কোচিং ব্যবসা এবং শিক্ষার বেহাল দশা by সুলতান মাহমুদ রানা

শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকের পাঠদান প্রক্রিয়া নিরবচ্ছিন্নভাবে পালনের ব্যবস্থা করতে হবে। সে জন্য প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠানপ্রধানের নেতৃত্বে একটি মনিটরিং সেল গঠন করা যেতে পারে। সরকারের উচিত হবে, আইন করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা কোচিং ও প্রাইভেট সেন্টারগুলো বন্ধ করে দেওয়া অথবা নির্দিষ্ট কিছু সীমাবদ্ধতা কিংবা শর্তারোপ করা। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে ছোট ছোট কোচিং সেন্টার কিংবা প্রাইভেট হোম। কোচিং সেন্টারের নামে এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সমাজের জন্য কতটুকু কল্যাণকর তা সবারই কম-বেশি জানা।

এ ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রভাবে এ দেশের শিক্ষা কাঠামোতে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে তা থেকে দ্রুত উত্তরণ না ঘটাতে পারলে এ জাতি ও সমাজ নীরবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হতে পারে। বিশেষ করে পড়াশোনার ক্ষেত্র দিন দিন অনেকটাই কোচিংনির্ভর হয়ে উঠছে। এতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হারিয়ে ফেলছে তার ঐতিহ্য ও স্বকীয়তা। এসব কোচিং সেন্টারের নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অনেক আগে থেকেই নানাবিধ অপকর্ম সংঘটিত হয়েছে, যা আমরা ইতিমধ্যেই মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পেরেছি। প্রশ্ন হতে পারে, শুধু কি কোচিং বা প্রাইভেট ব্যবসার কারণেই এ ধরনের কর্মকাণ্ড ঘটছে? না, এর বাইরেও কিছু ঘটনা ঘটছে, যার সঙ্গে কিছু অসভ্য শিক্ষক জড়িত। যাদের চিহ্নিত করে যথাযথ বিচারের আওতায় নিয়ে আসা সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যে বেতন কাঠামো, তা একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীর বেতনের কাছাকাছি। সমাজে সম্মান ও মর্যাদার দিক থেকে শিক্ষকরা নিশ্চয়ই এক ধাপ এগিয়ে। আর এই এক ধাপ এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে তাদের জীবনযাত্রাও এক ধাপ এগিয়ে থাকার কথা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে একজন শিক্ষক তার বেতন কাঠামো বিচারে কোনোভাবেই সমাজে এগিয়ে থাকতে পারেন না। এমনকি একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককে তার পেশার সঙ্গে অসামঞ্জস্য দায়িত্বও পালন করতে হয়। তিনি প্রতিদিন সকালে পাঠদানের জন্য বিদ্যালয়ে গিয়ে প্রথমেই বিদ্যালয় পরিষ্কারের জন্য ঝাড়ূ দেওয়া থেকে শুরু করে এ ধরনের নানাবিধ দায়িত্ব পালন করে থাকেন, যে কাজগুলো একজন শিক্ষক হিসেবে তার জন্য কোনোক্রমেই মানানসই নয়। একদিকে তার নিম্নমানের বেতন কাঠামো অন্যদিকে পেশার সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন কর্মর্_ এ দুয়ের ফল যেমন জাতির জন্য লজ্জাজনক, তেমনি মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে পরিচিত গোটা শিক্ষক সমাজের জন্যও। আমরা সবাই জানি, একটি শক্তিশালী ইমারত নির্মাণের পূর্বশর্ত হলো শক্তিশালী ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন। ভিত্তিপ্রস্তর যদি দুর্বল হয় তাহলে কোনোক্রমেই শক্তিশালী ইমারত নির্মাণ সম্ভব নয়। এমন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে আমাদের দেশের নিম্নস্তরের শিক্ষা কাঠামোতে। এ কাঠামোর প্রাথমিক স্তরে শিক্ষকতা করার নূ্যনতম যোগ্যতা মেয়েদের জন্য মাধ্যমিক শ্রেণী পাস, যা শিক্ষা কাঠামোরও নূ্যনতম স্তর। