মাহমুদ দারবিশের চারটি কবিতা ‘বিস্মৃতির স্মৃতি,নির্বাসন ছাড়া আমি কে?,পাসপোর্ট,রিতা আর রাইফেল’

১৯৮২ সালে ইজরায়েল যখন লেবাননে আক্রমণ হানে, তখন বেইরুটে নির্বাসিতের জীবন কাটাচ্ছিলেন মাহমুদ দারবিশ। ইজরায়েলি বিমান থেকে এক সন্ধ্যায় বেইরুটে কয়েক পশলা বোমাবর্ষণের পর দারবিশের কলম থেকে বেরিয়ে আসে এই কবিতাটি।

বিস্মৃতির স্মৃতি


এই সেই রাস্তা,
আর এখন ঘড়িতে সন্ধ্যা ৭টা।
দিগন্ত যেন ইস্পাত বলয়।
আমার নিষ্পাপ আবেগের কথা
আমি এখন কাকে বলবো?…
এই রাস্তায় এমন আস্তে হাঁটছি
যেন একটা জেট বিমানও
আমাকে বোমার লক্ষ্য হিসাবে ভুল না করে।
শূন্যতা তার করাল বিস্তৃত করেছে,
কিন্তু তাও আমাকে গ্রাস করলো না।
লক্ষ্যহীনভাবে এগিয়ে চলেছি,
যেন এই রাস্তাগুলোকে আমি
প্রথমবার চেনার চেষ্টা করছি
এবং শেষবারের মতো হেঁটে চলেছি।
--------------------

নির্বাসন ছাড়া আমি কে?

তীরবর্তী পথিক, নদীর মতোই… জল দিয়ে বাঁধা হলো তোমার নামের সাথে। আমার মুক্তদূরত্ব থেকে কোনো কিছুই আর ফিরিয়ে নিয়ে যাবে না আমার পাম গাছের কাছে — না শান্তি, না যুদ্ধ। কোনো কিছুই আর আমাকে টেস্টামেন্টের বইগুলোতে উৎকীর্ণ করবে না। কিছুই না, ভাটাপড়া তীর আলোকপ্রভ করবার মতো কিছুই আর নেই, টাইগ্রিস আর নিল নদীর মধ্য দিয়ে কিছুই আর প্রবাহিত হয় না। ফারাওদের সুপ্রাচীন রথ থেকে আমাকে আর কেউ নামিয়ে দেয় না। খানিক সময় দেবার মতো কেউ আর নেই, বিশ্বাসে অটল থাকবার অবকাশও কেউ দেয় না — না অঙ্গীকার, না নস্টালজিয়া। আমার এখন কী করা উচিত? নির্বাসনে যাওয়া ছাড়া আমার আর কী করবার আছে, সারারাত জলের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছাড়া কী করতে পারি আমি?
জল দিয়ে
বাঁধা হলো
তোমার নামের সাথে…
আমার স্বপ্নের প্রজাপতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে বর্তমানে নিয়ে আসবার মতো কিছু নেই — না মাটি না আগুন। সামারকান্দের গোলাপ ছাড়া আমি আর কী করতে পারি? চন্দ্রাকৃতির পাথর দিয়ে বংশী পলিশ করা স্কয়ারে আমি কী করতে পারি? আমরা উভয়েই কত ভারহীন হয়ে গেছি, যেমন দূরবর্তী বাতাসে আমাদের বাড়িগুলো হয়ে গেছে প্রায়-ভরহীন। মেঘেদের অদ্ভুৎসব সৃষ্টির সঙ্গে বন্ধুতা হয়ে গেছে আমাদের উভয়ের; আত্মপরিচয়ের ভূমির মাধ্যাকর্ষণ শক্তির নাগালের বাইরে। এখন আমরা কী করতে পারি… নির্বাসন ছাড়া আমাদের আর কী করার আছে, সুদীর্ঘ রাত জলের দিকে চেয়ে থাকা ছাড়া কী করতে পারি আমরা?
জল দিয়ে
বাঁধা হলো
তোমার নামের সাথে…
তোমার জন্য আছি কেবল আমি, আমার জন্য শুধু তুমি… প্রেমিকের ঊরুতে চুমু খায় এক অচেনা পথিক: শোনো হে পথিক! এই সুনসান নীরবতায় আমাদের জন্য যা রাখা আছে, তা দিয়ে কী করতে পারি আমরা, মধ্যদুপুরের যে-ঘুম এক কীংবদন্তী থেকে অন্য কোনো কীংবদন্তীকে বিচ্ছিন্ন করে, তাকে নিয়ে কী করার আছে আমাদের? আমাদেরকে নিয়ে যাবার মতো কেউ নেই — না পথ, না বাড়ি। শুরু থেকেই এই পথ একই আছে তো, নাকি পাহাড়ের উপর মোঙ্গলদের অর্শ্ববহরের মধ্যে ঘোটকীর সন্ধান পেয়ে গেছে আমাদের স্বপ্নগুলো, আর আমাদের বিকিয়ে দিয়েছে? তাহলে আমাদের কী আছে করার?
জল দিয়ে
বাঁধা হলো
তোমার নামের সাথে…

পাসপোর্ট

ওরা আমাকে চিনতে পারেনি অন্ধকারে
যা আমার পাসপোর্ট থেকে রঙ সব শুষে নিয়েছিলো
আর ওদের কাছে আমার ক্ষতগুলো ছিলো নিখাদ লোকদেখানো
একজন পর্যটকের যে কিনা ফোটোগ্রাফ সংগ্রহ করতে ভালোবাসে
ওরা আমাকে চিনতে পারেনি,
আহা রে… ছেড়ে যেও না
আমার হাতের তালু সূর্যবিহীন
কেননা বৃক্ষরা আমাকে চিনতে পেরেছিলো
বৃষ্টির সকল গান চিনতে পেরেছিলো আমাকে
চাঁদের মতোন ফিকে এ-আমাকে যেও না ফেলিয়া!

