দুর্নীতির মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে নারী: টিআইবি

প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতিতে নারীরা মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হচ্ছেন। নারীকে ব্যবহার করে এনজিও, ব্যাংকঋণ বা দাদনের টাকা আত্মসাৎ, ইউনিয়ন ভূমি অফিসে নারীকর্মীদের মাধ্যমে অবৈধ অর্থ আদায় এবং উন্নয়ন কমিটির সভাপতি হিসেবে খালি চেকে স্বাক্ষর নেয়া হয়। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায় এমন অভিযোগচিত্র এসেছে। সম্প্রতি জামালপুর ও গাজীপুরের দুটি ইউনিয়নে নারীদের দুর্নীতির অভিজ্ঞতা নিয়ে গবেষণা করে টিআইবি। গতকাল টিআইবির কনফারেন্স রুমে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। টিআইবির সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম আকরাম প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন। এতে বলা হয়, নারীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দুর্নীতির অভিজ্ঞতা লাভ করেন। এর মধ্যে দুর্নীতির শিকার, সংঘটক ও মাধ্যম হিসেবে নারীর সঙ্গে দুর্নীতির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা (পুলিশ), এনজিও, বিচারিক সেবা, ভূমি, ব্যাংক, পল্লী বিদ্যুৎসহ ইত্যাদি সেবা খাতে সেবা নিতে গিয়ে নির্ধারিত মূল্যের অতিরিক্ত অর্থ জোর করে আদায়, প্রতারণা, স্বজনপ্রীতি ও দায়িত্বে অবহেলার মতো দুর্নীতির শিকার হয়ে থাকেন নারীরা। এ ছাড়া এসব খাতে নারীদের জন্য বিশেষায়িত সেবা, যেমন প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, ভিজিডি, ভিজিএফ, মাটি কাটার কাজ, নারী নির্যাতন মামলা, উপবৃত্তি ইত্যাদি গ্রহণ করার সময় দুর্নীতির শিকার হন নারী। ইউনিয়ন পরিষদের নারী সদস্য হিসেবে উন্নয়ন বরাদ্দ, বাজেট প্রণয়ন ও সালিশ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ এবং উন্নয়ন কর্মসূচি তদারকিতে তাদের অংশগ্রহণে বাধা দিতে দেখা যায়। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে পরিষদের পুরুষ সদস্যদের দ্বারা শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ারও উদাহরণ রয়েছে। সেই সঙ্গে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নারী কোটায় নিয়োগ, পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে টার্গেট পূরণের জন্য রোগী কেনা, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের অধীনে গাছ পাহারা দেয়ার কাজ, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সেবা নিতে গিয়েও নারীদের দুর্নীতির শিকার হতে হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সেবাদানকারীর অবস্থানে থেকে নারীদের একটি অংশের দুর্নীতিতে সংঘটক হিসেবে জড়িত থাকার চিত্র পাওয়া যায় গবেষণায়। এ ছাড়া গবেষণা এলাকায় প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির অংশ হিসেবে নারীদের অনৈতিকভাবে ব্যবহার করার চিত্র পাওয়া যায়। ইউনিয়ন পরিষদে উন্নয়ন কমিটির সভাপতি হিসেবে খালি চেকে নারী সদস্যদের স্বাক্ষর আদায় করা হয় আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে। পারিবারিক পর্যায়ে নারীকে ব্যবহার করে এনজিওর ক্ষুদ্রঋণ, ব্যাংকঋণ বা দাদনের টাকা আত্মসাৎ করার উদাহরণ রয়েছে। এ ছাড়া ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ে, উপজেলা স্বাস্থ্য কার্যালয়ে, উপজেলা হিসাবরক্ষণ কার্যালয়ে এবং ব্যাংকে সংশ্লিষ্ট নারীকর্মীর মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্থ আদায় করা হয়, যার প্রতিটি ক্ষেত্রে এসব অর্থ আদায় দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের ফলাফল। সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, যারা সংখ্যালঘু নারী তারা দ্বিমাত্রিক, ত্রিমাত্রিক নানা পর্যায়ে নানা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। নারী যে অবস্থানেই থাকুক না কেন তার অধিকারের সম্মানজনক স্বীকৃতি দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, যারা ক্ষমতায় যান তারা ভুলে যান ক্ষমতার সঙ্গে মর্যাদার সম্পর্কের কথা সেজন্যই ক্ষমতার অপব্যবহার হয়। ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে ক্ষমতার সঙ্গে মর্যাদার বিষয়টি সংযুক্ত করতে হবে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের ফলে যারা দুর্নীতি করেন তারা বিচারের আওতায় আসে না বা এলেও সঠিক বিচার হয় না। সেটারই এক ধরনের প্রভাব নারীর ওপর পড়ে, ফলে নারী যে কেবল দুর্নীতির শিকার হচ্ছেন তা নয় বরং তিনি দুর্নীতি মেনে নিচ্ছেন, দুর্নীতির কারণে বঞ্চিত হচ্ছেন এবং কোন কোন ক্ষেত্রে নিজেরাও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন টিআইবির উপ-নির্বাহী পরিচালক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান।

No comments

Powered by Blogger.