অসহায়- অনড় দু’পক্ষ, বিপর্যস্ত শিল্প খাত

রাজনৈতিক অস্থিরতায় পুড়ছে দেশ। হরতাল-অবরোধে বিপর্যস্ত জনজীবন। নুইয়ে পড়েছে অর্থনীতি। শঙ্কিত ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা। সম্ভাবনাময় দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে দেখা দিয়েছে নেতিবাচক প্রভাব। টানা অবরোধ ও হরতালে ভেঙে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। এর প্রভাব পড়েছে পুরো সেবাখাতে। হাসপাতাল ও চিকিৎসা সেবা বিঘ্ন ঘটছে। লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়েছে শিক্ষাসূচি। পরিবহন খাতে স্থবিরতা নেমে আসায় বেকার হয়ে পড়েছেন কয়েক লাখ শ্রমিক। অন্যদিকে রাজনৈতিক কর্মসূচি চলাকালে সহিংসতা ও দমনপীড়নে বাড়ছে মৃত্যু, বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা। পেট্রলবোমা ও ককটেলে অগ্নিদগ্ধদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠছে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিট। দেশজুড়ে ব্যাপক ধরপাকড় ও দমনপীড়নে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিগৃহীত হচ্ছেন বিরোধী জোটের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও কর্মসূচিতে দেশ গভীর সঙ্কটে পড়লেও এখনও অনড় দুই রাজনৈতিক জোট। তাদের পাল্টাপাল্টি অবস্থানে শঙ্কা বাড়ছে সর্বত্র। বাড়ছে উদ্বেগ-আতঙ্ক। এমন অবস্থায় ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ান তুলে ধরে শিল্প ও বণিক সংগঠনগুলো দুই জোটের মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতার আহবান জানিয়ে আসছে। পোশাক শিল্প মালিক ও শ্রমিকদের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। সমঝোতার দাবিতে অনশনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন সাবেক দুই প্রেসিডেন্ট। সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক দল ও পক্ষের কাছ থেকে অব্যাহতভাবে সংলাপের আহবান এলেও তা আমলে নেয়া হচ্ছে না সরকারের তরফে। এমন অবস্থায় অসহায় সময় পার করছে দেশের মানুষ।
৫ই জানুয়ারি বিরোধী জোটের সমাবেশকে ঘিরে ৪ঠা জানুয়ারি সরকারের দেয়া অঘোষিত অবরোধের দিন থেকে গতকাল পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় অন্তত ৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে সংঘর্ষে মারা গেছেন ১০ জন। পেট্রলবোমা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মারা গেছেন ১৭ জন। অন্যান্য ঘটনায় মারা গেছেন আরও ৯ জন। এ ক’দিনে সারা দেশের সড়ক মহাসড়কে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে সাড়ে সাতশ যানবাহনে। বেশ কয়েক দফায় নাশকতার শিকার হয়েছে রেল। এসব ঘটনায় ট্রেনের শিডিউল বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর হিসেবে হরতাল অবরোধে দৈনিক ক্ষতি আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি হবে। এর মধ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ৬৯৫ কোটি টাকা, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ৩০০ কোটি টাকা, কৃষিখাতে ২৮৮ কোটি ১০ লাখ টাকার ক্ষতি হচ্ছে প্রতিদিন।
মামলা ও গ্রেপ্তার
অবরোধ ও হরতালের সমর্থনে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভ মিছিল করেছে ২০ দল। অবরোধকে কেন্দ্র করে নৈরাজ্যের ঘটনায় রাজশাহীর চারঘাটে বিএনপি-জামায়াতের ১৫ নেতাকর্মীর নামে একটি, ঝালকাঠি জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম নূপুর ও জেলা জামায়াতের আমীর হাফিজুর রহমানসহ ১৫ জনকে আসামি করে ঝালকাঠিতে একটি এবং বরিশাল বাকেরগঞ্জের সাবেক এমপি ও বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আবুল হোসেন খানসহ ৩৫ জনকে আসামি করে বরিশালে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করেছে পুলিশ। এদিকে রোববার রাত থেকে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত  বগুড়া জেলা যুবদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আদিল শাহরিয়ার গোর্কি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক আলী