স্বস্তি হয়ে এল হারারের মিঠে রোদ

প্রায় মধ্যরাতে হোটেলে ঢুকে এক দিন পরই নেমে পড়তে হচ্ছে ম্যাচ খেলতে। এটা যদি অস্বস্তির কাঁটা হয়, স্বস্তির সুবাতাস বয়ে এনেছে হারারের মিঠে রোদ।
গ্রীষ্মকে বিদায় জানিয়ে জিম্বাবুয়ে শীতকালে ঢুকে পড়েছে বেশ কিছুদিন আগেই। দেশে থাকতেই সেই শীতের কাঁপুনি আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল ক্রিকেটারদের। প্রথম আলোয় লেখা নিজের কলামে ‘ঠান্ডায় আমাদের বড় সমস্যা হয়’ জানিয়ে অধিনায়ক সাকিব আল হাসান প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, জিম্বাবুয়ের চেয়েও আবহাওয়াকে কম বড় প্রতিপক্ষ মনে করছেন না।
বৃহস্পতিবার রাতে হারারে বিমানবন্দরে নামার সময় ‘মাটিতে তাপমাত্রা এখন ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস’ ঘোষণাটা তাই বড় মধুর শুনিয়েছে সবার কানে। কাল দুপুর যায়-যায় বিকেলে শীতের মিঠে রোদ গায়ে মেখে অনুশীলনের সময় ঠান্ডা নিয়ে দুশ্চিন্তাটা মোটামুটি উধাও। সন্ধ্যার পর পারদ একটু নামবে, তবে দুপুরে সেটি ২৩-২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঘরে। স্টুয়ার্ট ল যেটিকে বলছেন, ‘ক্রিকেট খেলার জন্য আদর্শ তাপমাত্রা।’
একটা দুশ্চিন্তা আপাতত গেল। তবে দেশ থেকে বয়ে নিয়ে আসা আরেকটি এখনই নয়। কুঁচকির সমস্যা তামিম ইকবালকে প্রস্তুতি ম্যাচটা খেলতে দিচ্ছে না। কাল সকালে সাকিব নিশ্চিত করেছিলেন তামিম খেলবে। কিন্তু টেস্টের জন্য ঝুঁকি হয়ে যাবে ভেবে পরে সিদ্ধান্ত বদলানো হয়। অপ্রত্যাশিত দিক থেকে ধেয়ে আসা দুশ্চিন্তা অবশ্য পুরো যাত্রাপথেই তাড়া করে ফিরেছে বাংলাদেশ দলকে। দোহা বিমানবন্দরে আটকে পড়ে আন্তর্জাতিক সংবাদ হয়ে যেতে যেতে শেষ মুহূর্তে বিমানে ওঠার অনুমতি মিলেছে। আটকে দিয়েছিল কাতার এয়ারওয়েজ। তবে দোষটা তাদের নয়, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের। বছর খানেক আগে থেকেই দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে জিম্বাবুয়ে যেতে যে ট্রানজিট ভিসা লাগে, সেই খবরটা না রেখে দলকে বিমানে তুলে দেওয়া যদি বিসিবির অপেশাদারি মনোভাবের প্রমাণ না হয়, তাহলে শব্দটার অর্থ নতুন করে জানতে হবে।
শেষ পর্যন্ত উদ্ধার মিলেছে প্রিটোরিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের তৎপরতায়। জোহানেসবার্গ বিমানবন্দরে ট্রানজিট ভিসাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে এসেছিলেন দূতাবাসের দুই কর্মকর্তা। তরুণ সেকেন্ড সেক্রেটারি শাহাব-বিন-আহমেদ জানালেন, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল যে দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে যাচ্ছে, সেটি তাঁরা জানতে পেরেছেন সকালে দল দোহায় আটকা পড়ার পর। তিনিই জানালেন, ভিসার ঝামেলা থাকলে মন্ত্রী-টন্ত্রীকেও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। সকালে দক্ষিণ আফ্রিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত একটা সভা ছিল বলে বাঁচোয়া।