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগে দেখা যায়, মাধ্যমিক পাস থেকে শুরু করে মাস্টার্স ডিগ্রিধারীরা অংশগ্রহণ করছেন এবং একই মান-মর্যাদার ভিত্তিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবস্থান করছেন। মাধ্যমিক পাস শিক্ষক এবং মাস্টার্স পাস শিক্ষক_ দু'জনেই একই বেতন কাঠামো ও একই মর্যাদা নিয়ে চাকরি করছেন। প্রমোশন, আপগ্রেডেশন কোনো পদ্ধতিই এসব শিক্ষকের জন্য প্রযোজ্য নেই। মাধ্যমিক পাস ও মাস্টার্স পাসের মান নিশ্চয়ই সমান নয়। অতএব এ বিষয়ে কতটা সমতা বিধান করা যায়, সেদিকে একটু বিশেষ নজর দেওয়া দরকার। আশা করা যায়, নতুন শিক্ষানীতিটি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে এ সমস্যার কিছুটা সমাধান হবে।
এবার মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের বেহাল দশার সামান্য নমুনা দেওয়া যাক। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের অবস্থা ও পড়াশোনার গুণগত দিক বিচার করলে দেখা যায়, প্রাথমিকের তুলনায় মাধ্যমিক কোনো অংশেই এগিয়ে নেই। যদিও সেখানে শিক্ষকতা করার যোগ্যতা বিচারে খুব বেশি পার্থক্য নেই, যেমনটা প্রাথমিক স্তরের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়। তবুও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের মান-মর্যাদা, বেতন-ভাতা নিয়ে নানা অভিযোগের কথা আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। এসব অভাব-অনটন, দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে জাতির ভবিষ্যৎ গড়ার কাজে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উলি্লখিত করুণ দশার কথা বিবেচনা করলে কোচিং ব্যবসার কথা কিছুটা গ্রহণযোগ্য হিসেবে ধরা যায়। অন্যদিকে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক পরিমলের মতো জঘন্য আচরণের কথা বিবেচনা করলে সেটা নিশ্চয়ই গ্রহণযোগ্য বা শোভনীয় হবে না বলে মনে হয়।
শিক্ষক যখন ক্লাসে পাঠদানে অলসতা করে তার পাঠদান ক্ষেত্রটি কোচিং সেন্টারে তৈরি করেন তখন নিশ্চয়ই সেটা তার ন্যায্য আচরণ হতে পারে না। বর্তমান সময়ে দেখা যাচ্ছে, সরকারি কলেজের অনেক শিক্ষকই কোচিং ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। আমি জানি না, তারা সরকারের অনুমোদন নিয়ে এসব ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, নাকি অনুমোদন ছাড়াই। সরকার যদি অনুমোদন দিয়েই থাকে, তবে সেটার মধ্যেও কিছু সীমাবদ্ধতা থাকা উচিত বলে মনে হয়। আর অনুমতি না থাকলে সেগুলো দ্রুত বন্ধ করা উচিত। একজন শিক্ষক যখন সচ্ছলতার সঙ্গে জীবন যাপন করতে পারেন না, তখনই তিনি অন্য পেশায় মনোনিবেশের চেষ্টা করেন। আর তার জন্য সবচেয়ে সহজ এবং পুঁজিহীন ব্যবসা হিসেবে কোচিং ব্যবসা সুবিধাজনক। একজন শিক্ষকের পরিবারে সচ্ছলতা যদি না থাকে, তাহলে এর প্রভাব সংশ্লিষ্ট শ্রেণীকক্ষেও পড়ে। এ জন্য মাঝেমধ্যেই অনেক শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের ওপর অমানবিক শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন চালাতে দেখা যায়, যা বন্ধ করার জন্য সরকারকে ইতিমধ্যেই আইন করতে হয়েছে। আর এসব অভাব-অনটন থেকেই শিক্ষকরা কোচিং ব্যবসার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন এবং ক্লাস ফাঁকি দিয়ে শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ে আসতে বাধ্য করেন। বর্তমানে প্রাথমিক থেকে শুরু করে সম্মান শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ের দিকে অধিক পরিমাণে ঝোঁক দেখা যাচ্ছে। সরকার যদিও পাঠ্যক্রমের এমন পরিবর্তন সাধন করেছে, যার ফলে কোচিং ব্যবসার বারোটা বাজার কথা। কিন্তু তা সত্ত্বেও দিনের পর দিন এ ব্যবসা বেড়েই চলেছে, যার নানাবিধ নেতিবাচক প্রভাব শিক্ষা কাঠামো তথা সমাজ কাঠামোর ওপর পড়ছে।