আজম, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) শাখা ছাত্রদলের সভাপতি ওমর ফারুক, গজারিয়া উপজেলা শ্রমিক দলের সহ-সভাপতি আবুল হোসেন সরকার, গৌরীপুর পৌরসভার বিএনপি দলীয় সাবেক মেয়র খালেক মুন্সী, রাজশাহীর চারঘাট উপজেলা জামায়াতের আমীর ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান নাজমুল হক কচি, ফেনী শহর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি ও শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের সভাপতি মোহাম্মদ ইলিয়াছ, মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি মুজিবুর রহমান আজিজি, সাভার থানা জামায়াতের সহসম্পাদক লুৎফর রহমানসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১১০, রংপুরে ৫৯, যশোরে ৫৬, পাবনায় ৪২, রাজধানীতে অন্তত ৪০, গাইবান্ধায় ২০, বগুড়ায় ২০, চাঁপাই নবাবগঞ্জে ১৫, কুমিল্লায় ১৪, মানিকগঞ্জে ১১, চাঁদপুরে ১০, মেহেরপুরে ৯, দিনাজপুরে ৯, সিরাজগঞ্জে ৬, নোয়াখালীতে ৬, রাজশাহীতে ৩, হবিগঞ্জে ৩ সহ সারা দেশে অন্তত ৫৫০ বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরসহ ২০ দলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ২৮শে জানুয়ারি বুধবার সকাল ৬টা থেকে রাজশাহী বিভাগে ২৪ ঘণ্টার হরতালের ডাক দিয়েছে স্থানীয় বিএনপি। এদিকে অবরোধ ও হরতালের সমর্থনে রাজধানীতে মিছিল করেছে ছাত্রদল। কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক মেহবুব মাসুম শান্ত, হাসানুল বান্না ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আমির আমজাদ মুন্নার নেতৃত্বে শাহবাগ, ঢাবি ছাত্রনেতা বাপ্পু সরকার ও শুভ্র দাসের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে উত্তরায় একটি মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। ওদিকে রাজধানীর তিতুমীর কলেজ ছাত্রদলের দপ্তর সম্পাদক জামিলকে পুলিশ গ্রেপ্তারের পর আর কোন খোঁজ মিলছে না বলে অভিযোগ করেছে ছাত্রদল। গতকাল সংগঠনের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক আবদুস সাত্তার পাটোয়ারী এ অভিযোগ করেন।
বিপর্যস্ত শিল্পখাত
টানা অবরোধ আর হরতালে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে দেশের শিল্প খাত। দিনের পর দিন পণ্য ও কাঁচামাল পরিবহন বাধাগ্রস্ত হওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে উৎপাদন ও বিপণনে। রপ্তানি নির্ভর শিল্পে নেমে এসেছে বড় ধরনের বিপর্যয়। বাতিল হয়ে যাচ্ছে রপ্তানি আদেশ। এতে বিপাকে পড়েছেন উদ্যোক্তারা। এমন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন শিল্পে জড়িত কর্মীদের মাঝে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। ছাঁটাই আতঙ্কে আছেন কিছু প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। শিল্প ও বণিক সংগঠনগুলো হরতাল অবরোধে ক্ষতি পরিমাণ তুলে ধরে জানিয়েছে দিনেই অন্তত ক্ষতি হচ্ছে দুই হাজার কোটি টাকা। সার্বিক বিবেচনায় এ ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি হবে। এছাড়া দীর্ঘ মেয়াদে যে ক্ষতি হচ্ছে তার পরিমাণ সীমাহীন। এভাবে পরিস্থিতি চলতে থাকলে দেশের শিল্প বাণিজ্য ভয়াবহ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে।
বিল্লাল হোসেন রবিন, নারায়ণগঞ্জ থেকে জানান, টানা অবরোধের কারণে নারায়ণগঞ্জের গার্মেন্টস শিল্পে লোকসানের পাল্লা ভারি হচ্ছে। এতে দৈনিক ক্ষতির পরিমাণ ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু নিট শিল্পে প্রতিদিন ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। তার ওপর কমে গেছে নতুন করে অর্ডার। সময় মতো শিপমেন্ট করা যাচ্ছে না। এভাবে চলতে তাকলে ধস নেমে আসবে এই সেক্টরে। এমন আশঙ্কা করছেন নিট গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ। এই সংগঠনের নেতৃত্বে শুধু নারায়ণগঞ্জেই ৫ শতাধিক নিট গার্মেন্টস রয়েছে। ওদিকে নারায়ণগঞ্জে দেশের অন্যতম সুতার বাজারেও ধস নেমে এসেছে। লেনদেন নেমে এসেছে অর্ধেকে। এছাড়া ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের নেত্বতাধীন ৫০টি সংগঠনের মাধ্যমে পরিচালিত শিল্প-কলকারখানা।
