সর্ষে-মাছ-সন্দেশে অভিভূত ওবামা

রাইসিনা হিলে রাষ্ট্রপতি ভবন। সেখানে ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জীর উষ্ণ আতিথেয়তায় অভিভূত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। সর্ষে দেয়া মাছ আর নলেন গুঁড়ের সন্দেশে নৈশভোজে আপ্যায়িত ওবামা প্রমাণ পেলেন বাঙালিয়ানার। রোববার রাতের এ আপ্যায়নের কথা হয়তো অনেক দিন স্মরণে রাখবেন ওবামা। গতকাল  দিল্লির রাজপথ ছিল বৃষ্টিভেজা। বেশ ঠাণ্ডাও পড়েছে। কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র ঘাটতি পড়েনি ৬৬তম প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে। বরং এতে উপস্থিত হয়ে নতুন উত্তাপ ছড়ালেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত। পাশে ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জী, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে সেনারা যে দৃষ্টিনন্দন কসরত, কৌশল প্রদর্শন করলেন, যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি অস্ত্র প্রদর্শন করলেন তা দেখে মাঝে মাঝেই মার্কিনি কায়দায় বৃদ্ধাঙুলি  দেখিয়ে অভিবাদনের জবাব দিচ্ছিলেন। বুলেটপ্রুফ কাঁচে ঘেরা নিরাপত্তা বেষ্টনীতে বসে তিনি অবলোকন করেন বর্ণিল সামরিক মহড়া। এর আগে তিনি প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে উপস্থিত হতেই চারদিক থেকে বিপুল হর্ষধ্বনিতে তাদের স্বাগত জানানো হয়। রাজপথে পৌঁছার আগে ইন্ডিয়া গেটে নিহত সেনাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে যান নরেন্দ্র মোদি। সেখান থেকে তিনি রাজপথের অনুষ্ঠানে যোগ দেন। তাকে স্বাগত জানান প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মনোহর পারিকার। এর পরপরই নিজস্ব সরকারি গাড়ি দ্য বিস্ট-এ চড়ে সেখানে উপস্থিত হন বারাক ওবামা ও ফার্স্টলেডি মিশেল ওবামা। তারা বুলেটপ্রুফ কাঁচে ঘেরা বেষ্টনীতে গিয়ে বসার আগে ওবামা উপস্থিত সবার প্রতি হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানান। হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া হয় ফুলের পাপড়ি। কুয়াশাচ্ছন্ন বৃষ্টিভেজা সকালে ব্রাশ ব্যান্ড ও নৃত্যশিল্পীরা তাদের কলাকৌশল প্রদর্শন করেন। সামরিক কুচকাওয়াজে যখন ভারতীয় ঐতিহ্য তুলে ধরা হচ্ছিল তখনই বেরসিক ক্যামেরার চোখ গিয়ে পড়ে ওবামার ওপর। দেখা যায় তিনি তখন চুইংগাম চিবোচ্ছেন। নরেন্দ্র মোদি যখন তার সঙ্গে কথোপকথনে ব্যস্ত তখন মুখ থেকে চুইংগাম বের করে ফেলছেন ওবামা। তবে বিএসএফের স্ট্যান্টম্যানরা যখন তাদের কসরত প্রদর্শন করেন তখন বারাক ওবামা ও মিশেল ওবামাকে বেশ পুলকিত দেখা যায়। বিএসএফের ডেয়ারডেভিলদের দিকে বৃদ্ধাঙুলি প্রদর্শন করে অভিনন্দন জানান। এখানে উল্লেখ্য, প্রজাতন্ত্র দিবসে ভারতের প্রেসিডেন্টের সরকারি গাড়িতে করে প্রধান অতিথি রাজপথের অনুষ্ঠানে যোগ দেন। কিন্তু সে নিয়তের ব্যত্যয় করেছেন ওবামা। তিনি প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জীর গাড়িতে না গিয়ে নিজস্ব বুলেটপ্রুফ গাড়ি ‘দ্য বিস্ট’এ চড়ে হাজির হন রাজপথে। তারপর পরই সেখানে উপস্থিত হন প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জী। ২০১২ সাল থেকে ভারতের প্রেসিডেন্ট অস্ত্র সজ্জিত কালো মার্সিডিজ বেঞ্জ এস ৬০০ পুলম্যান গার্ডে চড়ে সফর করেন। সামরিক বাহিনীর গুলি, বোমা ও অন্য সব বিস্ফোরক প্রতিরোধী গাড়ি এটি। গতকালের প্রজাতন্ত্র দিবসে প্রথমেই মার্চ করেন সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর নারী সেনাদের সমন্বয়ে গঠিত দলের কুচকাওয়াজ। প্রথমবার প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব দেন নারীরা। এতে নেতৃত্ব দিয়েছেন ক্যাপ্টেন দিব্যা। তাদের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। ওদিকে প্রজাতন্ত্র দিবসে দেশবাসীকে অভিনন্দন জানান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এ দিনটি উপলক্ষে রাজধানী নয়া দিল্লি ছিল বিরল নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা। রাজপথে ভিভিআইপিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নেয়া হয় সাত স্তরের নিরাপত্তা। ১৫ হাজারের বেশি সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয় রাজধানীতে। এর মাধ্যমে দিল্লি পুলিশ, যুক্তরাষ্ট্রের সিক্রেট সার্ভিস ও কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা তদারক করে। আকাশপথে  কোন অনাকাঙ্ক্ষিত হামলা হলে তা প্রতিরোধে প্রস্তুত রাখা হয় বিমান বিধ্বংসী অস্ত্র। রাজপথের ৪০০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে আকাশসীমাকে রাখা হয় উড্ডয়নমুক্ত। এর ফলে নয়া দিল্লি, জয়পুর, আগ্রা, লক্ষ্ণৌ, অমৃতসর থেকে কোন ফ্লাইট উড্ডয়ন করেনি। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে লোকজনকে রাজপথের অনুষ্ঠানে ছাতা পর্যন্ত নিতে দেয়া হয়নি। ওদিকে তিন দিনের ভারত সফরের প্রথম দিনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আস্থার নতুন যুগের সূচনা ঘোষণা করেন। হিমঘরে চলে গিয়েছিল যে বেসামরিক পরমাণু চুক্তি তাকে পুনরুজ্জীবিত করার ঘোষণা দেন তারা। পারমাণবিক প্রযুক্তি বিনিময়ে সম্মত হয়েছেন তারা। প্রতিরক্ষা খাতেও একে অন্যকে সহায়তা করার ঘোষণা দিয়েছেন। রোববার রাষ্ট্রপতি ভবনের লনে চা পানের সময় দু’নেতা রসিকতাও করেন বেশ। এদিন ওবামাকে নিজ হাতে চা ঢেলে আপ্যায়িত করেন নরেন্দ্র মোদি। একপর্যায়ে ওবামা তাকে বলেন, (যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময়) ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে দেখলাম আপনার জনপ্রিয়তা তো বলিউড তারকার মতো। প্রধানমন্ত্রী বললেন, কাল তিনি মাত্র তিন ঘণ্টা  ঘুমিয়েছেন। শুনে খারাপ লাগলো। আমি তো দিব্যি ঘণ্টা পাঁচেক  ঘুমিয়েছি। মোদি কুর্তা একটা পাবার ইচ্ছে ছিল আমারও। নরেন্দ্র মোদি বলেন, বারাক আর আমার রসায়নই ভারত-আমেরিকাকে কাছে এনেছে। আমি বারাককে ফোন করে গল্প করি। ক্যামেরা না থাকলে আড্ডা দারুণ জমে। ওদিকে গতকাল রাজপথে প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠান শেষে বারাক ওবামা ও নরেন্দ্র মোদি তাজ প্যালেস হোটেলে যোগ দেন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীদের সঙ্গে। ওবামা তার ভারত সফরে সাক্ষাৎ করেছেন বিরোধী দলে থাকা কংগ্রেস পার্টির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে। এর মধ্যে ছিলেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, দলীয় প্রধান সোনিয়া গান্ধী ও সিনিয়র কিছু নেতা। ভারত সফরকে সংক্ষিপ্ত করে আজই বারাক ওবামার যাওয়ার কথা রয়েছে সৌদি আরবে। সেখানে তিনি সদ্য মারা যাওয়া বাদশাহ আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন।

