আদর্শিক রাজনীতির প্রতীক

আপনাদের কারও কারও মনে থাকতে পারে, ১৯৯২ সালের ৩১ জুলাই খুলনা ডিসি অফিসের সামনে প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা কমরেড রতন সেনকে খুন করা হয়। ঘটনাটি ঘটে প্রকাশ্য দিবালোকে। অজাতশত্রু এই মানুষটির হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে খুলনা তথা বাংলাদেশ।
সর্বস্বত্যাগী, নির্লোভ, নিরহংকার এই মানুষটিকে স্বাভাবিক মৃত্যু থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছে। তাঁর হত্যার বিচার হয়নি, বিচারের নামে হয়েছে প্রহসন। হত্যার পরিকল্পনাকারীদের অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু তারা খালাস পেয়ে যায়। রতন সেন হত্যার পুনঃ তদন্ত ও পুনর্বিচারের দাবি এখনো উপেক্ষিত। পুনর্বিচারের জন্য হাইকোর্ট মামলাটি গ্রহণ করলেও অজ্ঞাত কারণে তা স্থগিত হয়ে আছে।
১৯৭৩ সাল থেকে রতন সেন ছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। ১৯৮৯ সালে কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন এবং দায়িত্ব পালনের জন্য কিছুদিন ঢাকায় অবস্থান করেন। কিন্তু গ্রামে থেকে কাজ করার জন্য তিনি এই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে খুলনায় ফিরে আসেন। তিনি ছিলেন সিপিবির খুলনা জেলার সভাপতি।
১৯২৩ সালের ৩ এপ্রিল বরিশালের উজিরপুরে রতন সেনের জন্ম। বাবা নরেন্দ্রনাথ সেন ছিলেন খুলনার দৌলতপুর ব্রজলাল কলেজের প্রধান অফিস সহকারী। রতন সেনের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে দৌলতপুরে। মুহসীন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ব্রজলাল কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট, ডিস্টিংশনসহ বিএ পাস করেন তিনি। বড় চাকরি নিয়ে মধ্যবিত্তের আয়েশি জীবন যাপনের সুযোগ ত্যাগ করেন, গ্রহণ করেন শ্রমিকশ্রেণীর দর্শন।
বড় ভাই বিপ্লবী মোহিত সেনের কাছে রাজনীতির দীক্ষা নিয়ে রতন সেন যুক্ত হন ব্রিটিশবিরোধী সন্ত্রাসবাদী ধারার আন্দোলনে। স্কুলছাত্র থাকাকালেই যোগ দেন নিখিল বঙ্গ ছাত্র সমিতিতে। কলেজজীবনে নেতৃত্ব দেন ছাত্র ফেডারেশনে। ১৯৪২ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। পার্টির নির্দেশে যুক্ত হন শ্রমিক আন্দোলনে। পরবর্তী সময়ে কৃষক আন্দোলনের দায়িত্ব পেলে তেভাগা ও জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের আন্দোলন গড়ে তোলেন। ভারতীয় কৃষাণ সভা এবং পরে কৃষক সমিতির নেতৃত্ব দেন। তিনি ছিলেন কৃষক সমিতির খুলনা জেলার সভাপতি। ছিলেন অবৈধ চিংড়িঘেরবিরোধী আন্দোলনের রূপকার।
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন নেমে আসে। রাজশাহী জেলে সাতজন কমিউনিস্ট বন্দীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। জেল থেকে মুচলেকা দিয়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য করা হয় কমিউনিস্ট কর্মীদের। নির্যাতন সহ্য করেও যাঁরা দেশেই থেকে গিয়েছিলেন, রতন সেন ছিলেন তাঁদের একজন।
সব মিলিয়ে রতন সেনের জেলজীবন ১৭ বছরের, আত্মগোপন আরও পাঁচ-ছয় বছরের। ১৯৪৮ সালে তাঁকে গ্রেপ্তার করে গাড়ির পেছনে বেঁধে এক মাইল টেনেহিঁচড়ে থানায় নিয়ে আসা হয়। কয়েক দিনের ওপর নির্যাতন বন্ধ, রাজবন্দীদের মর্যাদা বৃদ্ধি, কমিউনিস্ট বন্দীদের আন্দোলনে রতন সেন নেতৃত্ব দিয়েছেন। দীর্ঘদিন জেলে থাকার কারণে, বালিশ ছাড়া মেঝেতে ঘুমানো তাঁর অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল।