শতভাগ রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস রূপসী গ্রুপ অব ইন্ড্রাস্টিজের নির্বাহী পরিচালক আল আমিন চৌধুরী জানান, নতুন করে তাদের কোন অর্ডার নেই। বর্তমানে তিন জন বায়ারের ১ লাখ ৭০ হাজার পিস গেঞ্জির তিনটি শিপমেন্ট আটকে আছে। ৩১শে জানুয়ারির মধ্যে শিপমেন্ট করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে শিপমেন্ট করতে না পারলে নিরুপায় হয়ে বিমানে পাঠাতে গেলে কোটি টাকার ওপরে লোকসান গুনতে হবে।
গার্মেন্ট মালিকরা জানিয়েছেন, এমনিতেই রানা প্লাজা ধস, তাজরীন গার্মেন্টে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড এবং গত বছরের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের আগে সৃষ্ট সহিংসতায় পোশাক খাতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। একের পর এক দুর্ঘটনায় বিদেশী ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশের পোশাক নিয়ে এক ধরনের অনাস্থা তৈরি হয় তখন। কিন্তু উদ্যোক্তা, পোশাক খাতে কর্মরত শ্রমিক এবং সংশ্লিষ্টদের প্রচেষ্টায় আবারও ঘুরে দাঁড়ায় পোশাক খাত। এমনকি পোশাক রপ্তানিতে দ্বিতীয় স্থান অর্জনকারী বাংলাদেশ এবার প্রথম হওয়ার লড়াইয়ে মাঠে নেমেছে। কিন্তু দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি যদি এমন সংঘাতময় থাকে তবে এ লড়াইয়ে একদিকে যেমন পিছিয়ে যাবে, তেমনি ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়বে এ খাতটি। আর এ পরিস্থিতিকে পোশাক খাতের জন্য হুমকি বা অশনি সংকেত বলে তারা মনে করছেন।
গার্মেন্টস মালিকরা আরও জানান, একদিনের হরতালে নারায়ণগঞ্জের নিট শিল্পে উৎপাদন ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কম হয়। ব্যাহত হয় কাঁচামাল আমদানি। এক ঘণ্টা দেরি হলে তৈরী পোশাক জাহাজীকরণ করা যদি সম্ভব না হয় সেক্ষেত্রে রপ্তানি কার্যক্রমে অতিরিক্ত ঝুঁকি বাড়ে। এ জন্য কয়েকগুণ বেশি ব্যয়ে আকাশপথে ক্রেতাদের কাছে পণ্য পৌঁছে দিতে হয়। এমনকি অর্ডারও বাতিল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
বিকেএমইএর সহসভাপতি (অর্থ) জিএম ফারুক জানান, অবরোধের কারণে প্রতিদিন ক্ষতির পরিমাণ ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে নিট সেক্টরে ক্ষতির হচ্ছে দৈনিক প্রায় ২০০ কোটি টাকা। আগামী সামারের যে অর্ডার তা বায়াররা দিচ্ছে না। তারা নানা তালবাহানা করছে। যেমন অবরোধের মধ্যে অর্ডার দিলে সময়মতো অর্ডার ডেলিভারি পাবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছে তারা। নতুন অর্ডারগুলো আটকিয়ে দিয়েছে। শতভাগ অর্ডার এই মুহূর্তে (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি) প্লেস হওয়ার কথা। সেইখানে ২০% অর্ডারও আমাদের হয়নি। ছোট-বড় সব ফ্যাক্টরিতেই এই প্রভাব পড়েছে। এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে আমাদের নিট শিল্পে ব্যাপক আকারে ধস নামবে।
নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান মঞ্জরুল হক জানান, হরতাল অবরোধে কি পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে বা হয়েছে তা সঠিক ভাবে নিরূপণ করা না গেলেও ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে শিল্প কারখানার মালিকরা, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। জাতীয় পর্যায়ে ৭টিসহ ৫০টি সংগঠন রয়েছে চেম্বারের নেতৃত্ব। এই ৫০টি সংগঠন কয়েকশ’ শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিচ্ছে।
অবরোধের কারণে দেশের সবচেয়ে বড় সুতার ব্যবসা কেন্দ্র নারায়ণগঞ্জে ধস নেমেছে। প্রতিদিন যেখানে লেনদেন হতো প্রায় কোটি টাকা। এখন তা নেমে এসেছে অর্ধেকের নিচে। বিক্রি করতে না পারায় গুদামে জমে গেছে সুতার চালান। এতে চরম হুমকির মুখে পড়েছেন সুতার মিল মালিক ও ব্যবসায়ীরা। নারায়ণগঞ্জে সুতা ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী।
নারায়ণগঞ্জের সুতা ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ ইয়ার্ন অ্যাসোসিয়েশনের সামনের রাস্তায় অলস সময় পার করছেন কর্মচারী। আগে যেখানে সুতা বোঝাই ট্রাক ও ঠেলাগাড়ির যানজট লেগে থাকতো, এখন সে দৃশ্য উধাও। কাজ নেই তাই লুড়ু খেলে ও আড্ডায় বেকার সময় পার করছেন চালক ও কর্মচারীরা।
