তোমাদের এই হাসিখেলায় by মুস্তাফা জামান আব্বাসী

কিছুদিন আগে এক রাতে বকুলতলায় প্রথমবারের মতো গান শোনাতে গেলাম। লোকে লোকারণ্য। গ্রাম থেকে এসেছেন শত শত লোকশিল্পী। হাতে তাঁদের একতারা-দোতারা। খোদা বখ্স বাউলের ছেলে আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরল, বলল, গান শোনার আমন্ত্রণ কমে গেছে। তালের গান, বাজনার গান শুনতে চায় সবাই। শিখেছি সাধনার গান, অশ্রুর গান। মাইক হাতে নিয়ে বললাম, গান শোনাতে এসেছি বহুদিন পর। কাদের গান শোনাতে এসেছি জানেন? স্টেজের ১০০ গজের মধ্যে আমার গান শুনছেন কাজী নজরুল ইসলাম, জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান। ছেলেমেয়েরা হইহই করে উঠল। বিদায় নিয়েছেন আবদুল আলীম, আবদুল লতিফ, বেদারউদ্দিন, শেফালী ঘোষ, শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব। বেঁচে আছি আমি। বুঝতে পারলাম, ওরা ভালোবাসে এই বিদায়ী শিল্পীকে। ডেইলি স্টার-এর ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এই অনুষ্ঠানে দুটোর জায়গায় গাইলাম চারটি।
বৈশাখী টিভিতে অনুষ্ঠান রাত অবধি, চট্টগ্রামের দুজন শিল্পী গাইছেন মহেশখালী ও কুতুবদিয়ার গান। দুই বছর আগে একজন নামী লেখক এসেছিলেন মহেশখালীতে। গান শুনতে নয়, মহেশখালীর পান খেতেও নয়। জোহান হ্যারি এসেছিলেন ডুবন্ত বাংলাদেশকে নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করতে। গত শতাব্দীর শেষ ভাগে যে দেশটির জন্ম হয়েছিল রক্তের বন্যায়, সেটি ডুবে যাবে এই শতাব্দীর শেষে, এ কেমন কথা? হ্যারির এই রিপোর্ট এবং সেই সঙ্গে আরও ৫০টি রিপোর্ট পাঠ করলাম ১৫ দিন ধরে। কেন, তা পরে বলছি।
সাগর দ্রুত এগিয়ে আসছে। নদী কেড়ে নিলে ফিরিয়ে দেয়, সাগর তা দেয় না। হ্যারি বলছেন, মহেশখালীতে গিয়ে দেখা হলো রেজাউল করিম চৌধুরীর সঙ্গে, বয়স ৩৪, অথচ দেখতে ৫০। বললেন, গত ৩০ বছরে দ্বীপটির দুই-তৃতীয়াংশ চলে গেছে পানির নিচে। ঘরবাড়ি, জমি—সবই সমুদ্রের নিচে। তার সঙ্গে আরও কয়েকজন তাঁদের দুর্ভাগ্যের কথা বলার জন্য এগিয়ে এলেন। চৌধুরী দেখালেন ওই যে অনেক দূরে দেখতে পাচ্ছেন একটি সবুজ গাছের অল্প একটু, ওইটি ছিল আমার বাড়ি। হ্যারি খুঁজে পেল গাছটি। চৌধুরী বললেন, ২০০২ সালে ওইখানে আমি থাকতাম। ২০২৪-এ মহেশখালী বলে কোনো দ্বীপ মানচিত্রে খুঁজে পাওয়া যাবে না। দেখা আবদুল জব্বারের সঙ্গে, বয়স ৮০। বললেন, ১৯৬০ সাল থেকে দ্বীপটির ক্ষয়, ১৯৯১-এর পর তা হয়েছে প্রবলতর। সব গেছে আমার। ছেলে সৌদি আরবে চাকরি করে, সেই টাকাতেই এখন বেঁচে আছি।
আমার দেখা চিংড়িঘের, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে যেখানেই গিয়েছি চিংড়িঘের, জিজ্ঞেস করাতে বললেন, এ জমিতে চাষ হবে না, লবণ সব খেয়ে ফেলেছে। আমাদের জন্য রেখেছে সামান্যই। যত দিন বেঁচে আছি চিংড়ি চাষ করে বাঁচতে হবে। গৃহবধূদের সঙ্গে কথা বলে না কেউ। মুন্সিগঞ্জের গৃহবধূ কথা বলেছেন হ্যারির সঙ্গে। আরতী রানী, পরনে নীল শাড়ি, অবয়ব দুঃখ দিয়ে মাখা। আর আমার সঙ্গে কথা বলেছেন তহরুননেছা, যৌবনেই শয্যাশায়িনী। আর্সেনিকের নীল দংশনে তাঁর দুটি পুত্রের অকালমৃত্যু। একমাত্র কারণ শুদ্ধ পানি না পাওয়া। গিয়েছিলাম আর্সেনিক নিরোধের এক কার্যক্রমে অংশ নিতে। মনে পড়ে গেল পিতার ফেলে যাওয়া গান: ‘ফোরাতের পানিতে নেমে ফাতেমা দুলাল কাঁদে, অঝোর নয়নে রে/ দুহাতে তুলিয়া পানি, ফেলিয়া দিলেন অমনি, পড়িল কি মনে রে।’ তহরুননেছার মতো হাজার নারী কাঁদছে শুধু পানির জন্য। শুধু ‘পানি পানি’র হাহাকার। এ কোন কারবালা! ২৩৪টি নদী, সবুজ এই দেশটির পানিতে বিষ, বাতাসে বিষ। কেন সাগরের আক্রোশ, ভাবতে ভাবতে আসি, ভোলায়। ভোলার সব খবরই খারাপ নয়। যেমন গেছে ইলিশা, শিবপুর, গাজীপুর, কাচিয়া, দৌলতখান এবং মূল ভোলা, তেমনি দক্ষিণে জেগে উঠছে চরফ্যাশন। ঘরবাড়ি, জায়গাজমি হারিয়ে এদের অনেকেই আশ্রয় নিয়েছে নতুন জেগে ওঠা চরে।
একজন নতুন লেখক আমি। নতুন ফিকশন ‘কালজানির ঢেউ’ লিখতে গিয়ে পড়ে ফেলি জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের অবস্থান। ক্রুদ্ধ উপসাগরে পানির তাপমাত্রা বাড়ছে প্রতিবছর, লবণাক্ততা গ্রাস করছে চাষের জমি, ‘সিডর’ ও ‘আইলা’র পর আরও আশঙ্কায় দিন গোনেন সাগরপারের মাঝিরা। ঢেউয়ের আঘাতে আঘাতে মুছে যাবে পরিচয়, মেনে নিতে পারছি না।
কী হবে বকুলতলায় গান গেয়ে, কী হবে এ গানের স্বরলিপি, পায়ের তলার মাটি খুঁজে না পাই যদি। শহীদ মিনারের অল্প দূরে বসে রবিঠাকুর লিখেছিলেন এই গান: ‘তোমাদের এই হাসিখেলায়, জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়, এই কথাটি মনে রেখো’। গোধূলি প্রহরে যা অর্থবহ মনে হয়েছে, লিখেছি ‘ফিকশনে’।
মহাপ্লাবনের দিনে ডোবেনি নূহের কিশতি। বাঙালিদের ‘ময়ূরপঙ্খী’, ‘মন পবনের নাও’।
যাদের নৌকা আছে, তারা মরবে না।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সংগীত ব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.