গল্প- জাতীয় পক্ষপাত by ফাতু দিয়ম

অনুবাদ : মেহবুব আহমেদ।
মিস্টার বডার্সকে ধন্যবাদ – একেবারে নিঃশব্দে বদলে গেছে আইন : একজন ফরাসি নাগরিককে বিয়ে করে দুবছর টিকে থাকতে পারলে পাওয়া যাবে পুরনো পরিচয় মুছে ফেলার কাগজ এবং সঙ্গে ফ্রান্সের সৌরভ। আর আফ্রিকীয় মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রজনন ক্ষমতা নাগরিকতা অর্জনে বাড়তি সুযোগ করে দিতে পারে, অবশ্য জাতীয় পক্ষপাতের কথা ফরাসি ভ্রূণের কিছুই জানা থাকে না। মিস্টার বডার্সকে যতটা বোকা মনে হচ্ছে, ততো কিন্তু তিনি নন – নাগরিকত্ব প্রদানের সময়টিকে দুবছরে প্রলম্বিত করেছেন চপলমতি স্বদেশি ও তাদের বর্ণবাদী আত্মীয়স্বজনের ওপর আস্থা রেখেই – জানেন যে, সে-বিপর্যয়ের আগেই বিয়েটা ভেঙে যাবে। তখন ওই বিদেশি মেয়েটি কেবল একজন ফরাসির পূর্বতন স্ত্রী এবং বিজাতীয় বাতিল এক বস্ত্ত, কারণ বস্ত্তর মতোই তারও কোনো অধিকার থাকে না, এমনকি সৎ উপার্জনে বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও নয়। সে তখন বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে জীবনধারণ করে। সরকার নিজের বিবেককে সন্তুষ্ট রাখার জন্য যোগাযোগের কতগুলো তালিকা সরবরাহ করে – প্রতিটি একইরকম বাজে। সবারই এককথা, ‘হ্যাঁ, কিন্তু তুমি তো ফরাসি নাগরিক নও – এ-সুযোগ তোমার জন্যে নয়, দেখো আর কোথাও।’

জাতীয় পক্ষপাতের কথা বলছিলাম। যদি মেনে নিই যে, পসিডনের রথ সিহর্সরা টানত, তবে বাওবাব গাছের বিশাল গুঁড়ি যে দুর্বল শেকড়ের ওপর বেড়ে ওঠে, তাও মানতে হবে। সাধারণ মানুষের ব্যবহারের মধ্য দিয়েই একটি আইন চালু হয়। উইপোকারা ফেলে দিতে পারে আফ্রিকার বিশাল মেহগনি গাছ, ঠিক যেমন পিঁপড়ে-ঢিবির আকার দেখেই বোঝা যায় কর্মীপিঁপড়ের সংখ্যা আর ভৃত্য ছাড়া কী হতো রাজদরবারের দশা! ঠিক সেজন্যেই জাতীয় পক্ষপাতের কারণে যারা ছোট কাজ করে, তাদেরও কিছুটা গণ্য করা উচিত।

স্ট্রাসবুর্গের বিনা পয়সার কাগজে চাকরির বিজ্ঞাপন দেখতে দেখতে একটা চোখে পড়ল : সিটি সেন্টারে বড় বেকারিতে সেলসগার্ল প্রয়োজন। আঞ্চলিক ভাষা কাম্য। দোকানে আসুন।

ঠিকানাটা লিখে নিলাম এবং সন্ধ্যায় আমার এক বন্ধুকে ফোন করে বিজ্ঞাপনের কথা বললাম। সে প্রতিবাদের সুরে বলে উঠল, ‘পাগল নাকি? তুমি আরো ভালো কাজ পাবে। তোমার আর আমার লেখাপড়া একই – আমি তো টিচার্স ট্রেনিং শেষ করছি। দিনভর রুটি, পেস্ট্রি বিক্রি করা অসহ্য বিরক্তিকর হবে।’