মহিউদ্দীন জুয়েল, চট্টগ্রাম থেকে জানান, ১৫ দিনের হরতালে ব্যবসায়ে ক্ষতি ১৭,০০০ কোটি টাকা। দেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও একের পর এক হরতাল-অবরোধের কারণে ভয়াবহ সঙ্কটের মুখে পড়েছে দেশের প্রধান বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্য। এতে চরম উদ্বেগ প্রকাশ করে দ্রুত সমস্যা সমাধানের আহবান জানিয়েছেন চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ ও গার্মেন্ট ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিজিএমই এর শীর্ষ নেতারা।
অন্যদিকে সারা দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা বলেছেন, এভাবে সংঘাতময় পরিস্থিতি চলতে থাকলে বড় ক্ষতির আশঙ্কা করছেন তারা। যার ফলে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে দীর্ঘ সময়ের জন্য।
বর্তমানে সারা দেশের সব ধরনের পোশাকশিল্প, ভোগ্যপণ্য ও আমদানি-রপ্তানির দুই-তৃতীয়াংশ নিয়ন্ত্রিত হয় চট্টগ্রাম থেকে। চিটাগাং চেম্বারের নেতারা জানান, উৎপাদন খাতে ১০০ কোটি, পণ্য ও যাত্রী পরিবহন খাতে ৬৮ কোটি, রপ্তানি খাতে ৬৯৫ কোটি টাকাসহ ১৫ দিনে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা।
ইকবাল আহমদ সরকার, গাজীপুর থেকে জানান, দেশের চলমান  রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানার বিদেশী বায়ার এসেও কারখানায় না গিয়ে ফিরে গেছেন  দেশে। ফলে বাতিল হয়ে গেছে পোশাক রপ্তানির চুক্তি। পাশাপাশি আমেরিকার বায়াররা বাংলাদেশে না এসে কারখানা কর্তৃপক্ষকে ডেকেছেন থাইল্যান্ডে। তাদের মিটিং হবে থাইল্যান্ডে। একের পর এক বাতিল হয়ে যাচ্ছে বিদেশী বায়ারদের সিডিউল। প্রায় সব কারখানার আমদানি-রপ্তানি এবং স্বাভাবিক উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। উৎপাদন ব্যয়ও বেড়েছে। পরিবহন ভাড়া বেড়েছে দেড় থেকে দ্বিগুণ। যদিও বন্ধ নেই কোন কারখানা। আতঙ্কে আছেন শিল্প মালিকসহ-কর্মকর্তারা।
গাজীপুরের কোনাবাড়ী শিল্প এলাকার বৃহৎ পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠান ওই ইসলাম গ্রুপের ডিরেক্টর সাকের আহমদ বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থায় পোশাক শিল্পের পরিস্থিতি নিয়ে বললেন, আমাদের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। আর ইমেজ তো নষ্ট হয়েছেই।
গত শনিবার ফ্রান্সের বায়ার আমাদের কোনাবাড়ির কারখানায় আসার কথা ছিল। বায়ার এ দেশেও এসেছিলেন। বিমান বন্দর থেকে হোটেল রেডিশনে। কিন্তু অবরোধ-হরতাল আর পরিস্থিতির কারণে বায়ার কোনাবাড়ির কারখানায় আসেননি। ফিরে গেছেন তার দেশে। মাসে পাঁচ লাখ পিচ টি-শার্ট রপ্তানির চুক্তি হওয়ার কথা ছিল ওই বায়ারের সঙ্গে। তা আর হলো না, এ জন্যে খুব খারাপ লাগছে। নগরের সাইন বোর্ড এলাকার এলিট গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক মো. শহীদুজ্জামান জানালেন, তাদের কারখানায় আমেরিকার বায়ার আসার কথা ছিল এই জানুয়ারিতে। দেশের এই অবস্থার খবর পেয়ে বায়ারগণ তাদের শিডিউল বাতিল করেছে। এখন তাদের ইচ্ছায় আমাদের মিটিং করতে হবে থাইল্যান্ডে গিয়ে। অলমার্কের ঢাকার গুলশানের অফিসের কর্মকর্তারা এখন অফিসে না গিয়ে বাসায় কাজ করছেন। মূলত ইন্টারনেট আর মেইলের মাধ্যমে।
নগরের কোনাবাড়ীর জরুন এলাকার স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার নূর ই আলম বললেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা খুবই আতঙ্কে রয়েছি। অনেক সময় রাত কাটাতে হয় কারখানায়। কোনাবাড়ির এই কারখানার গত ১৮ দিনে আমেরিকার বিভিন্ন দেশের বায়ারসহ প্রতিনিধিদের ১১টি ভিসিট বাতিল হয়েছে। নতুন করে সিডিউলও পাওয়া যায়নি। তারা আসতে চাচ্ছেন না। নতুন অর্ডার হচ্ছে না, মূল্যায়ন হচ্ছে না। এছাড়াও সৃষ্টি হচ্ছে বহুমাত্রিক সমস্যা। প্রায় দ্বিগুণ পরিবহন ভাড়ায় শিপমেন্টের জন্য পাঠাতে হচ্ছে চট্টগ্রামে। আবার সেখানে নিয়েও সময়মতো আনলোড করতে পারছে না। জেনারেটরসহ যন্ত্রপাতি মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের