ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল চালকদের মাথায় হাত

(বরগুনা শহরের মাদ্রাসা সড়কের একটি স্ট্যান্ডে রাখা সারিবদ্ধ মোটরসাইকেল। সরকারের নতুন সিদ্ধান্তের কারণে বেকার হয়ে পড়েছেন ভাড়ায় চালিত এসব মোটরসাইকেলের চালকেরা l ছবি: প্রথম আলো) মোটরসাইকেলে চালক ছাড়া অন্য সঙ্গী বা যাত্রী বহনে নিষেধাজ্ঞা জারির পর বিপাকে পড়েছেন ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল চালকেরা। বরিশাল, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর, রাজশাহীর বাগমারা, সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় হাজারো মানুষ ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালিয়ে সংসার চালান। বিশেষ করে প্রত্যন্ত এলাকায় যাত্রী পরিবহনে মোটরসাইকেলের একধরনের জনপ্রিয়তা রয়েছে। সাতক্ষীরায় গত রোববার এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন হয়েছে। ২২ জানুয়ারি সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ মোটরসাইকেলে চালক ছাড়া অন্য সঙ্গী বা যাত্রী বহনে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, সাম্প্রতিক সময়ে কিছু দুর্বৃত্ত মোটরসাইকেল ব্যবহার করে বিভিন্ন যানবাহনে বোমা হামলা, ব্যাপক সহিংসতা ও নাশকতা চালাচ্ছে। এ ধরনের নাশকতা রোধে ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই মোটরসাইকেলে চালক ছাড়া অন্য সঙ্গী বা যাত্রী বহনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। বরিশাল নগরের জেলখানার মোড়, নথুল্লাবাদ, রূপতলী বাস টার্মিনালসহ বিভিন্ন স্থান থেকে যাত্রী তোলেন ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলের চালকেরা। জেলখানা মোড়ে চালক মো. জামাল হাওলাদার জানান, পুলিশ মোটরসাইকেলে যাত্রী দেখলেই নামিয়ে দেয়। পরিবারের সাতজন সদস্যের খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। চালক মিজানুর রহমান বলেন, ‘বরিশাল থেকে বাবুগঞ্জ, মীরগঞ্জ, বানারীপাড়াসহ বিভিন্ন স্থানে ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন করতাম। নিষেধাজ্ঞার কারণে বেকার বসে আছি। এখন তো ঋণের কিস্তির টাকা পরিশোধ করাই দায় হয়ে পড়েছে।’
নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবিতে গত রোববার সাতক্ষীরায় ভাড়ায় চালিত জেলা মোটরসাইকেল চালক অ্যাসোসিয়েশন শহরে মিছিল ও মানববন্ধন করেছে। সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনে বক্তব্য দেন সংগঠনের উপদেষ্টা শেখ হারুন-উর-রশিদ, সভাপতি এবাদুল ইসলাম, সাবেক সভাপতি তারিকুল ইসলাম প্রমুখ। বক্তারা বলেন, সাতক্ষীরার প্রায় ২৫ হাজার মানুষ ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলের আয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। অনেকে ঋণ নিয়ে মোটরসাইকেল কিনেছেন। এখন যাত্রী বহন করতে না পারায় তাঁরা পরিবার নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। অবিলম্বে তাঁরা এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি জানান। রাজশাহীর বাগমারা উপজেলা মোটরসাইকেল চালক সমিতির সভাপতি আমজাদ হোসেন জানান, চার বছর ধরে উপজেলায় দুই শতাধিক মোটরসাইকেল ভাড়ায় চলে আসছে। কাচারীকোয়ালীপাড়া ইউনিয়নের চালক মো. মমতাজ ও মো. রাজিব জানান, তাঁরা ঋণের টাকায় মোটরসাইকেল কিনে ভাড়ায় চালাচ্ছেন। প্রতি মাসে কিস্তি দিতে হয়। নিষেধাজ্ঞার কারণে বেকায়দায় পড়েছেন। পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার শিয়ালকাঠী গ্রামের কলেজছাত্র মো. আবদুল্লাহ মোটরসাইকেলে ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন করে সংসার চালানোর পাশাপাশি নিজের লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছেন। নিষেধাজ্ঞা জারির পর আবদুল্লাহ বেকার হয়ে পড়েছেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, পিরোজপুর জেলার সাত উপজেলায় ভাড়ায় চালিত পাঁচ হাজার মোটরসাইকেলচালক আছেন।
মঠবাড়িয়া উপজেলার সবুজ নগর গ্রামের চালক গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘কিস্তিতে মোটরসাইকেল কিনে ভাড়ায় যাত্রী বহন করে প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় করতাম। এখন নিষেধাজ্ঞার কারণে পুলিশ মোটরসাইকেলে যাত্রী বহন করতে দিচ্ছে না।’ বরগুনা জেলা ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল সমিতি সূত্র জানায়, জেলার ছয়টি উপজেলায় প্রায় ১৭ হাজার ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল রয়েছে। এলাকার বেকার যুবকেরা ঋণ নিয়ে, ধারদেনা করে এবং বিভিন্ন কোম্পানির শোরুম থেকে কিস্তিতে এসব মোটরসাইকেল এনে জীবিকা নির্বাহ করেন। আমতলীর মোটরসাইকেলচালক হাবিবুর রহমান (৩২) বলেন, ‘মোরা মোটরসাইকেল চালাইয়্যা সংসার চালাই, এহন যদি সরকার মোগো প্যাটে লাথি মারে, তাইলে বউ-বাচ্চা লইয়্যা না খাইয়্যা মরণ ছাড়া উপায় নাই।’
চালক জাহিদ হোসেন বলেন, ‘এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি, চাকরির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরেও পাইনি। বাধ্য হয়ে ঋণ এনে মোটরসাইকেল কিনে ভাড়ায় চালাই। সপ্তাহে কিস্তি দেই আর বাকি দিয়ে সংসার চালাই। এখন যদি এই কাজটাও করতে না পারি, তাহলে আমরা কোথায় যাব?’ বরগুনা জেলা ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল চালক সমিতির হারুন অর রশিদ জানান, সরকারের এ সিদ্ধান্তের ফলে এই অঞ্চলের হাজার হাজার যুবক বেকার হবেন। এ ছাড়া যাত্রী পরিবহনে বাসমালিকদের যে জবরদস্তি, তা অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে। এ জন্য সরকারের উচিত ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলের চালকদের এই নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত রাখা।

No comments

Powered by Blogger.