বললাম, ‘অন্য কিছু করতে পারলে তো খুশি হতাম। লেখাপড়া ফ্রান্সে করেছি সত্যি; কিন্তু আমার যোগ্যতার স্বীকৃতি নেই, তাই যোগ্য কাজ করার অনুমতিও আমি পাইনে।’

কিন্তু আমাকে তো খেতে হবে। ‘রুটি বিক্রি করে অনাহারে অন্তত থাকব না।’

ও বলল, ‘কিন্তু এ তো হাস্যকর। তুমি ভালো চাকরি পাবে, এতে সন্দেহ নেই। তেমনভাবে খোঁজ করছ না।’

এ ধরনের মন্তব্য শতবার শুনেছি। আমার এখানকার জীবন সম্পর্কে ফরাসি বন্ধুদের কোনো ধারণাই নেই। তাদের প্রায়ই মনে হয়, আমার মাথা খারাপ। আমি বিরক্ত হইনে। মামাদুর গায়ের রং না হলে ফরাসি বর্ণবাদের ধারণা পাওয়া যাবে না। যারা ক্লিওপেট্রার নাক আর অস্ট্রিয়ার অ্যানের রং নিয়ে জন্মেছে তারা বুঝবে না।

পরদিন সকালে বেকারিতে গেলাম। দেখলাম কিছু ব্যাগেট আর চকোলেট কেক ছাড়া সব খাবারই সাদা রঙের। ওখানে কাজ করছে পিয়ের, পল, জোসেফ ও মারটিন নামে ছেলেরা আর মেয়েদের নাম গারচুড, জোসিয়ান ও জ্যাকুলিন। মামাদু বা আয়শার কোনো চিহ্ন দেখলাম না।

বসের গোঁফ জার্মান কায়দার আর হ্যাটে ফরাসি পতাকার রং, আমাকে সে অ্যালসাস উচ্চারণে স্বাগত জানাল। তবে তার তাকানোর ভঙ্গি থেকেই বুঝলাম, আমি পাশ করতে পারিনি। চকোলেট রঙের চামড়া এ-লোক পছন্দ করে না। চেষ্টায় হাসি টেনে বললাম, ‘হ্যালো স্যার, আমি চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে এসেছি।’

লোকটি মাথা নেড়ে যেন বলতে চাইল, ‘ওই তো, আমাদের বাচ্চাদের কাপড় খুলে নিতে চায় তাদেরই একজন এসেছে।’ কিন্তু চতুর লোক, বলল, ‘অ্যালসাস তো কিছু বলতে পারো – তাই না?’

‘আঞ্চলিক ভাষা কাম্য’ – এটা বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করা ছিল ঠিকই কিন্তু আমি আমার আঞ্চলিক ভাষা জানি, তারটা নয়। আমি ভাবতাম, ফরাসিরা নিজেদের ভাষাটা অন্ততপক্ষে তাদের উপনিবেশের লোকজনের মতো তো বলতে পারবে, আর আমার ফরাসি ভাষাজ্ঞান ভিক্টর হুগোর এই এক স্বদেশির চেয়ে তো বেশিই আছে। তারপরও আবার এ-লোক চাইছে আমি যেন ক্রেতাদের সঙ্গে অ্যালসাস বলতে পারি। সুতরাং যে-উত্তরটা সে আশা করছিল এবং চাইছিল আমি সেটাই দিলাম, ‘না, স্যার’।

কুগলফ খেতে শুরু করেছি সে মাত্র দুবছর, এর মধ্যেই এ-লোক চাইছে আমি তার ভাষা রপ্ত করে ফেলব। তার ঘোলাটে চোখের দৃষ্টিতে প্রত্যাখ্যান দেখতে পেলাম। কিন্তু সেটা তো যুক্তিসংগত করতে হবে আর আমাকে অপমান করার ইচ্ছেও তার ছিল, বলল, ‘দেশে ফিরে যাও না কেন? দেশে গিয়ে কাজ করো।’