সমস্যা হচ্ছে। এক্সপার্টদের আনতে হচ্ছে এম্বুলেন্সে করে। সবকিছুতেই বিলম্ব হয়ে যাচ্ছে। আতঙ্ক আর ঝুঁকি নিয়ে চলাফেরা করতে হচ্ছে। পণ্য পরিবহন আর উৎপাদনে ও বিরূপ প্রভাব পড়েছে বর্তমান প্রেক্ষাপটে। গাজীপুরের গড়গড়িয়া মাস্টারবাড়ী এলাকার এসএম নিট ওয়্যার কারখানার ডিজিএম আলী হোসেন বললেন, এ মুহূর্তে পরিবহন সটসহ নানা কারণে ব্যয় বেড়েছে শতকরা ৩০ থেকে ৪০ ভাগ। কারখানায় উৎপাদন চালাতে সুতা আনতে হয় কোনাবাড়ী, কাশিমপুর, নারায়ণগঞ্জ থেকে। সব সময়মতো যানবাহন পাওয়া যায় না। আবার শিপমেন্টের মাল পাঠাতেও বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। বেশি ভাড়ায় এসব আনা নেয়া করতে হয়। আবার ভয়ে ভয়ে রাতে পাঠাতে হয়। নির্ধারিত সময়ে অফিসে যোগ দিতে আগের থেকে এক দেড় ঘণ্টা আগে ভয়ে ভয়ে রওনা দিতে হয়। বাড়ি ফেরার পথেও মানসিক চাপ নিয়ে রওনা করতে হয়। এটা তো সুস্থ জীবন হলো না।
নগরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকার ল্যাভেন্ডার গার্মেন্টস কারখানার ম্যানেজার নজরুল ইসলাম বললেন, কারখানা পুরোপুরি চালু আছে। কিন্তু উৎপাদনতো স্বাভাবিক পর্যায়ে নেই। আগে যেখানে ১০-১২ হাজার পিস উৎপাদন করা যেতো, এখান সেখানে ৭-৮ হাজার পিস উৎপাদন করা যায়। কেন না ফেব্রিক্স, বাটনসহ এক্সেসরিস আনতে হয় বাইরে থেকে। সেগুলো এখন সময় মতো আনো যাচ্ছে না। হয়তো পোশাক তৈরি হয়ে গেল কিন্তু দেখা যাচ্ছে বাটনের জন্য কমপ্লিট করা গেল না। এভাবেই উৎপাদন কমে যাচ্ছে। ওয়ার্কাররা আশ পাশে থাকে সে জন্যে তাদের হয়তো আসতে সমস্যা হচ্ছে না। ম্যানেজম্যানের প্রায় সাবাই তো দূরে থাকেন, তাদের প্রাণটা হাতে নিয়েই আসতে হয়। রওনা না দিয়ে বাসায় না ফেরা পর্যন্ত স্বজনরা সবাই দুচিন্তায় থাকে। লক্ষ্মীপুরা এলাকার জেনেসিস ফ্যাশন কারখানার পিএম আব্দুল লতিফ বললেন, উৎপাদন প্রক্রিয়ায় দারুণভাবে ব্যাঘাত ঘটছে। কারখানায় পোশাক তৈরি হয়ে গেলেও দেখা যায় অন্য টঙ্গী নিয়ে হয়তো ওয়াস করতে হয়, আবার সাভারে পাঠাতে হয় এম্বডারি করতে। খরচ তো বেড়েছেই, ঝুঁকি নিয়ে মালামাল আনা-নেয়া করতে হয়। সব সময়মতো ভয়ভীতির মাঝে থাকতে হয়। দেশ যেন আফগানিস্তান হয়ে যাচ্ছে। এটা তো আর জীবন হলো না।
হাফিজ উদ্দিন, সাভার থেকে জানান, হরতাল, অবরোধ ও সহিংসতার কারণে আর্থিক ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে সাভার-আশুলিয়ার পোশাক শিল্প। ফলে প্রতিনিয়তই বাড়ছে এ শিল্পে ক্ষতির পরিমাণ। সময়মতো পণ্যের শিপমেন্ট করতে না পারায় আন্তর্জাতিকভাবে ইমেজ সঙ্কটের মুখে পড়েছে দেশের বৃহত্তর অর্থনৈতিক এ খাত। এ অবস্থায় অনেক কারখানারই অর্ডার বাতিল করা হচ্ছে।
আবার টানা অবরোধে দেশের মহাসড়কগুলোতেও গার্মেন্ট শিল্পের কাঁচামাল পরিবহনে সঙ্কট দেখা দিয়েছে। অল্প কিছু যানবাহন পাওয়া গেলেও ভাড়া দাবি করা হচ্ছে কয়েক গুণ বেশি। আবার বেশি ভাড়ায় কাঁচামাল আনা হলেও সময়মতো মাল কারখানায় পৌঁছতে পারছে না। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন ঢাকা-আরিচা ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে কয়েক হাজারের বেশি ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান এবং লরি চলাচল করে। তবে হরতাল-অবরোধের কারণে তা নেমে এসেছে মাত্র কয়েক শতে। রোববার রাতে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের আশুলিয়ার বেরন এলাকায় তৈরী পোশাকবাহী একটি কার্ভাড ভ্যানে আগুন ধরিয়ে দিলে আরও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে কারখানা মালিকরা।
একাধিক কারখানা মালিক দাবি করেছেন, দ্রুত রাজনৈতিক এ সহিংসতা বন্ধ না হলে এ শিল্প বন্ধ করে দেয়া ছাড়া তাদের আর কোন পথ থাকবে না।
এদিকে সাভার-আশুলিয়ায় ছোট-বড় ছয় শতাধিক গার্মেন্ট কারখানায় পণ্য উৎপাদনে রয়েছে। কিন্তু এর অধিকাংশরই প্রয়োজনীয় সামগ্রীর কারখানা বা ব্যাক-আপ লিংকেজ নেই বললেই চলে।
ফ্যাশন ডট কম পোশাক কারখানার পরিচালক আজাহার উদ্দিন বলেন, সময়মতো পণ্য শিপমেন্ট করতে না পারা এবং বাংলাদেশে সামপ্রতিক নাশকতার কারণে বিদেশী ক্রেতারা নতুনভাবে চিন্তা-ভাবনা শুরু করেছেন অর্ডার দেয়ার বিষয়ে।