***

যেসব পাখির দল দেখেছিলো আমার হাতের তালু
থেকে দূরবর্তী বিমানবন্দরের দরজা
সকল গমের ক্ষেত
সকল কয়েদখানা
সমস্ত শ্বেতসমাধিপ্রস্তর
কাঁটাতারঘেরা সকল সীমানা
দুলতে থাকা সকল রুমাল
সকল দৃষ্টি
ছিলো এ-আমার সাথে,
অথচ আমার পাসপোর্ট থেকে এইসব কিছু তারা উধাও করে দিলো

***

আমার নাম-পরিচিতি মুছে দিতে চাও?
নিজহাতে যে-মাটির যত্ন নিয়েছি সেই মাটিতে?
আজ পরিস্থিতি আর্তনাদ করে উঠেছিলো
আকাশ কাঁপিয়ে:
আবার আমার নামে আর কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন কোরো না!
ওহে ভদ্রমহোদয়গণ, ওহে পয়গম্বরগণ,
বৃক্ষদেরকে তাদের নাম জিজ্ঞেস কোরো না
উপত্যকাদেরকে তাদের মায়েদের বিষয়ে জিজ্ঞেস কোরো না
আমার কপাল থেকে বিচ্ছুরিত হয় আলোর তরবারি
আর আমার হাত থেকে ঝরনাধারার মতো বহে নদীদের জল
মানুষের হৃদয়ে আছে আমার পরিচয়
অতএব নিয়ে যাও আমার পাসপোর্ট

রিতা আর রাইফেল

রিতা আর আমার চোখের মাঝখানে
একটি রাইফেল
আর রিতাকে যারাই চেনে
হাঁটুগেড়ে বসে খেলতে থাকে
শাশ্বতের দিকে মধু-রঙা ওই চোখে
আর আমি চুমু খেলাম রিতাকে
যখন সে টগবগে তরুণী
আমার মনে আছে কীভাবে সে এগিয়ে এলো
কীভাবে আমার বাহুতে ঢেকে গেলো সুন্দরতম খোঁপা তার
আর আমার মনে পড়ে যায় রিতাকে
যেমন চড়ুইপাখির মনে পড়ে যায় নিজস্ব আলোকধারা
আহ রিতা
আমাদের মাঝে হাজার-লক্ষ চড়ুই আর দৃশ্যকল্প
আর কত না মিলন-স্থান
রাইফেলে ছাই হয়ে গেলো

***

রিতা নামটি আমার মুখে ভোজনের স্বাদ হয়ে আসে
রিতার শরীর মানে রক্তে যেন বিবাহোৎসব
আর রিতার মধ্যে আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম দু’দুটো বছর
আর সেই দু’বছর ও ঘুমিয়েছিলো আমার বাহুতে
আর আমরা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম
সুন্দরতম পেয়ালার ’পরে
আর আমরা আমাদের ঠোঁট পুড়িয়ে ফেলেছিলাম সুরায়
আমাদের জন্ম হলো পুনঃ।

***

ওহ রিতা
তোমার উপর থেকে আমার চোখ সরিয়ে নেবার আগে এই রাইফেল কী করতে পারতো
এক-দুটো ভাতঘুম কিংবা মধু-রঙা মেঘদল ছাড়া?
একদিন
আহ, গোধূলির নৈঃশব্দ
আর সকালে আমার চাঁদ দেশান্তরী হলো কত কত দূরে
সেইসব মধু-রঙা চোখেদের দিকে
নগরীর ঝাড়–পেটা খেয়েছিলো সকল গায়ক
আর রিতা

***

রিতা আর আমার চোখের মধ্যখানে –
একখানা রাইফেল।
=====================
মাহ্‌মুদ দারবিশ (Mahmoud Darwish, ১৩/৩/১৯৪১ — ৯/৮/২০০৮)
৯ আগস্ট ২০০৮ তারিখে আমেরিকার টেক্সাসে মারা গেলেন প্যালেস্টাইনের কবি মাহ্‌মুদ দারবিশ। ৩০টির বেশি কবিতার আর ৮টি গদ্য গ্রন্থের প্রণেতা এই কবি তাঁর গভীর প্যালেস্টাইন প্রীতির জন্য বিখ্যাত। দারবিশ আরবি ভাষায় লেখালেখি করলেও ইংরেজি, হিব্রু ও ফরাসি ভাষায় বাক্যালাপের দক্ষতা তাঁর ছিল। দারবিশের অনেক কবিতা থেকে গান তৈরি হয়েছে। মৃত্যুর আগে দারবিশ প্যালেস্টাইনে সমাহিত হওয়ার ইচ্ছা জানিয়ে গেছেন। 
----------------

bdnews24 এর সৌজন্যে
অনুবাদ: অবনি অনার্য ও অজয় দাশগুপ্ত

এই কবিতা গুলো পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.