এ-লোক প্রথমে ‘তু’ সম্বোধনেই কথা বলেছিল; কিন্তু এখন ‘ভু’ ব্যবহার করল; কিন্তু তা বিনয়বশত নয়, যে-বিদেশিকে সে আবর্জনার মতো রাইনে ছুড়ে ফেলে দিতে চায় তার জন্যেই ‘ভু’ ব্যবহার করে।*

এরপর আমার রূঢ় হওয়া কেবল অধিকার নয়, মনে হলো কর্তব্যও বটে। আমি সংযম হারিয়ে ফেললাম। ‘তোমার জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল এরকম একটা বাজে কাজের জন্য কেন আমাকে আসতে হলো। প্রায় দুটো বছর তোমার মতো এক ফরাসির কাছে আমার শরীর দান করে রেখেছিলাম; কিন্তু সে আমাকে যন্ত্রণা ছাড়া কিছুই দেয়নি, তার প্লাস্টিক ক্যাপ থেকে যদি একটিমাত্র শুক্রাণু বেরিয়ে আসতে পারত তবে আমার অন্তত বেঁচে থাকার অবস্থাটুকু হতো, অন্তত ওই ফরাসি শিশুটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে যা পেতাম তার অবশিষ্ট ক্ষুদকুড়ো দিয়ে আমার চলে যেত। সে তো হলো না আর আমার বোধ হারিয়ে যেতে লাগল, স্বামীর আত্মীয়পরিজনের জাতীয় পক্ষপাত আমার মুক্তির স্বপ্ন ভেঙে দিলো। চলি স্যার, তবে তোমরা তোমাদের জন্য আখ আর বাদাম চাষ করিয়ে আফ্রিকার মাটিকে অসার করে দিয়েছ। আমাদের অ্যালুমিনিয়াম, ফসফেট আর সোনার খনি লুটে এনে নিজের দেশকে তোমরা সমৃদ্ধ করেছ, তাও আমাদেরই খরচে করেছ। সবচেয়ে বড় কথা, তোমরা সেনেগালের মানুষদের নিয়ে সেনাবাহিনী তৈরি করে যুদ্ধে তাদের কামানের তোপ হিসেবে ব্যবহার করেছ, তোমাদেরই স্বার্থে। স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে তাদের হত্যা করিয়েছ অথচ তাদের নিজের দেশের স্বাধীনতাই কেড়ে নিয়েছিলে। এই সাদাদের মাটিতেই যুদ্ধ হয়েছে – এখানেই বোমার টুকরো ছিটকে গিয়ে আমার দাদুর চোখ উড়ে গিয়েছিল; স্যার – সে-চোখ তোমাদের লক্ষ করছে, সে-চোখের আয়নায় আমি তোমাদের ইতিহাসের ভয়াবহতা দেখতে পাচ্ছি। সে-চোখ দেখছে – যে-সন্তানরা এখানে এসেছে সামান্য কিছু হৃত সম্পদ দাবি করতে, তাদের সঙ্গে তোমরা কী ব্যবহার করছ। আমার দেশের মানুষের রক্তের গন্ধ আমাকে পথ দেখিয়ে এখানে এনেছে – ঘরে গর্ভিনী স্ত্রী ফেলে তারা এসেছিল আর সেই সাহসী মানুষগুলোই তোমাদের এই উদ্ধৃত মাটিতে সার হয়ে মিশে গেছে। ভারদুনের কতশত নামহীন কবরে ধ্বনিত রণহুঙ্কার, প্রতিধ্বনিত হয়ে পৌঁছেছে সন্তানহারা আফ্রিকা পর্যন্ত  – তা শুনেই আমি এসেছি। সবচেয়ে বড় কথা, স্যার, আমি একটি নতুন সত্য প্রতিষ্ঠা করতে এসেছি – তোমরা আমাকে গাইতে শিখিয়েছিলে, ‘আমাদের পূর্বসূরি গল’, কিন্তু আমি বুঝেছি ও-কথা সত্যি নয়, আমি তোমাদের বাচ্চাদের গাইতে শেখাব, ‘আমাদের পূর্বসূরি সেনেগালি যোদ্ধা, কারণ ফ্রান্সের সম্ভার যে-উচ্চতায় অবস্থান করছে, তার অনেক খুঁটিই এসেছে আফ্রিকা থেকে।’