ছাতায় রক্ষা
ভারতের ৬৬তম প্রজাতন্ত্র দিবসে ভিভিআইপিদের জন্য সংরক্ষিত মঞ্চটি ছিল বুলেটপ্রুফ গ্লাস দিয়ে ঘেরা। কর্তৃপক্ষ স্থানটিকে বুলেট নিরোধক করতে সক্ষম হলেও আবহাওয়া নিরোধক করতে পারেন নি। প্রধান অতিথি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যখন তার ‘বিস্ট’ খ্যাত গাড়িতে করে রাজপথে পৌঁছুলেন, তখন অবিরাম বৃষ্টির ধারায় সিক্ত পুরো এলাকা। এমতাবস্থায় ওবামা, ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জী ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্য একমাত্র আচ্ছাদনের উপায় হয়ে দাঁড়ায় ছাতা। এ খবর দিয়েছে এনডিটিভি। ওবামা গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে তার দেহরক্ষীরা হাতে ছাতা ধরে তার গায়ে চড়িয়ে দিলেন ওভারকোট। হাঁটতে হাঁটতে মঞ্চে নির্ধারিত স্থানে গেলেন তিনি। বর্ষণের মধ্যেই একে একে সবাই উপবিষ্ট হলেন আসনে। নিরাপত্তা কর্মী আর সহযোগীদের তখন প্রধান কাজ ছাতা হাতে ভিভিআইপিদের বৃষ্টি থেকে রক্ষা করা। ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা কিছু সময় নিজের ছাতা নিজেই ধরে রাখলেন। প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জির ছিলেন বিশেষ আচ্ছাদনের নিচে। তার মাথায় ছিল পশমী টুপি। বৃষ্টির জন্য পূর্ব প্রস্তুতি না রাখায় সমালোচনার শিকার হন অনুষ্ঠানের আয়োজক প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। কর্মকর্তারা বলছেন, ভিভিআইপি মঞ্চের ওপর সাধারণত আচ্ছাদন রাখা হয় না, যেন অতিথিরা নিরবচ্ছিন্নভাবে আকাশপথের মহড়া প্রত্যক্ষ করতে পারেন। রাজপথে চৌকস কুচকাওয়াজ আর প্রদর্শনী চলাকালীন সকালের অনেকটা সময় অবিরাম ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ছিল। দুর্ভাগ্য ছিল রাজপথে উপস্থিত ১ লাখ ২৫ হাজার জনতার। ভিভিআইপিরা ছাতার নিচে সুরক্ষা পেলেও বৃষ্টিতে ভেজা ছাড়া তাদের কোন উপায় ছিল না। কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে আগাম আবহাওয়ার পূর্ভাবাস পেলেও ছাতা নিয়ে ঢোকার অনুমতি ছিল না তাদের।
প্রণবের উষ্ণ আতিথেয়তায় মুগ্ধ ওবামা

