অব্যবস্থাপনার লোকসান পুষিয়ে নিতে ৬৯ কোটি টাকা ভর্তুকি!

বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি মসুর ডাল গুদামজাত করেছিল সরকারি বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। সেই মসুর ডাল কম মূল্যে বিক্রি করে সম্প্রতি গুদামের ভার কিছুটা কমিয়েছে সংস্থাটি।
বিস্ময়কর যে এই ডাল কেনা হয়েছিল বাজারদরের চেয়ে বেশি দামে। ডিলাররা টিসিবি থেকে চিনি ও ভোজ্যতেল নিতে রাজি হলেও পোকামাকড়ে ভরা এই মসুর ডাল নেওয়ার ক্ষেত্রে অপারগতা জানান। কারণ, খুচরা বাজারে যে মসুর ডাল ৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল, তা টিসিবি ডিলারদের কাছে ৯২ টাকা কেজি দরে গছাতে চাইছিল।
জানা গেছে, শুধু মসুর ডাল নয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় আরও কয়েকটি পণ্য সংগ্রহে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে সরকারি অর্থের যে অপচয় হলো, তা পুষিয়ে নিতে এবার আয়োজন করা হয় ভর্তুকির। চার পণ্যে সম্প্রতি ৬৯ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে ৬৩ কোটি টাকাই মসুর ডালে। আমদানি করা ও স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা—দুই ধরনের মসুর ডালেই ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। বাকি ছয় কোটি টাকা চিনি, সয়াবিন তেল ও ছোলার ক্ষেত্রে দেওয়া হয়।
টিসিবির এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পাস হয়ে এসেছে গত ২৯ জুন।
এর আগে ২৬ জুন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, টিসিবি বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে কাজ করে চলেছে। বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে টিসিবি অনেক ক্ষেত্রেই পণ্য বাজারজাত করেছে ক্রয়মূল্য ও আনুষঙ্গিক ব্যয় বিবেচনায় না রেখেই। এতে টিসিবি যে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, তা পূরণ করা দরকার।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, স্থানীয়ভাবে ক্রয় ও আমদানি করা চার পণ্য টিসিবি সাশ্রয়ীমূল্যে বিক্রির কারণে ৬৯ কোটি টাকার বেশি ভর্তুকির দরকার।
সাধারণত ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রতিবার খুঁটিনাটি বিচার-বিশ্লেষণ করা হলেও অর্থ মন্ত্রণালয় এবার আর তা করেনি। কোনো কাটছাঁট না করেই মাত্র তিন দিনের মাথায় অর্থ মন্ত্রণালয় পুরো অর্থই বরাদ্দ দেওয়ার উদাহরণ তৈরি করেছে।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, এবারের ভর্তুকির জন্য একটি চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট ফার্ম থেকে নিরীক্ষা করা হয়েছে। তাই তেমন একটা বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়নি।
পণ্যভেদে ভর্তুকির পরিমাণ হচ্ছে: আমদানি করা মসুর ডাল ৩৩ কোটি ২০ লাখ ৭২ হাজার টাকা, স্থানীয়ভাবে ক্রয় করা মসুর ডাল ৩১ কোটি এক লাখ ২৯ হাজার টাকা, স্থানীয়ভাবে ক্রয় করা চিনি তিন কোটি টাকা, আমদানি করা ও স্থানীয়ভাবে ক্রয় করা সয়াবিন তেল ৪৫ লাখ টাকা, আমদানি করা ছোলা এক কোটি ৩৩ লাখ ৫৬ হাজার টাকা।
তবে টিসিবির কর্মকর্তারা বলছেন, বিপুল অঙ্কের এই টাকা ভর্তুকি দেওয়া হলেও তাতে ভোক্তা সাধারণের কোনো লাভ হবে না। নানা কৌশলে ইতিমধ্যে যাঁরা নিজেদের পকেট ভারী করেছেন, এবারের ভর্তুকির বন্দোবস্তটি করা হয়েছে তা জায়েজ করার জন্য।
উদাহরণ দিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, প্রকৃত সমস্যা কোথায়, খুঁজে বের করা দরকার। বাণিজ্যমন্ত্রীর নির্দেশে ১০৬ টাকা কেজি দরে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কাছে ১৮৩ টন মসুর ডাল বিক্রি করেছিল টিসিবি। এতে টিসিবির কিছু মুনাফা হয়। সংস্থার তৎকালীন চেয়ারম্যান খলিলুর রহমানকে এ জন্য কারণ দর্শাও নোটিশ দিয়েছিলেন বাণিজ্যসচিব মো. গোলাম হোসেন। খলিলুর রহমান তখন বাণিজ্যসচিবকে জানিয়েছিলেন, ‘বিক্রি ও বিতরণের ক্ষেত্রে টিসিবিই ক্ষমতাবান। তাছাড়া অতীতে এ রকম ক্ষেত্রে কখনোই মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেওয়া হয়নি।’
গতকাল শনিবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে বাণিজ্যসচিব গোলাম হোসেন ব্যস্ততার কথা জানিয়ে কথা বলতে চাননি।
তবে বাণিজ্যমন্ত্রী মুহাম্মদ ফারুক খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দাম বেশি থাকার কারণেই গত বছর কিছু পণ্য বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়েছিল। বাজারমূল্য স্থিতিশীল রাখতে ভূমিকা পালনের স্বার্থেই তাই ভর্তুকির বিষয়টি এসেছে, অন্য কোনো কারণ নেই।’
বাণিজ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ‘প্রতিবেশীসহ বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশে নিত্যপণ্যের দাম কম। সরকারি নানা উদ্যোগের কারণেই তা সম্ভব হয়েছে।’

No comments

Powered by Blogger.