওয়ার জন্য সংরতি আসন। যেটা নর-নারীর সমান অধিকারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে করা যায় না। জার্মানিতে অ্যাঞ্জেলা মার্কেল চ্যান্সেলর হয়েছেন পুরুষদের সাথে ভোটে প্রতিযোগিতায় জিতেই। আর তিনি তার কাজে পরিচয় দিতে পারছেন যথেষ্ট দতার।
অনেকের ধারণা, মেয়েরা গৃহকাজে আটকা থাকে বলে অন্য কাজে রাখতে পারে না দতার স্বার। কিন্তু এ ধারণাকেও আমি যথেষ্ট সঙ্গত বলে মনে করি না। অনেক নারী গৃহকর্ম করেও হতে পেরেছে যথেষ্ট খ্যাতিমান। এ েেত্র আমার মনে পড়ে, মারি স্লোভদয়াস্কা কুরির (১৮৬৭-১৯৩৪) কথা। মারি কুরি ছিলেন পোল্যান্ডের মেয়ে। তিনি ফ্রান্সে আসেন লেখাপড়া শিখতে। বিয়ে করেন পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক পিয়ের কুরিকে। তারা দু’জন রেডিয়াম ধাতু আবিষ্কার করেন। রেডিয়াম নিয়ে গবেষণা করে লাভ করেন বিশ্বখ্যাতি। পিয়ের কুরি ও মারি কুরি নবেল প্রাইজ লাভ করেন ১৯০৩ সালে। পিয়ের কুরি হঠাৎ মারা যান পারিতে রাস্তায় গাড়িচাপা পড়ে। রেখে যান দুই শিশুকন্যাকে। মারি কুরি এদের রান্না করে খাইয়ে ঢুকতেন ল্যাবরেটরিতে গবেষণার কাজে। রেডিয়াম নিয়ে গবেষণা করে পরে তিনি রসায়ন শাস্ত্রে একা লাভ করেন নবেল প্রাইজ, ১৯১১ সালে। এ ছিল তার বিরাট কৃতিত্ব। তিনি দেখাতে সম হন যে, তেজস্ক্রিয় রেডিয়াম পরমাণুরা বিশেষ হারে ভেঙে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত পরিণত হয় সিসার পরমাণুতে। ঘর সামলেও এ রকম গবেষণা করার নজির খুব কমই আছে। তবে এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, শিশুসন্তানদের রান্না করে খাইয়েও খুব উন্নত মানের বৈজ্ঞানিক গবেষণা করা সম্ভব। এখানে আরো উল্লেখ করা যেতে পারে, তার দুই কন্যার মধ্যে এক কন্যা, আইরিন জোলিয় কুরি তার স্বামী জোলিয় কুরির সাথে পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণা করে নবেল প্রাইজ লাভ করেন ১৯৩৫ সালে। আইরিন জোলিয় কুরিও সাংসারিক কাজে অবহেলা করেননি। তিনিও ছিলেন তার মায়ের মতো গৃহকর্মে নিষ্ঠাবান। এ রকম দৃষ্টান্ত অবশ্য খুবই বিরল, কিন্তু আছে। ইউরোপ ও আমেরিকায় নারীরা লেখাপড়া জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় অনেক এগিয়ে গেছেন। তথাপি যে ছেলেদের সমক হতে পেরেছেন, তা নয়। প্রতি বছর মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় খুব কম েেত্রই নবেল প্রাইজ লাভ করে থাকেন। নবেল প্রাইজ অবশ্য জ্ঞানবিজ্ঞানের মাপকাঠি নয়। তবুও এর দ্বারা সাধারণভাবেই নারী-পুরুষের অর্জনের কিছুটা মূল্যায়ন করা চলে। মেয়েরা ছেলেদের মতো নবেল প্রাইজ পাচ্ছেন না বলেই যে তারা ছেলেদের চেয়ে গড়পড়তা বুদ্ধিতে কম, এ রকম সিদ্ধান্তে আসা যায় না। তবু পার্থক্যটা ল করবার মতো। এ পর্যন্ত সাহিত্যে মহিলারা তেরোজনের বেশি নবেল প্রাইজ পেয়েছেন বলে আমাদের জানা নেই। এটাকে নিশ্চয় পুরুষ শাসিত সমাজের একটি ষড়যন্ত্রের ফল বলে চিহ্নিত করা চলে না। খোলাধুলার েেত্রও দেখা যাচ্ছে নর-নারীর পার্থক্য। অলিম্পিকে ছেলেমেয়েদের প্রতিযোগিতা হচ্ছে এখনো আলাদা করে; একত্রে নয়। এটাকেও বলা চলে না পুরুষ ষড়যন্ত্রের ফল। নর-নারীর সমান অধিকারের প্রশ্নকে তাই বিচার করতে হবে এসব পার্থক্যের কথা বিবেচনা করেই।
ইসলামে মেয়েদের ব্যবসা-বাণিজ্য করার অধিকার দেয়া হয়েছে (আল কুরআন, সূরা ৪: ৩২)। বলা হয়নি তারা ব্যবসা-বাণিজ্য করার যোগ্যতা রাখেন না। রাজনীতি করার েেত্র সরাসরি কিছু না বলা হলেও আল কুরআনে সাবার রানী বিলকিসের খুব প্রশংসা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তিনি ছিলেন শাসক হিসেবে যোগ্যতাসম্পন্না এবং দেশ শাসন করতেন দেশবাসীর সাথে পরামর্শ করে, স্বেচ্ছাচারিতা করে নয় (সূরা ১৭ : ৩২)। বিলকিসের মতো রানী ইতিহাসে খুব বেশি নেই। কিন্তু কুরআনে বলা হয়নি মেয়েরা দেশ শাসনে যোগ্যতা রাখেন না। তবে মেয়েদের মধ্যে যোগ্য শাসক সচরাচর পাওয়া যায় না। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী গণতন্ত্র হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু এ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোনো মহিলা প্রেসিডেন্টের পদ অলঙ্কৃত করতে পারেননি। এখনো বিশ্বে সাধারণভাবে মনে করা হয়, মেয়েদের পে রাজনীতি সামাল দেয়া হলো যথেষ্ট কঠিন কাজ।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.