ষাটের দশকে কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিভক্তি দেখা দিলে রতন সেন ছাড়া খুলনার পার্টির নেতৃত্বের প্রায় সবাই পিকিংপন্থী ব্লকে চলে যান। কয়েকজন ছাত্র কমরেডকে নিয়ে তিনি পার্টি গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় খুলনায় সিপিবির মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান প্রতিষ্ঠিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধে রতন সেন ‘ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনী’র সংগঠক ছিলেন। তরুণদের সংগঠিত করে ট্রেনিংয়ের জন্য ভারতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। পশ্চিমবঙ্গের পানতোড়, টার্কি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে তিনি ছাত্র-তরুণদের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ দেন।
স্বৈরাচার-সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনে খুলনায় রতন সেন ছিলেন প্রধান নেতা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন চলাকালে স্বাধীনতাবিরোধীরা খুলনায় ৩৫ জন নেতাকে ‘ভারতের দালাল’ বলে ঘোষণা করে এবং রতন সেনের নাম ছিল শীর্ষে। এ ঘটনার দুই মাসের মধ্যেই তিনি খুন হন।
কৃষক আন্দোলন গড়ে তুলতে রতন সেনকে কিছুদিন স্কুলে শিক্ষকতাও করতে হয়েছে। তিনি স্কুল থেকে কোনো বেতন নিতেন না। সরকারি বেতনের অধিকাংশই গরিব শিক্ষার্থীদের দিয়ে দিতেন। হয়ে ওঠেন প্রিয় মাস্টারমশাই।
রতন সেনের তাত্ত্বিক জ্ঞান ছিল অসাধারণ। ঘরোয়া বৈঠকে তিনি ছিলেন তুখোড় বক্তা। একতা, মুক্তির দিগন্তসহ পার্টির পত্রিকায় তাত্ত্বিক নিবন্ধ লিখতেন। অনুবাদ সাহিত্যে ছিলেন সাবলীল। তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা স্বাধীনতার খুলনা প্রতিনিধি।
অকৃতদার রতন সেন নিজেই রান্না করতেন। পোশাক-পরিচ্ছদ বলতে ছিল খদ্দরের পাঞ্জাবি, সুতির পাজামা, কালো চওড়া ফ্র্রেমের চশমা, হালকা চপ্পল আর চটের ব্যাগ। যে চৌকিতে ঘুমাতেন, সেখানেই বই রাখতেন। রতন সেন একটা শিঙাড়া বা একটা সন্দেশ বা এক কাপ চা পাঁচ-সাতজনকে ভাগ করে দিতেন আন্তরিকভাবে। কমরেডদের প্রতি তাঁর ছিল শ্রদ্ধা ও শাসন, ছিল আন্তরিকতা ও দরদ। ব্যক্তিগত সমস্যা থেকে উত্তরণে কমরেডদের পরামর্শ দিতেন। কমরেডদের বকতেন, কিন্তু এই বকুনি ছিল স্নেহ, মমতা ও ভালোবাসামিশ্রিত।
রতন সেন সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপের বিপর্যয়ের পরও দৃঢ়ভাবেই বলতেন, দ্রুতই পৃথিবী সমাজতন্ত্রের উত্থান দেখতে পাবে।
রতন সেনের নামে খুলনায় একটা রাস্তার নামকরণ হয়েছে। খুলনা শহরে গড়ে উঠেছে ‘রতন সেন পাবলিক লাইব্রেরি’। রূপসার পালেরহাটে যে বাড়িতে তিনি থাকতেন, ওই বাড়িকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ‘কমরেড রতন সেন কলেজিয়েট গার্লস স্কুল’।
দেশপ্রেম, আদর্শবাদিতা, মানুষের প্রতি মমত্ববোধ, নিষ্ঠা, একাগ্রতা, ত্যাগ, সততা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার এক উজ্জ্বলতম উদাহরণ কমরেড রতন সেন। আদর্শহীন রাজনীতির বিপরীতে আদর্শিক রাজনীতির প্রতীক। ‘মুক্ত মানুষের মুক্ত সমাজ’ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি সর্বস্ব ত্যাগ করেছেন। রতন সেনের মৃত্যু নেই। ‘লাল সালাম’ কমরেড রতন সেন!
অনিরুদ্ধ অঞ্জন

No comments

Powered by Blogger.