সরকারের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকের পাঠদান প্রক্রিয়া নিরবচ্ছিন্নভাবে পালনের ব্যবস্থা করতে হবে। সে জন্য প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠানপ্রধানের নেতৃত্বে একটি মনিটরিং সেল গঠন করা যেতে পারে। সরকারের উচিত হবে, আইন করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা কোচিং ও প্রাইভেট সেন্টারগুলো বন্ধ করে দেওয়া অথবা নির্দিষ্ট কিছু সীমাবদ্ধতা কিংবা শর্তারোপ করা। এমনকি সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি অনুদানে পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের জন্য কোচিং সেন্টারে অংশগ্রহণের ব্যাপারে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা আবশ্যক। তাই বর্তমান মহাজোট সরকারের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, প্রকৃত অর্থে দেশ গড়তে চাইলে শিক্ষকদের মানোন্নয়ন, শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে উন্নয়ন সাধনে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই শিক্ষাক্ষেত্রে বাঙালি জাতির কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া সম্ভব হবে।
=======================
গল্প- লঞ্চের আপার ক্লাসে বাচ্চা হাতি  গুরুপল্লির আশ্রমে ভর্তি না হয়েই  মুক্তিযুদ্ধের ১০ বই  মগ্নচৈতন্যের বর্ণময় অভিঘাত  গল্প- চিনেজোঁক  পুস্তক প্রকাশনা ও বাংলা একাডেমীর বইমেলা  শাহি মনজিলে সাহিত্য উৎসব by শাহীন আখতার  বাজে জসীমউদ্দীন  নান্দনিক চৈতন্য  গ্রামকে শহরে এনেছি  গল্প- জলঝড়  একাত্তরের অপ্রকাশিত দিনপঞ্জি  রশীদ করীমে'র সাক্ষাৎকার- 'মনে পড়ে বন্ধুদের'  প্রাচ্যের ছহি খাবনামা  গল্প- এভাবেই ভুল হয়  গল্প- মাঠরঙ্গ  ফয়েজ আহমেদঃ স্মৃতিতে চিঠিতে  অরুন্ধতী রায়ের সাক্ষাৎকারঃ উপন্যাসের জগতের জগতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই  ইতিহাস ও জাতি দিয়ে ঘেরা  গল্প- চাল ডাল লবণ ও তেল  ক-য়ে ক্রিকেট খ-য়ে খেলা  গল্পসল্প- ডাংগুলি  হ্যারল্ড পিন্টারের শেষ সাক্ষাৎকারঃ আশৈশব ক্রিকেটের ঘোর  সূচনার পিকাসো আর ভ্যান গঘ  আল্লাহআকবরিজ সি সি  গল্প- কবি কুদ্দুস ও কালনাগিনীর প্রেম  গল্পসল্প- আমার বইমেলা  বাংলাদেশ হতে পারে বহুত্ববাদের নির্মল উদাহরণ  শিক্ষানীতি ২০১০, পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি এবং জাতীয় স্বার্থ  চীন-ভারত সম্পর্ক এবং এ অঞ্চলে তার প্রভাব  নারী লাঞ্ছনার সর্বগ্রাস  একজন এস এ জালাল ও মুক্তিযুদ্ধের তথ্যভাণ্ডার  গল্প- স্বপ্নের মধ্যে কারাগারে  গল্পিতিহাস- কাঁথা সিলাই হইসে, নিশ্চিন্ত  ‘এখন প্রাধান্য পাচ্ছে রম্যলেখা'  অকথিত যোদ্ধা  কানকুনের জলবায়ু সম্মেলন, বাংলাদেশের মমতাজ বেগম এবং আমার কিছু কথা  নাপাম বোমা যা পারেনি, চ্যালেঞ্জার ও আব্রাম্‌স্‌ ট্যাংক কি তা পারবে?  ঠাকুর ঘরে কে রে...!  ষড়যন্ত্র নয়, ক্ষুধা ও বঞ্চনাই আন্দোলনের ইন্ধন  বাহাত্তরের সংবিধানের পুনঃপ্রতিষ্ঠায় বাধা কোথায়?  ড.ইউনূসের দুঃখবোধ এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা  গীতাঞ্জলি ও চার্লস এন্ড্রুজ  গল্প- তেঁতুল  একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের পুস্তক প্রকাশনা  গল্প- বট মানে গরুর ভুঁড়ি


দৈনিক সমকাল এর সৌজন্যে
লেখকঃ সুলতান মাহমুদ রানা


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.