২০১০ বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় থেকে এই ট্রানজিট ভিসার নতুন নিয়মটা হয়েছে। আফ্রিকার অন্য কোনো দেশে যেতে সমস্যা নেই। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে প্রতিবেশী ছয় দেশ জিম্বাবুয়ে, নামিবিয়া, বতসোয়ানা, মোজাম্বিক, সোয়াজিল্যান্ড ও লেসোথো যেতে ট্রানজিট ভিসা লাগবেই। নিয়মটা করা হয়েছে ‘আফ্রিকা মহাদেশের আমেরিকা’ দক্ষিণ আফ্রিকায় অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে। অনেকে দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে এসব দেশে গিয়ে সুযোগমতো আবার দক্ষিণ আফ্রিকায় ঢুকে যায়। বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা এমন কিছু করতে পারেন—এই সন্দেহ অবশ্যই কেউ করেনি। কিন্তু নিয়ম নিয়মই। সেটি তুমি আবদুর রহিম হও বা সাকিব আল হাসান!
আজ শুরু তিনদিনের প্রস্তুতি ম্যাচে বাংলাদেশ দল অবশ্য একটু নিয়ম ভাঙতে চায়। টেস্ট ম্যাচের আগে একমাত্র প্রস্তুতি ম্যাচ। কিন্তু এটিকে টেস্টের সম্ভাব্য একাদশের প্রস্তুতির বদলে একাদশ গড়ার প্রস্তুতি পর্ব হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশের অধিনায়ক ও কোচ। ইচ্ছা সব ব্যাটসম্যান যেন ব্যাটিং করার সুযোগ পান, সব বোলার বোলিং। বাংলাদেশের জন্য সফরটিকে যতটা সম্ভব কঠিন করার চেষ্টা করে আসা জিম্বাবুয়ে এই ইচ্ছা পূরণ করবে কি না, সেটি কাল বিকেল পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে বাংলাদেশ দল কদিন আগে আসতে চেয়েছিল, জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট বাড়তি কদিনের জন্য অবিশ্বাস্য একটা অঙ্ক দাবি করে আসতে দেয়নি। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের যেকোনো সফরেই ‘ওরা গেলে আমরা কী করি, আর ওরা আমাদের কী করছে’ অনুযোগ শোনা যায়। আতিথেয়তার চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে বিসিবি ইংল্যান্ড দলকে টেস্ট ভেন্যুতে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলার সুযোগ করে দেয়। নিউজিল্যান্ডকে অনুশীলন করতে দেয় সেন্টার উইকেটে। বিমানবন্দরে সাদর অভ্যর্থনার ব্যাপারটা তো আছেই। পরশু বাংলাদেশ দলকে ‘বরণ’ করতে বিমানবন্দরে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের একজন মাত্র কর্মকর্তা। টেস্ট ভেন্যুতেই প্রস্তুতি ম্যাচ শুনে সকালে খুবই সন্তোষ প্রকাশ করা স্টুয়ার্ট ল দুপুরেই জেনেছেন, হারারে স্পোর্টস ক্লাব মাঠে নয়, ম্যাচটা হবে একাডেমির মাঠে।
একটা ব্যাপার অবশ্য খেলোয়াড়দের সকালেই পরিষ্কার বলে দিয়েছেন নতুন কোচ। দীর্ঘ যাত্রাপথ, এক দিন পরই ম্যাচ খেলতে নেমে পড়া—কেউ যেন ভুলেও এসবকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা না করে। ‘তুমি পেশাদার ক্রিকেটার, তোমাকে যেকোনো পরিস্থিতিতে সেরাটা দিতে হবে’—বাংলাদেশ দলের এই মন্ত্রটা সাকিব আল হাসানও সাংবাদিকদের শুনিয়ে গেছেন এর আগেই। প্রথম কোনো দলের হেড কোচের দায়িত্ব পাওয়া স্টুয়ার্ট ল-কে স্বাভাবিকভাবেই খুব রোমাঞ্চিত মনে হচ্ছে। বাংলাদেশ দলের সবাইকে নামে চেনার কাজটা যা ভেবেছিলেন তার চেয়ে সহজে করে ফেলতে পেরেও খুব খুশি মনে হলো তাঁকে। ‘শ্রীলঙ্কান প্লেয়ারদের সবাইকে চিনতে আমার ছয় সপ্তাহ লেগেছিল। ওরা নিকনেমে একে অন্যকে ডাকে, হঠাৎ বলে আসল নামটা। খুব সমস্যা হয়েছিল।’
বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের সবার মুখে কোচের ‘ইতিবাচক মনোভঙ্গি’র সুনাম। সেটির প্রমাণ পাওয়া গেল ৪০ ঘণ্টার বেশি পথে কাটানো প্রসঙ্গেও। ল হাসতে হাসতে জানালেন, গত বছর শ্রীলঙ্কা দলের সঙ্গে ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে মায়ামি হয়ে জিম্বাবুয়ে পৌঁছাতে ৫৮ ঘণ্টা লেগেছিল!

No comments

Powered by Blogger.