এখনো বেকার, এখনো বিশ্বাস করছি দাদুর চোখের আলোয় ইউরোপে আমার পথ আলোকিত হবে। ভক্ত আত্মাহুতি দিয়ে সম্মানিত করলে আফ্রিকীয় দেবতারা অন্তত বংশপরম্পরায় তার ইহকাল-পরকাল সুরক্ষিত রাখতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকতেন। হয়তো ইউরোপের দেবতারাও একই রকম দয়ালু হবেন। সুতরাং তিনদিন পর থেকে আবার আমি বিনা পয়সার কাগজগুলো দেখতে শুরু করলাম। একটা নতুন বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল, ‘ফরাসি ভাষা শেখার জন্য টিউটর প্রয়োজন। ডিগ্রি বাঞ্ছনীয়। যোগাযোগের নম্বর… সন্ধে ৭টার পর।’

নম্বরটা টুকে নিলাম। এবার আর বন্ধুকে কিছু জানালাম না। ও জিজ্ঞেস করত বেকারিতে আমার ইন্টারভিউ কেমন হলো এবং আমার কথা বিশ্বাস করত না। একটা বক্তৃতা শুনতে হতো, ‘তোমার মাথাটা যাচ্ছেতাই রকম খারাপ হয়েছে, লোকটাকে আমার বর্ণবিদ্বেষী মনে হচ্ছে না, ওর স্বভাব খারাপ।’

সন্ধে ৭টা বেজে ১০ মিনিটের সময় ফোন করলাম। এক মহিলা ধরল, বলল, সে স্ট্রাসবুর্গের বড় একটা সুপার মার্কেটে ক্যাশিয়ার এবং তার ১১ বছরের মেয়েকে পড়ানোর জন্য টিউটর খুঁজছে। পরদিন বিকেলে সিটি সেন্টারের এক ক্যাফেতে দেখা করতে বলল।

বিজ্ঞাপনে যেহেতু ডিগ্রির উল্লেখ ছিল, ভেবেছিলাম ছাত্র ব্যাক্কালরিয়েটের জন্য তৈরি হচ্ছে, তবু দেখা করতে রাজি হলাম – খেতে তো হবে, সে চাকরি থেকেই আসুক আর দেবতারই দান হোক।

পৌঁছে দেখি ক্যাফেতে বহু লোক কিন্তু ম্যাডাম বলে দিয়েছিল যে, তার পরনে নীল ডোরাকাটা সাদা জার্সি থাকবে, তাই তাকে পেতে সময় লাগল না। টকটকে লাল লিপস্টিক-ঘষা মহিলা ফরাসি পতাকার প্রতীক। পরিচয় দিয়ে ফোল্ডার থেকে আমার ডিগ্রির বিখ্যাত সার্টিফিকেটটা বের করে দিলাম।

কর্তব্যসচেতন ওয়েটার বন্ধুসুলভ ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে জানতে চাইল, ‘আপনাকে কী দেব ম্যাডাম?’