তিনি বলেন, ব্রাজিল পাঠানোর জন্য শিপমেন্ট রেডি হয়ে রয়েছে গত তিন দিন আগে। কিন্তু অবরোধের কারণে পরিবহন সঙ্কট ও সড়কে নিরাপত্তার কারণে শিপমেন্টের মাল চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠানো যাচ্ছে না। যদিওবা পরিবহন পাওয়া যাচ্ছে সেক্ষেত্রে ভাড়া গুণতে হচ্ছে কয়েকগুণ বেশি। ফলে আর্থিকভাবে লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে। একই সঙ্গে আমাদের ইমেজ সঙ্কটও প্রকট আকার ধারণ করছে। যে কারণে ভবিষ্যতের বুকিংগুলো নিয়ে অনিশ্চয়তার মাঝে পড়ে গেছি বলেন তিনি।
হরতাল-অবরোধের ২০তম দিনে তিন শতাধিক গ্রেপ্তার
ককটেল বিস্ফোরণ, ঝটিকা মিছিল-সমাবেশ, গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগসহ বিচ্ছিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে ২০দলীয় জোটের ৩৬ ঘণ্টা হরতালের সঙ্গে অবরোধের ২০তম দিন অতিবাহিত হয়েছে। হরতাল-অবরোধ চলাকালে গতকাল রাজধানীসহ সারা দেশে বিএনপি-জামায়াত জোটের তিন শতাধিক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছে বলে জোটের সূত্রে দাবি করা হয়। এদিকে গতকাল রাজধানীতে সীমিত আকারে গণপরিবহন চলাচল করলেও দূরপাল্লার যানবাহন বরাবরের মতো বন্ধ ছিল। তবে ট্রেন এবং লঞ্চ চলাচল অনেকটা স্বাভাবিক ছিল। হরতালের সমর্থনে রাজধানীতে তেমন কোন পিকেটিং দেখা যায়নি। তবে রাজধানীর বাইরের পরিস্থিতি ছিল খানিকটা সরব। হরতাল- অবরোধকারীরা বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় ঝটিকা মিছিল-সমাবেশ করেছে। আগুন জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করেছে। ওদিকে দেশজুড়ে ৩৬ ঘণ্টার হরতাল শেষ না হতেই আজ ফের রাজশাহী বিভাগের ৮ জেলায় ২৪ ঘণ্টার হরতালের ডাক দিয়েছে ২০দলীয় জোট।
ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি জানান, ঠাকুরগাঁওয়ের সদর উপজেলার ২৯ মাইল নামকস্থানে গাড়িতে পেট্রলবোমা হামলায় চালক নাজমুল ইসলাম অগ্নিদগ্ধ হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ-বিজিবি ৮ জনকে আটক করেছে। দগ্ধ নাজমুল কুষ্টিয়া জেলার শিবপুর উপজেলার সাহেবগড় গ্রামের ইউনুস প্রামাণিকের ছেলে। গতকাল সকালে তাকে ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে স্থানান্তর করা হয়।
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, হরতাল চলাকালে ৩টি লেগুনা ও একটি সিএনজি অটোরিকশা ভাঙচুর করেছে শিবিরকর্মীরা। গতকাল সোমবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে শহরের মুহাম্মদপুর এলাকায় এ ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
স্টাফ রিপোর্টার, কুড়িগ্রাম থেকে জানান, পুলিশ সোমবার ভোর রাতে বিএনপি- জামায়াতের ৪ কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ফুলবাড়ী উপজেলায় ২ জন এবং নাগেশ্বরী উপজেলায় ২ জন।
মেহেরপুর প্রতিনিধি জানান, রোববার দিনগত রাতে বিএনপি-জামায়াতের ৯ নেতাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজবাহার আলী শেখ জানান, নাশকতা প্রতিরোধে জেলার বিভিন্ন স্থানে অব্যাহত অভিযানের অংশ হিসেবে সন্দেহভাজন ৯ জনকে আটক করা হয়েছে।
সিংড়া (নাটোর) প্রতিনিধি জানান, নাটোরের সিংড়ায় হরতালের পক্ষে ও বিপক্ষে মিছিল হয়েছে। বেলা ১১টায় উপজেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে হরতাল সমর্থনে একটি মিছিল বের হয়ে কেন্দ্রীয় বাসস্ট্যান্ড পৌঁছালে মিছিল থেকে একটি গাড়িতে ঢিল ছুড়লে ওই গাড়ির কাঁচ ভেঙে যায়। এ সময় কর্তব্যরত পুলিশের এস আই মাহবুবের নেতৃত্বে মিছিলে বাধা দেয়া হলে উভয় পক্ষের মধ্যে ধস্তাধস্তি শুরু হয়। একপর্যায়ে এস আই মাহবুব আহত হন।
স্টাফ রিপোর্টার, সাভার থেকে জানান, গতকাল সকালে পিকেটাররা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দুটি যাত্রীবাহী বাস লক্ষ্য করে পাঁচটি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। এছাড়া, নাশকতার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে জামায়াত-বিএনপির তিন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, সকালে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে যাত্রীবাহী বাস চলাচলের সময় দুটি বাসকে লক্ষ্য করে অন্তত পাঁচটি হাতবোমা নিক্ষেপ করে পালিয়ে যায় পিকেটাররা। এসময় হাতবোমা বিস্ফোরণে একটি বাসের দুই যাত্রী আহত হয়।
