স্নেহময়ী সুন্দরবন by মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান

পৃথিবীর একাধিক বনাঞ্চল আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। আজ থেকে ৩০ বছর আগে রিও-ডি-ইনেইরো গিয়ে বেশ কিছু বন পেরিয়ে আমি কুব্জপর্বত কর্কোভাদোর যিশু খ্রিষ্টের ভাস্কর্য দেখতে যাই। ২০ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের বালিংটনের বনে আমেরিকার পাতা-ঝরার সৌন্দর্য দেখলাম। সেই সমুজ্জ্বল ফল সঙ্গে করে জাতীয় বন উত্তর ক্যারোলিনায় গেলাম। বছর ১৩ আগে আমি পাপুয়া নিউগিনির বনাঞ্চলে যাই সেখানে অনুষ্ঠিত নির্বাচন পরিদর্শন করার জন্য। সে বনে হাতি, বানর বা বাঘ নেই, কিন্তু জলে কুমির বাস করে, সুন্দরবনের মতো কিছুই নয়। আমি সুন্দরবনে যাই দুইবার। প্রথমবারেই আমি বাঘের দেখা পাই। মধ্যাহ্নের আহার শেষে বাঘটি হোগলার পাশে রোদ পোহাচ্ছিল।
বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের মধ্যে স্থান পাওয়া উচিত। সুন্দরবন পৃথিবীর বৃহত্তম জোয়ারবিধৌত গরান বনভূমি। ওই বনের আয়তন ১০ হাজার বর্গকিলোটাির। ২০০ বছর আগে এর আয়তন ছিল প্রায় ১৬ হাজার ৭০০ বর্গকিলোমিটার। মানুষের আগ্রাসনে বর্তমানে সংকুচিত হয়ে এসেছে। বনের দুই-তৃতীয়াংশ আমাদের, বাকিটা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের। এখানে প্রায় ৫০০টি রয়েল বেঙ্গল বাঘ এবং ৩০ হাজার হরিণ রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের হরিণ, হাঙ্গর, কুমির, বাঁদর, পখি, পতঙ্গ, পাইথন সাপসহ সরীসৃপ, ৩০০ শ্রেণীর উদ্ভিদ, ২১৭ রকম পাখি, ১৪ রকমের জলজ প্রাণী, ৪২ রকম বন্যপ্রাণী এবং ২০১০ রকম মাছ রয়েছে। ১৮৭৫ সালে একে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। ১৯৭৭ সালে একে বিশ্ব উত্তরাধিকার হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। এই বন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ছয় লক্ষ লোকের জীবিকার উৎস। সিডর ও আইলায় বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সুন্দরবন অত্যন্ত দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
জোয়ারভাটা, জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততার কারণে সুন্দরবনের মাটি বাংলাদেশের ভেতরের মাটির চেয়ে আলাদা। এখানকার উদ্ভিদকুলও আলাদা। জলবায়ুর দিক থেকে সুন্দরবন উষ্ণমণ্ডলীয় আর্দ্র বনভূমি হিসেবে চিহ্নিত।
মানুষের আগে বনের জন্ম। মানুষের হামলায় বন ধীরে ধীরে পিছে হটে যাচ্ছে। আমাদের দেশে একটা কথা আছে, বন রাখে বাঘে, বাঘ রাখে বনে। বাঘ আর বনের মধ্যে যে সহ-অবস্থানের সৃষ্টি হয়েছে, তার ফলে পরিবেশে একটা ভারসাম্য রক্ষা হয়। মালয়দেশের প্রবাদে একটা কথা আছে, একটা গাছ যত বড়ই হোক, তার ঝরাপাতা তার শেকড়ের কাছে ফিরে আসে। এই ধরনের প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে একটা নিরন্তর নবায়ন ঘটে।
মানুষের প্রাথমিক পঞ্চ প্রয়োজন—অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসার মধ্যে চারটিরই উৎস উদ্ভিদ। উদ্ভিদ পরিবেশের মক্ষীরানী। সেই উদ্ভিদকে আমরা পোষ মানাই ও আদর-যত্ন করি এবং প্রতিদানে আমরা অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয় ও ওষুধ পেয়ে থাকি। উদ্ভিদ শিশুর মতো মেজাজি, যুবকের মতো দেমাকি এবং বৃদ্ধের মতো অনুকম্পাপ্রার্থী। পরিবারের একজন ভেবে তাকে আমাদের যথোপযুক্ত যত্নআত্তি করতে হবে।
কোরআনে বলা হয়েছে, যারা বিশ্বাস করে, তাদের জন্য গাছপালা ও ফল-ফলাদিতে আল্লাহর নিদর্শন রয়েছে। গাছ লাগানো এমন একটা সাদকা-ই-জারিয়া, যার ফজিলত বৃক্ষরোপকের মৃত্যুর পরও অক্ষুণ্ন থাকে। নিজের প্রয়োজনেও গাছ লাগালে তাও এক সদ্কর্ম।
বুদ্ধ বলতেন, ‘অরণ্য একটা অসামান্য জীব। অপরিসীম দয়া ও বদান্যতার আধার। প্রতিদানের প্রত্যাশা না করে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার মাঝেই তার আনন্দ। নিজের জীবনধারণের জন্য সৃষ্ট উপাদানগুলোও সে বিলিয়ে দেয় অন্যের প্রয়োজনে। এমনকি যে কাঠুরে তাকে ধ্বংস করে, তাকে ছায়া দিতে সে কার্পণ্য করে না।’
রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘সমস্ত জীবের অগ্রগামী গাছ, সূর্যের দিকে জোড় হাত তুলে বলছে, আমি থাকব, আমি বাঁচব, আমি চিরপথিক, মৃত্যুর পর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অন্তহীন প্রাণের বিকাশতীর্থে যাত্রা করব রৌদ্রে-বাদলে, দিনে-রাত্রে।’
স্যার জগদীশ বসু, ঢাকার বিক্রমপুরের সন্তান, রবীন্দ্রনাথের সুহূদ ছিলেন। তিনিই প্রথম মেটাল-ফ্যাটিগের ওপর গবেষণা করতে গিয়ে লক্ষ করেন গাছেরও প্রাণ আছে। আজকাল শোনা যাচ্ছে গাছপালা গান শুনতেও নাকি ভালোবাসে।
মানুষের শক্তি এবং তার ষড়রিপুর দৌর্বল্যের কথা ভেবে আমাদের সৃষ্টিকর্তা আমাদের পরিপোষণের জন্য বৃক্ষ, লতাপাতা, গুল্মসমেত উদ্ভিদজগতকে তাঁর কর্মবিধায়ক হিসেবে নির্বাচন করেছেন। আমাদের দেশে একটা কথা আছে, যে দেশের রোগ সেই দেশের গাছগাছড়ায় তার নিরাময়।
অমিতাভ ঘোষের দ্য হাঙ্গরি টাইড (২০০৪) এবং সালমান রুশদির দ্য মিডনাইটস চিল্ড্রেন (১৯৮১)-এ সুন্দরবনের উল্লেখ রয়েছে। আমাদের জীবন ধারণের জন্য সুন্দরবন আমাদের নানা দিকের সাশ্রয়। শুধু গোলপাতা, কাঠ, মধু, মাছ বা মোম-জাতীয় পণ্যের জন্য নয়, দেশের উদ্ভিদবৈচিত্র্য ও প্রাণিবৈচিত্র্যের সংরক্ষণের জন্য সুন্দরবনকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, সুন্দরবন গত আইলায় আরও বড় ক্ষতি ও সংহারের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করেছিল।
ইউনেসকোর এক প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক প্রজন্ম জল, বায়ু ও মৃত্তিকাসম্পদ পৃথিবীতে যে বিশুদ্ধ ও অবিপর্যস্ত অবস্থায় পেয়েছিল, সে অবস্থায় রেখে যাব।’ আমাদের অব্যবহিত পূর্বের পূর্বসূরিদের দৌরাত্ম্যে সুন্দরবন সংকুচিত হয়ে গেছে। আমাদের বর্তমান প্রজন্ম যে অবস্থায় সুন্দরবনকে পেয়েছে, অন্তত সে অবস্থায় যেন তারা রেখে যায়।
সুন্দরবনের পরিবেশ ও জীবিকার নিরাপত্তার জন্য সরকার ১.২৮ বিলিয়ন টাকার একটা প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এই প্রকল্পে সরকারি ঘোষণার থেকে তিন কোটি সত্তর লাখ এবং ইউরোপীয় কমিশন থেকে আসবে নয় কোটি ১০ লাখ টাকা। জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিল গত ১১ জানুয়ারি তা অনুমোদন করেছে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। আমরা সেই প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি ও সাফল্য কামনা করি।
সুন্দরবন কেবল গাওয়া, গরান, সুন্দরী উদ্ভিদকুলের জন্য নয়, কেবল বাঘ, হরিণ, সাপ, মৌমাছি, প্রজাপতি, প্রাণী-পতঙ্গের জন্য নয়, কেবল বাওয়ালি-মৌয়ালির জন্য নয়, সুন্দরবন সব বাঙালির জন্য, সুন্দরবন আমাদের জন্য স্নেহময়ী।
যাঁরা প্রকৃতির উদ্ভিদ পশু-পাখি-পতঙ্গের বৈচিত্র্য ভালোবাসেন, তাঁরা নিশ্চয় সচেষ্ট হবেন যেন সুন্দরবন প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্যের তালিকায় শীর্ষস্থানে স্থান পায়। ভোটের যুগে ভোটের দাম আছে। আমরা ভোটার হিসেবে আমাদের সংখ্যা বেশি। জনসংখ্যার বদৌলতে আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে শুধু রাষ্ট্রভাষা করিনি, আমরা বাংলাদেশকে একটা সার্বভৌম রাষ্ট্রও করেছি। ভোটে জিতলেই যে সব কাজ হয় না, তা আমাদের মাতৃভাষার বর্তমান অবস্থা দেখলে সহজেই অধিগম্য হবে। সুন্দরবনের ব্যাপারে ভোট দিয়ে ক্ষান্ত হলে চলবে না। পর্যটন বা অন্যান্য ব্যবসার কথা না ভেবে নিজেদের মঙ্গলের জন্য এর পরিচর্যা, শুশ্রূষা বা উন্নতিবিধান করতে হবে, যাতে সুন্দরবন সুস্থভাবে বেঁচে থেকে প্রাণদায়িনী হিসেবে আমাদের সুরক্ষা করে।
>>>মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা। সাবেক প্রধান বিচারপতি।

No comments

Powered by Blogger.