তাকে বললাম একটা জুস দিতে – ভাবলাম পুঁজিবাদী সমাজের মজাটা দেখো – ক্রেতার সঙ্গে জাতি-বর্ণের বৈষম্য কোথাও দেখা যাবে না। ওয়েটার আমার গ্লাস নিয়ে এলো।

মহিলা আমার উলটোদিকে বসে ছিল, সার্টিফিকেটটা নিরীক্ষণ করে ফেরত দিতে দিতে বলল, ‘আমি একজন  ইউরোপীয়কে চাচ্ছি’। তারপর চিবুকটা ওপরে তুলে যোগ করল, ‘আমি চাই না আমার বাচ্চার লেখাপড়ায় কেউ তালগোল পাকিয়ে ফেলুক।’

ম্যাডাম ফরাসি সত্যি কিন্তু ব্যাক্কালরিয়েটটাও তো পাশ করেনি এবং মেয়েকে যে পড়াতে পারবে না সেটা জানে না, তা নয়। আমাকে সে প্রত্যাখ্যান করছে আমার কালো ঠোঁটের জন্যে; কিন্তু আমার এই কালো ঠোঁট দিয়েই ফরাসি ব্যাকরণের সূক্ষ্ম নিয়মগুলো কমিয়ে বললেও তার চেয়ে ভালো করে পড়াতে পারব। রাগে জ্বলে উঠলাম, বললাম, ‘চলি ম্যাডাম, আমার মাথায় যা আছে তা তোমার মাথায় থাকলে সুপার মার্কেটে ক্যাশিয়ারের কাজটা করতে হতো না।’

মহিলা চিৎকার করে বলল, ‘এসে ড্রিঙ্কের দাম দিয়ে যাও।’

বিরক্তিতে মুখটা বেঁকে গেল আমার, বললাম, ‘না ম্যাডাম, ধরে নাও ওটা যাতায়াত খরচ। ক্যাশিয়ারের জানা থাকা উচিত, পয়সা ছাড়া কিছুই হয় না। তোমরা তো আমাদের কালো মানুষ বলো, তাদের কাজেরও কিন্তু মজুরি দিতে হয়।’

মহিলার ব্যক্তিগত অশিক্ষা আমাকে ততটা রাগিয়ে দিতে পারত না – আমি জানি এর মূলে আছে সংস্কৃতির অভাব। আমি বেশি ক্ষেপে গিয়েছিলাম কারণ মহিলাটি মিস্টার বডার্সের জঘন্য কাজটারই অনুসারী। আসলে নেতাদের নির্বুদ্ধিতা সাধারণ মানুষকে নির্বোধ করে রাখে। অন্ধ পথনির্দেশকের অনুসারীরা অন্ধকারেই পথ চলবে।

এসব ভাবতে ভাবতে ক্যাশিয়ারের চিৎকার শুনতে পেলাম, ‘যা তোর জঙ্গলে ফিরে যা।’

বর্ণবাদীদের শব্দভান্ডার বোধহয় খুব কম। আজন্ম শিক্ষার অভাবই এর কারণ হবে। একই ভাষা আমার শাশুড়িও ব্যবহার করত আর আমি বাড়ি ফিরে দেখতাম ছেলেকে বুকে আগলে রেখেছে।

পালটা জবাবে বললাম, ‘তুমিও চলে এসো আমার সঙ্গে। তাজা বাতাসে চেহারা ফিরে যাবে – রূপচর্চার খরচটা বাঁচবে।’

থলথলে পেছনটা চেয়ারে ঠেসে দিয়ে লাল ঠোঁটদুটো চেপে বিড়বিড় করতে লাগল মহিলা, মুখটা লাল হয়ে গেছে। মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলাম – সঙ্কোচ বা রাগ কোনোটাই আমার মুখের রঙে ধরা পড়ে না। আমার ত্বক সবসময়ই অন্তত নিজের সম্মানটুকু রাখতে পারে।