রোববার রাইসিনা হিলের রাষ্ট্রপতি ভবনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সম্মানে রাষ্ট্রীয় নৈশভোজের আয়োজন করেছিলেন ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি। পশ্চিমবঙ্গের প্রণব তার আয়োজনে রাখেন বাঙালিয়ানার ছোঁয়া। খাবার থেকে শুরু করে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক আয়োজন। সবখানেই ছিল বাঙালি কৃষ্টির উপস্থিতি। এদিন পুরো রাষ্ট্রপতি ভবন নয়নাভিরাম আলোকসজ্জায় সাজানো হয়। সাংস্কৃতিক আয়োজনে ছিল উচ্চাঙ্গ নৃত্য আর রবীন্দ্র সংগীতের মূর্চ্ছনা। খাবারের তালিকায় সর্ষে মাছ, মিষ্টান্নে নলেন গুড়ের সন্দেশ। ভারতীয় নানা পদ খাবারের আয়োজনে বাঙালি পদগুলো ছিল স্বতন্ত্র। বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবারের স্বাদে শুধু মার্কিন প্রেসিডেন্ট আর ফার্স্ট লেডিই নন, মুগ্ধ আমন্ত্রিত সকল অতিথি। এর আগে হায়দরাবাদ হাউজে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে মধ্যাহ্ন ভোজে ওবামা স্বাদ নেন গুজরাটি খাবারের। আর নৈশভোজে উপভোগ করছেন বাঙালি খাবার। অতিথিদের মধ্যে ছিলেন ভারতের ভাইস প্রেসিডেন্ট হামিদ আনসারী ও তার স্ত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী। উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের অনেক মন্ত্রী, বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও আরও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। অনুষ্ঠানের শুরুতে বারাক ওবামা ও তার স্ত্রী মিশেল ওবামাকে সাদরে বরণ করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। পরবর্তীতে নিমন্ত্রিত অনেকের সঙ্গে ওবামাকে বৈঠক করতে দেখা যায়। প্রতি বছরই ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রধান অতিথির সম্মানে রাষ্ট্রপতি ভবনে আয়োজন করা হয় অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানের। সে সূত্র ধরেই এবারের আয়োজনের মধ্যমণি ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও ফার্স্ট লেডি মিশেল। সকালে দিল্লির রাজপথে ৬৬তম প্রজাতন্ত্র দিবসে প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃত করেন ওবামা। পরে রাষ্ট্রপতি ভবনে উষ্ণ এ আয়োজনে মুগ্ধ মার্কিন প্রেসিডেন্ট। অতিথি আগমনের পর প্রেসিডেন্টের দেহরক্ষীরা মঞ্চে নিয়ে যান প্রণব মুখার্জিকে। এরপর বেজে ওঠে ভারতের জাতীয় সংগীত। এরপর প্রধান অতিথি ও অন্যরা একে অপরের সঙ্গে আলাপচারিতায় মেতে ওঠেন। অনুষ্ঠানে প্রণব মুখার্জির স্ত্রী সুভ্রা মুখার্জি মার্কিন ফার্স্টলেডিকে কাশ্মীরের একটি পাশমিনা শাল উপহার দেন। মিশেলকে প্রণব উপহার দেন বিশেষ এক টি-সেট। এতে লক্ষ্ণৌয়ের খ্যাতিমান চিত্রকর সুকুমার বসুর আঁকা রাষ্ট্রপতি ভবনের নানা দেয়ালচিত্র অঙ্কিত ছিল। রাজস্থানের অনুচিত্রকর জয় কুমার ওবামাকে একটি চিত্রকর্ম উপহার দেন। এছাড়াও প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি ওবামাকে মোঘল আমলে নির্মিত ঐতিহ্যবাহী রাষ্ট্রপতি ভবনের সচিত্র ইতিহাস সংবলিত একটি বই উপহার দেন।

No comments

Powered by Blogger.