চীনের এক-সন্তাননীতি সফল না ব্যর্থ?

১৯৬০ থেকে সত্তরের দশকে বেড়ে উঠেছি আমি। তখনকার চীনা সমাজে যে কেউ ইচ্ছেমতো সন্তান নিতে পারতেন। ছয়-সাতজন সন্তানও নিয়েছেন কেউ কেউ। আমার মা-বাবাও চার সন্তান নিয়েছেন। কিন্তু এক-সন্তাননীতি চালু করার পর এই ধারা আর থাকেনি। তাই মা-বাবা আমাকে প্রায়ই রসিকতা করে বলতেন, ‘তুমি হলে আইনের বাইরের লোক। এক-সন্তাননীতির আমলে জন্মালে তুমি বাঁচতে পারতে না।’ কথাগুলো ওয়েলিয়াং নাইয়ের। চীনে বিবিসির সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করছেন তিনি।
চেয়ারম্যান মাওয়ের (মাও সেতুং) সময়কার কথা বলেছিলেন ওয়েলিয়াং নাই। ১৯৪৯ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত চীন শাসন করেছেন তিনি। মাও দ্রুতবর্ধনশীল জনগোষ্ঠীকে চীনের মহাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে ‘উৎপাদনশীল শক্তি’ হিসেবে বিবেচনা করতেন। কেউ জনসংখ্যা বাড়ার লাগাম টেনে ধরার কথা বললে তাঁর ওপর চটে যেতেন। কিন্তু তাঁর উত্তরসূরি দেং জিয়াওপিং ক্ষমতায় এসেই পুরো চিত্র পাল্টে দিলেন। তাঁর মতে, ভঙ্গুর অর্থনীতির জন্য জনসংখ্যাই মূল সমস্যা।
১৯৮০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরো দলটির সব সদস্য ও তরুণ কমিউনিস্ট-কর্মীর কাছে একটি খোলা চিঠি পাঠায়। চিঠিতে তাঁদের এক সন্তান নিতে আহ্বান জানানো হয়। বলা হয়, এখান থেকেই চীনের বহুল বিতর্কিত এক-সন্তাননীতির সূচনা। গতকাল শনিবার ছিল সেই আলোচিত-সমালোচিত নীতির ৩০ বছর পূর্তি।
অনেক ত্যাগের মধ্য দিয়ে চীনারা তিন দশক ধরে এই নীতির বাস্তবায়ন করে আসছে। তবে ওয়েলিয়াং নাই ও তাঁর পরের প্রজন্মের ওপর দিয়ে খড়্গটা গেছে সবচেয়ে বেশি। ওয়েলিয়াং নাই বলেন, ‘আমার শৈশবের এক বন্ধু দ্বিতীয় সন্তান নিয়েছে। কিন্তু নিরাপত্তার কারণে বিষয়টি গোপন রেখেছে। দ্বিতীয় সন্তান তাঁকে সব সময় “চাচা” বলে ডাকে। কখনো ওই সন্তানের মুখে “বাবা” ডাক শুনতে পায়নি আমার বন্ধু।’
চীনা কর্মকর্তারা বলেছেন, এক-সন্তাননীতি অব্যাহত থাকবে। কেননা, এ নীতির ফলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ কমেছে। তাঁরা বলেন, গত ৩০ বছরে ৪০ কোটি লোক কম জন্মেছে। তবে এ নিয়ে একটি নতুন চ্যালেঞ্জেরও সম্মুখীন হয়েছে চীন। প্রশ্ন উঠেছে, কেবল এক-সন্তাননীতির কারণেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে কি না?
সম্প্রতি সাউদার্ন উইকেন্ড পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এ প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চীনে এক-সন্তাননীতি এখনো দরকার আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শানজি প্রদেশের ইয়েচেং কাউন্টিতে ২৫ বছর ধরে পরীক্ষামূলকভাবে দুই-সন্তাননীতি চালু রয়েছে। কিন্তু এর পরও সেখানকার জন্মহার চীনের গড় জন্মহারের চেয়ে কম।
চায়নিজ একাডেমি অব সোশ্যাল সায়েন্স গত মাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, চীন সরকারের উচিত এক-সন্তাননীতি প্রত্যাহার করে নেওয়া। কেননা, অনেক চীনা বিশেষ করে শহরাঞ্চলের লোকজন এমনিতেই কম সন্তানের পক্ষে।
এক-সন্তাননীতির কারণে চীনে একটি সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করতে যাচ্ছে। তা হলো, ভবিষ্যতে চীনা পুরুষেরা বিয়ে করার ক্ষেত্রে পাত্রীসংকটে পড়বেন। কেননা, নারীরা তাঁদের গর্ভস্থ সন্তান মেয়ে হলেই সেই ভ্রূণ নষ্ট করে ফেলছেন। এতে নারী ও পুরুষের সংখ্যার মধ্যে বড় রকমের বৈষম্যের সৃষ্টি হচ্ছে।
বহুল বিতর্কিত এক-সন্তাননীতি চীন সরকার কবে নাগাদ তুলে নেবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে আগামী মাসেই ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলন বসবে। সেখানে এ নীতির ওপর পর্যালোচনা করা হবে। সম্মেলনে আগামী পাঁচ বছরের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা নেওয়া হবে।

No comments

Powered by Blogger.