নাটোর প্রতিনিধি জানান, নাটোরে হরতালের সমর্থনে সিংড়ায় বিএনপির মিছিলে পুলিশের লাঠিচার্জ, ধাওয়া- পাল্টা ধাওয়া ও বাস ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় পুলিশের সঙ্গে ইটপাটকেল নিক্ষেপে এক এসআইসহ দুই পুলিশ সদস্য আহত হয়েছে। এ ঘটনায় একজনকে আটক করে পুলিশ। অপরদিকে একই সময় সিংড়া উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদের বাড়িতে হামলা করে দুর্বৃত্তরা। এছাড়া, হরতালের সমর্থনে রোববার রাতে বড়াইগ্রামে ৮টি ট্রাক ও বাস ভাঙচুর করে পিকেটাররা। এদিকে শহরের মাদরাসা মোড় এলাকায় রাতে দুই ককটেল বিস্ফোরণে মধু নামে কলা বিক্রেতা ও সাইদুর রহমান নামে এক পথচারী আহত হয়েছে।
সরাইল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি জানান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের আড়াই শতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ। গত রোববার পুলিশের সঙ্গে যুবদল ও ছাত্রদলের সংঘর্ষের ঘটনায় বিস্ফোরক আইনে ২ শ’ ও বুধবারে অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। রোববারের ঘটনার পর গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে রয়েছে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, নাশকতার আশঙ্কায় গতকাল  মানিকগঞ্জ  জেলা ছাত্রদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি আওলাদ হোসেনসহ বিএনপির ১১ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ২০ দিনের টানা অবরোধে এ পর্যন্ত জেলায় শতাধিক নেতাকর্মীকে পুলিশ আটক করেছে। মামলার আসামিও করা হয়েছে কয়েক শ’ নেতাকর্মীকে।
কুলাউড়া থেকে সংবাদদাতা জানান, রোববার রাতে জামায়াত-শিবিরের ৫ কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। কুলাউড়া শহরে গত শনিবার বিকালে ঝটিকা হামলা ও গাড়ি ভাঙচুরের ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে আসামিদের শনাক্ত করে কুলাউড়া উপজেলার ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়নের  কোনাগাঁও গ্রামের মৃত মানিক মিয়ার  ছেলে শাহীন আহমদ, বরমচাল ইউনিয়নের পশ্চিম সিংগুর গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে ইকবাল, মকবুল আহমদের ছেলে নজরুল ইসলাম, সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ থানার ছত্রিশ এলাকার মৃত জমির আলীর ছেলে সুয়েজ আহমদ ও গোলাপগঞ্জ উপজেলার ফুলসাইন্দ এলাকার মৃত রফিক উদ্দিন ওরফে তোতা মিয়ার ছেলে সুমন আহমদকে গ্রেপ্তার করা হয়।
চুনারুঘাট (হবিগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগে পুলিশ বিএনপি’র ৩ কর্মীকে আটক করেছে। এরা হলো-মোমিন আলী, নুরুল আমীন ও সাইফুর রহমান। দুপুর ১টার দিকে যুবদল চুনারুঘাট পৌরশহরের উত্তর বাজার ও কলেজ রোড এলাকায় ছাত্রশিবির হরতালের সমর্থনে পিকেটিং শুরু করে। এ সময় ৫টি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাঙচুর করে। চুনারুঘাট থানা পুলিশ খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে এসে মিছিলকারীকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে যুবদল, ছাত্রশিবির ও পুলিশের মাঝে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। বিক্ষোভকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়লে পুলিশ দুই রাউন্ড টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। এক পর্যায়ে যুবদল ও ছাত্রশিবিরের কর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।

