সফল গণঅভ্যূত্থান, পতিত সরকারের প্রেসিডেন্ট ও তাদের কাটাছেঁড়া করা সংবিধানের অবস্থান by ব্যারিস্টার নাজির আহমদ
গত ১৬ বছরে পতিত স্বৈরশাসক সংবিধানকে নিজে ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে ও চূড়ান্ত কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠতে কাটাছেঁড়া করে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে এসেছিল যে একজন নাগরিক চাইলেও সংবিধানটি সঠিকভাবে অনুসরণ করে চলতে পারবেন না সেটা না ভেঙে (one cannot follow the constitution properly without breaking it)। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও দায়িত্ব নিয়ে পড়েছেন বেশ ঝামেলায়।
তারাও দৃশ্যত: সংবিধানের কিছু অংশ মানছেন বা মানতে পারছেন আবার অন্য অংশ কিংবা বহু অংশ মানছেন না বা মানতে পারছেন না।
সঙ্গত: কারণে প্রশ্ন উঠছে স্বৈরশাসকের পতনের পর তাদের স্বার্থে কাটাছেঁড়া করে রেখে যাওয়া সংবিধান ও সেটিং থাকে কিভাবে? কেনই বা থাকবে? কেনই বা মানতে হবে? স্বৈরশাসকের নিয়োগ দেয়া প্রেসিডেন্টকেও মানতে হবে বা রাখতে হবে কেন? মনে করিয়ে দেয়া দরকার চরম কর্তৃত্বপরায়ণ স্বৈরশাসনের প্রধান ব্যক্তির একক ইচ্ছায় প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট হওয়া ব্যক্তি তো বটেই, নিয়োগের একদিন আগেও দেশের কেউ জানতো না কে প্রেসিডেন্ট হবেন। তাছাড়া প্রেসিডেন্টকে যে সংসদ নির্বাচিতে করেছিল সে সংসদ কিভাবে গঠিত হয়েছে তা জাতির জানা। জাতির প্রকৃত কোনো মেন্ডেট ছিল না সে সংসদে। এখন প্রশ্ন উঠেছে যে, সংসদের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন তার অবস্থানটা কতোটা বৈধ তাও স্পষ্ট নয়। যেহেতু সংসদ ইতিমধ্যেই বিলুপ্ত হয়েছে।
একটা ill motive ও mala fide intention থেকে প্রেসিডেন্টকে পদে উনাকে বসানো হয়েছিল, যেমনটি করা হয়েছিল প্রধান বিচারপতিকে কেন্দ্র করে। আরো একটু সময় পেলেই সদ্য পদত্যাগ করা প্রধান বিচারপতি তো সফল গণঅভ্যূত্থানকে প্রায় নস্যাত করেই ফেলছিলেন।
সফল গণঅভ্যূত্থানের পর গণঅভ্যূত্থান থেকে অনুসৃত ক্ষমতা বা প্রাপ্ত মেন্ডেটই হয় নতুন সরকারের ক্ষমতার বা চলার পথের ভিত্তি। সফল গণঅভ্যূত্থানের মাধ্যমেই রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য গঠিত হয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সেই প্রতিষ্ঠিত থিউরি “social contract” (সামাজিক চুক্তি)। তাই গণঅভ্যূত্থান থেকে জন্ম নেয়া নতুন সরকারকে তাদের বৈধতার জন্য অন্য দিকে তাকাতে হয় না। গণঅভ্যূত্থানের পর সাধারণত গঠিত হয় ‘বিপ্লবী সরকার’। কিন্তু প্রফেসর ড. ইউনূস ও তার টিম গঠন করলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তারপরও তারা সংবিধানের কিছু অংশ মানছেন আবার কিছু অংশ মানছেন না বা মানতে পারবেন না। কিছু অংশ মানতে গিয়েও তালগোল পাকানো হচ্ছে। এতে বিপদে পড়ার আশঙ্কা আছে বা দিন দিন তা বাড়ছে। এভাবে করতে থাকলে অনেক সমস্যায় তারা পড়তে পারেন বা পড়ে থাকবেন। ইতিহাসে বিপ্লব হবার পর প্রতিবিপ্লব, কাউন্টার বিপ্লব বা ক্যু হবার পর কাউন্টার ক্যু বা অভ্যূত্থানের পর পাল্টা অভ্যূত্থান ইতিহাসে অজানা নয়। বাংলাদেশেও অতীতে হয়েছে। বিশ্বে তো বহু উদাহরণ আছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিৎ ছিল সফল গণঅভ্যূত্থানে স্বৈরশাসনের যেহেতু পতন হয়েছে এবং সংবিধানে যেহেতু তাদের ক্ষমতা নেয়ার বিধান (provision) নেই তারা প্রেসিডেন্টকে চাপ দিয়ে পদত্যাগ করানো এবং এরপর একটি শক্তিশালী “বিপ্লবী সরকার” গঠন করা। গণঅভ্যূত্থান থেকে অনুসৃত মেন্ডেট দিয়ে ঝড়ের বেগে দেশ ও সরকার চালাতে পারতেন এবং সংবিধানসহ সবকিছু সংস্কার ও রিপেয়ার করতে পারতেন। পদচ্যুত হওয়া সরকারের কোনকিছুর মুখাপেক্ষি হওয়া লাগতো না। যেমনটা সামরিক শাসন জারির পর সংবিধান নয় বরং সামরিক আইনের বিধিমালা দিয়ে দেশ শাসন করা হয়।
“বিপ্লবী সরকার” গঠন না করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করলেও তাদের মেন্ডেটকৃত সংস্কার করে দুটি উপায়ে বৈধতা নিশ্চিত করে ক্ষমতা ছাড়তে পারেন। প্রথমত: একটি গণভোট দিয়ে তাদের করা সংস্কারের ও ক্ষমতায় থাকার বৈধতা নিতে পারেন। দ্বিতীয়ত: তারা যদি নতুন সংবিধান রচনায় হাত দেন অথবা বর্তমান সংবিধানের বেশিরভাগ বা মূল বিষয়গুলো ব্যাপকভাবে সংস্কার করে প্রায় নতুন সংবিধান রচনায় অগ্রসর হন তাহলে একটি Constituent Assembly গঠন করবেন শুধুমাত্র তাদের আমূল পরিবর্তন বা সংস্কারকৃত সংবিধানের অনুমোদনের জন্য। এর সাথে সাথে চাইলে একসাথে গণভোটেরও ব্যবস্থা করতে পারেন।
“বিপ্লবী সরকার” গঠন না করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে যেভাবে এগুচ্ছেন সেভাবে এগুতে থাকলে প্রতি পদে পদে বাঁধার পাহাড় ডিঙ্গাতে হবে। কোন সময় বাঁধা এমনভাবে আসতে পারে যে তা হয়তো ডিঙ্গানো সম্ভব নাও হতে পারে। মনে রাখবেন মানুষের আবেগ, উচ্ছ্বাস ও স্বত:স্পূর্ততা সব সময় সমান বা একই ডিগ্রীতে থাকে না। সময়ের ব্যবধানে তা ভাটা পড়ে, পড়তে বাধ্য। নিজের জন্মদাতা পিতা-মাতা ইন্তেকাল করলেও যে শোক ও বেদনা প্রথম দিন থাকে ছয় মাস বা এক বছর পর তো সে মাত্রায় থাকে না।
নাজির আহমদ: বিশিষ্ট আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, রাষ্ট্রচিন্তক, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী এবং ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার।
Email: ahmedlaw2002@yahoo.co.uk
No comments