মাশুল আদায় ও পৃথক কর্তৃপক্ষের সুপারিশ

মাশুল আদায়ের সুপারিশ করেই ভারত, নেপাল ও ভুটানসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকে ট্রানজিট প্রদান নীতিমালাসংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন।
গতকাল বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এই প্রতিবেদনের লিখিত কপি পাঠানো হয়। অবশ্য এর আগে গত বুধবার একই প্রতিবেদনের ‘সফট কপি’ও পাঠিয়ে দিয়েছে ট্যারিফ কমিশন।
ট্রানজিটসংক্রান্ত কোর গ্রুপের সভাপতি ও ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। এখন সরকার প্রতিবেদনের প্রতিপাদ্য বিষয় বিবেচনা করে ট্রানজিটসংক্রান্ত সব ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।’
মাশুল আদায়ের প্রসঙ্গে মজিবুর রহমান বলেন, ‘ট্রানজিটসংক্রান্ত মাশুলের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত বিধিবিধানগুলো প্রতিবেদনে তুলে ধরে মাশুল আদায়ের সুপারিশ করা হয়েছে।’
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিধিবিধান অনুসারে ট্রানজিটের ওপর কোনো শুল্ক আদায় করার সুযোগ নেই। তবে প্রশাসনিক ও পরিবহনসহ সেবামাশুল আদায়ের সুযোগ রয়েছে। এই আলোকেই প্রশাসনিক মাশুল, পরিবেশ বিপর্যয়সংক্রান্ত মাশুল, রক্ষণাবেক্ষণ মাশুল, শব্দদূষণ মাশুল, দুর্ঘটনাজনিত মাশুল, পণ্যের ওজনে সড়ক ও রেলপথের ক্ষতিসংক্রান্ত মাশুলসহ বিভিন্ন মাশুল আদায়ের সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এ ছাড়া ট্রানজিট দিতে হলে সড়ক, রেল ও নৌপথসহ সামগ্রিক অবকাঠামো উন্নয়নে ৭০০ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। আগামী ১০ বছর ধরে এই বিনিয়োগ করতে হবে। তবে প্রিমিয়ামসহ বিনিয়োগ উঠে আসার সময়সীমা ধরা হয়েছে ২০ বছর। অর্থাৎ আগামী ২০ বছরে লাভসহ বিনিয়োগের অর্থ উঠে আসবে।
এ ছাড়া পৃথক একটি ট্রানজিট কর্তৃপক্ষ গঠনের কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে সড়ক, রেল ও নৌরুটের উন্নয়নের পাশাপাশি চট্টগ্রাম ও মংলা নৌবন্দরসহ স্থলবন্দরগুলোর উন্নয়নের সুপারিশ করা হয়েছে।
তবে আপাতত রেলরুটে ট্রানজিট দেওয়ার সুযোগ নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে এতে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, যমুনার ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে ভারতের অপেক্ষাকৃত বেশি ওজনের ওয়াগন চলাচল করতে পারবে না। এ জন্য প্রতিবেদনে পৃথক রেলসেতু নির্মাণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
সড়ক, রেল ও নৌরুটগুলোর প্রারম্ভিক স্টেশনগুলো মূলত কলকাতা, নদীয়া, শিলিগুড়ি অংশে; আর প্রান্তিক স্টেশন ভারতের আসাম, আগরতলা, মিজোরাম। তবে ভারত, নেপাল ও ভুটানের জন্য চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
কোর গ্রুপের একজন সদস্য প্রথম আলোকে জানান, ‘ট্রানজিটসংক্রান্ত বাংলাদেশের লাভের বিষয়টি নির্ভর করবে পুরোপুরি ভারতের সঙ্গে দর-কষাকষির ওপর। কেননা, আমরা ট্রানজিট দিতে সম্মত হলাম, কিন্তু ভারত সংশ্লিষ্ট রুটগুলো ব্যবহারে সম্মত হলো না কিংবা ভারত যেসব রুট ব্যবহার করতে চায়, আমরা সেসব রুট সহসাই উন্নয়ন করতে পারব না। অথবা আমরা আগামী ১০ বছরে যে পরিমাণ ট্রানজিটের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করব, ভারত তার চেয়ে কম ট্রানজিট নিল। এমন অবস্থায় ট্রানজিটের সুফল পাওয়া যাবে না।’
উল্লেখ্য, ভারত, নেপাল ও ভুটানসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকে ট্রানজিটসুবিধা দেওয়ার বিষয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়নের জন্য গত ২ ডিসেম্বর ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমানকে সভাপতি করে ট্রানজিটসংক্রান্ত কোর গ্রুপ গঠন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এই গ্রুপকে ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ট্রানজিটসংক্রান্ত একটি রূপরেখা জমা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছিল। পরে কয়েক দফা সময় বাড়ানো হয়েছে।
গত ১৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত কোর গ্রুপের প্রথম সভায় পাঁচটি উপকমিটি গঠন করা হয়। এর মধ্যে রুট নির্ধারণ এবং অবকাঠামো উন্নয়নে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ ও পুনরুদ্ধার—এই দুটি উপকমিটির প্রধান ট্রানজিট বিশেষজ্ঞ রহমত উল্লাহ। ট্রানজিট মাশুল নির্ধারণসংক্রান্ত উপকমিটির প্রধান জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য (শুল্ক) শাহ আলম খান। বিভিন্ন দেশ বা অঞ্চলের ট্রানজিট তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণসংক্রান্ত অপর উপকমিটির প্রধান বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান। এবং অর্থনৈতিক বিশ্লেষণসংক্রান্ত উপকমিটির প্রধান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমদ।
উপকমিটিগুলোর সুপারিশের ভিত্তিতে একটি দিকনির্দেশনামূলক অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ তৈরি করেছেন সাদিক আহমদ।
উপকমিটিগুলোতে এনবিআর, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, এফবিসিসিআই ও বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিরা রয়েছেন।
ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনের ওপর একটি জাতীয় সেমিনার করে সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিদের মতামত নেওয়ার কথা রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.