চাঁপাই নবাবগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, চাঁপাই নবাবগঞ্জের শান্তিমোড় এলাকায় ট্রাক বহরে হামলা চালিয়েছে হরতাল সমর্থকরা। সোমবার সকাল ১০টার দিকে এই ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রহরায় প্রায় অর্ধশত ট্রাক চাঁপাই নবাবগঞ্জ থেকে সোনামসজিদ স্থল বন্দরের দিকে যাওয়ার সময় শহরের শান্তি মোড় এলাকায় কিছু ট্রাক পার হওয়ার পরপরই হামলা চালায় হরতাল সমর্থকরা। এসময় ককটেল ফাটিয়ে অন্তত ১০টি যানবাহনে ভাঙচুর চালায় তারা। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রহরায় ট্রাকের বহরগুলোকে জেলার শেষ সীমানা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া হয়।
ঝিনাইদহ প্রতিনিধি জানান, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের সভাপতি ওমর ফারুক, শৈলকুপা উপজেলা শ্রমিক দলের যুগ্ম সম্পাদক মোস্তাক আহমেদসহ বিএনপির ৭ কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে ঝিনাইদহ পুলিশ।
স্টাফ রিপোর্টার, হবিগঞ্জ থেকে জানান, হবিগঞ্জে পেট্রলবোমা, ককটেল ও বিস্ফোরক দ্রব্য দিয়ে নাশকতার চেষ্টার অভিযোগে ৩ যুবককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। রোববার রাত ১১টায় পুলিশ শহরের উমেদনগর এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতরা হচ্ছেন উমেদনগরের নিম্বর আলীর পুত্র রহমত, কদর আলীর পুত্র শাহাদত ও উমেদনগরস্থ রকি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কর্মচারী কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরবের কালীপুর গ্রামের মুজিবুর রহমানের পুত্র ফয়সল।
নাটোর প্রতিনিধি জানান, নাটোরে ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা নাটোর নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা সরকারি কলেজের সাবেক জিএস অধ্যক্ষ শামসুল ইসলাম কল্লোলকে আটক করেছে পুলিশ। সোমবার দুপুরে সাদা পোশাকধারী পুলিশের একটি দল শহরের উত্তর চৌকির পাড়ের বাসা থেকে তাকে আটক করেছে। তিনি জোহরের নামাজ শেষে বাসায় অবস্থান করছিলেন বলে জানা গেছে।
স্টাফ রিপোর্টার, হবিগঞ্জ থেকে জানান, চুনারুঘাট শহরে পিকেটিংকালে ৭টি অটোরিকশা ভাঙচুর করে। এ ঘটনায় পুলিশ ৪ নেতাকর্মীকে আটক করেছে। আটককৃতরা হলেন- উপজেলা বিএনপি’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. খায়রুল ইসলাম, উপজেলা জাসাস সভাপতি মুমিন আলী, বিএনপি নেতা নূরুল আমিন ও জামায়াত নেতা সাইদুর রহমান। সোমবার দুপুরে তাদের আটক করা হয়। চুনারুঘাট থানার ওসি অমূল্য কুমার চৌধুরী জানান, গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগে তাদেরকে আটক করা হয়েছে।
স্টাফ রিপোর্টার, রাজশাহী থেকে জানান, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রতিবাদ ও মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে রাজশাহী বিভাগে আগামীকাল বুধবার সকাল ৬টা  থেকে ২৪ ঘণ্টার হরতালের ডাক দেয়া হয়েছে। গতকাল সোমবার দুপুরে বিএনপির রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হারুন-অর-রশীদ স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
শেরপুর (বগুড়া) প্রতিনিধি জানান, বগুড়ার শেরপুরে যৌথবাহিনী জামায়াতের ৪ কর্মীকে আটক করেছে। সোমবার  ভোর রাতে তাদেরকে আটক করা হয়।
আটক ব্যক্তিরা হলেন- উপজেলার গাড়ীদহ ইউনিয়নের আব্দুর রশিদের ছেলে, আইয়ুব হোসেন ওরফে সেতু, আব্দুল ওহাবের ছেলে রেজাউল ইসলাম, সামছুল হকের ছেলে মো. সেলিম ও মৃত আব্দুল আজিজের ছেলে লিটন। পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) মিজানুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, আটককৃতদের ১০ই জানুয়ারি শেরপুরের বিশ্বরোডে গাড়ি পোড়ানো মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে।
ফুলবাড়ী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি: উপজেলায় বিএনপি-জামায়াতের দুই কর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। সোমবার ভোররাতে অন্তপুর এলাকার নুরজামাল হকের ছেলে আলমগীর হোসেন ও কুড়িগ্রাম সদরের মোল্লাপাড়া গ্রামের এনছানুল হকের পুত্র আনিছুর রহমানকে বেড়াকুটি বাজার থেকে আটক করা হয়।
চাঁদপুর প্রতিনিধি জানান, জামায়াতে ইসলামী চাঁদপুর শহর শাখার উদ্যোগে গতকাল সকালে হরতালের সমর্থনে মিছিল বের হয়। মিছিলটি শহরের সিএসডি গোডাউন মোড় থেকে শুরু হয়ে রহমতপুর আবাসিক এলাকার সামনে গিয়ে শেষ হয়।

No comments

Powered by Blogger.