ক্যাফে থেকে বেরিয়ে আসছি, দেখলাম এক বয়স্ক লোক চোখ টিপে তার উলটোদিকের চেয়ারে আমাকে বসতে ইশারা করল। ওর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে চলে এলাম – আরেক নিঃসঙ্গ বয়স্ক লোক, নিজের কাছে পাওয়া মেয়েদের মাঝে-মধ্যেকার উল্লাসধ্বনি আর ঘন ঘন অশ্রুবর্ষণের মধ্যে আত্মপ্রেমে এতটাই মশগুল থেকেছে যে, পরিবার তৈরি করতে পারেনি এবং সেটাই এখন তার পরিতাপের বিষয় হয়েছে। না, ওর আমন্ত্রণ আমি  গ্রহণ করব না। হয়তো ওর চিন্তাভাবনা সেই মান্ধাতা আমলের, হয়তোবা মাকে এতটাই ভালোবাসে বা ঘৃণা করে যে, অন্য মেয়েকে সুখী করার ক্ষমতাই ওর নেই। হতে পারে সে-লোকটার মতো – বিছানায় কালো মেয়ের সঙ্গকামী অথচ পথে হাত-ধরতেও লজ্জা, একদিন হঠাৎ তার মা এসে পড়লে আমাকে ওপরতলায় গিয়ে দরজা লাগিয়ে থাকতে বলেছিল। না মশাই, আমি তোমাদের হাত থেকে নিষ্কৃতি চাই।

হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন ব্যাগ থেকে আমার এদেশে থাকার অনুমতিপত্রটি বের করেছি – পেছনে ঠিক আমার আগমনের তারিখ এবং আমার ঠিকানার মাঝখানে বড় হাতে অক্ষরে লেখা রয়েছে : বর্তমান আইনের সুযোগের মধ্যে ফ্রান্স মহানগরীতে যে- কোনো কাজ অনুমিত। কী মোহময় মরীচিকা। ভাবলাম, শেষে কেবল সরকারি বা বেসরকারি শব্দদুটোর সংযোজন দরকার ছিল।

কলেজে থাকতে ধূসর সোনালি চুলের এক মেয়ের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল। মেয়েটি বাস্তবিক অর্থেই সাদা। ডিগ্রি করার সময়টাতে ও একটা খন্ডকালীন কাজ খুঁজছিল, সেদিনই সন্ধ্যায় ওকে ফোন করে ক্যাশিয়ারের নম্বরটা দিলাম। পরদিন সন্ধ্যায় আমার ফোনের মেসেজ থেকে খুশির সুরে ওর গলা বেজে উঠল, ‘খবরটা দেওয়ার জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ, আজ সকাল থেকেই আমি মহিলার ওখানে কাজ শুরু করেছি। আর হ্যাঁ, এ-মহিলার এক প্রতিবেশী আছে, তার ঝাড়ামোছার লোক দরকার, তুমি চাইলে কাজটা নিতে পারো।’

*ফরাসি ভাষায় তু (tu) এবং ভু (vous) দুটি শব্দই ইংরেজি you অর্থে ব্যবহৃত হয়। তবে ‘তু’ সাধারণত বন্ধু বা সমকক্ষদের জন্য। এবং যেখানে ভদ্রতা বা লৌকিকতার সম্পর্ক অর্থাৎ যারা বন্ধু বা পরিবারের কেউ নয় এবং বহুবচন বোঝাতে ‘ভু’ ব্যবহার করা হয়। তবে একবার যাকে ‘তু’ সম্বোধনে কথা বলা হয়েছে, তাকে ‘ভু’ সম্বোধন করাটা ব্যঙ্গ বা অপমানের শামিল।

------------


লেখক-পরিচিতি

সেনেগালি লেখক ফাতু দিয়মের জন্ম ১৯৬৮ সালে। তিনি ফ্রান্সের স্ট্রাসবুর্গ ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করেছেন এবং বর্তমানে ওই ইউনিভার্সিটিতেই শিক্ষকতা করছেন। এছাড়া তিনি ফ্রেঞ্চ টেলিভিশনের FR- এ একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সঞ্চালক হিসেবে কাজ করছেন। তাঁর দুটি উপন্যাস আছে – The Belly of The Atlantic এবং Ketala । তিনি এখানে ফ্রান্স ও আফ্রিকার সম্পর্ক উন্মোচন করেছেন। LA Preference Nationale নামে তাঁর একটি গল্প-সংকলনও রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.