গণমাধ্যমকে কে রেগুলেট করবে? by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

সংবাদপত্র, টিভি বা বেতার অর্থাৎ সার্বিকভাবে গণমাধ্যম যদি স্বেচ্ছাচারী হয়, তাহলে তার চেয়ে বিপজ্জনক আর কিছু হতে পারে না। কারণ গণমাধ্যমকে রেগুলেট করার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান আমরা স্বাধীনতার ৪০ বছরেও তৈরি করতে পারিনি। সরকার ও সমাজের হয়তো প্রত্যাশা ছিল, গণমাধ্যম চলতি আর দশটি ব্যবসার মতো হবে না; এটা হবে সমাজসেবার ব্যবসা, আদর্শ প্রচারের বাহন। একসময় এটাই ছিল বাস্তবতা। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, পাকিস্তান আমল (১৯৭০) পর্যন্ত এ দেশে সংবাদপত্র প্রকাশনা আলু-পটোলের ব্যবসার মতো ছিল না। পূর্ব বাংলার অধিকারবঞ্চিত মানুষের প্রতিবাদের কথা প্রচারের লক্ষ্যে বা শ্রমিক-কৃষক তথা মেহনতি মানুষের দাবি তুলে ধরার জন্য অনেকে সংবাদপত্র প্রকাশ করেছেন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে মওলানা আকরম খাঁ, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া বা খায়রুল কবীররা সংবাদপত্র প্রকাশ করেছিলেন এ রকম নানা আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে। স্বাধীনতার পরও কিছুদিন এই ধারা অব্যাহত ছিল। কিন্তু নব্বইয়ের পর যখন দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং অবাধে সংবাদপত্র প্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি হয়, তখন সংবাদপত্র প্রকাশনা আদর্শের জায়গা থেকে আস্তে আস্তে সরে যেতে থাকে। নব্বইয়ের পর থেকে এ দেশের রাজনীতিও দূষিত হতে থাকে। জাতীয় ও ছাত্ররাজনীতির এক বিরাট অংশ সন্ত্রাস ও দুর্বৃত্তায়নের পঙ্কে নিমজ্জিত হয়ে যায়। এর প্রভাব পড়ে সংবাদপত্র প্রকাশনায় ও টিভি চ্যানেলের ব্যবসায়। ব্যতিক্রম কয়েকটি ছাড়া বেশির ভাগ গণমাধ্যম নানা বাণিজ্যিক স্বার্থ, কালো টাকার পাহারাদার, ভূমিদস্যুতার স্বার্থ রক্ষা, দূষিত রাজনীতিতে প্রভাব বাড়ানো ইত্যাদি লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয়। শুধু তা-ই নয়, সামরিক-বেসামরিক নানা গোয়েন্দা সংস্থার অর্থ-সহায়তায়ও সংবাদপত্র প্রকাশনার অভিযোগ শোনা যায়।
আমার এই পর্যবেক্ষণ পাঠকের জন্য নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অফিসে, ক্লাবে, পারিবারিক আড্ডায় বা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব কথা অনেক বছর ধরে আলোচনা হচ্ছে। আমি সৌজন্যবশত কোনো পত্রিকা বা টিভি চ্যানেলের নাম লিখিনি। কিন্তু আড্ডার আলোচনায় অনেকে প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির নাম নিয়েই অভিযোগ তোলেন। অনেক পাঠক এসব কথা জানেন।
আদর্শভিত্তিক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে এ দেশে একদা সংবাদপত্র প্রকাশনা শুরু হয়েছিল। সংবাদপত্রের সম্পাদক, প্রকাশক ও সাংবাদিকেরা ছিলেন সমাজের সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র। আর আজ? আজ ঋণখেলাপি, ভূমিদস্যু থেকে শুরু করে গোয়েন্দা বিভাগের এজেন্ট অনেকেই সংবাদপত্রের প্রকাশক বা সম্পাদক। নানা কারণে এখনো সম্পাদক বা প্রকাশকের একটা সরকারি বা সামাজিক স্বীকৃতি ও সম্মান রয়েছে। এই সম্মানের আড়ালে তাঁরা কার কী স্বার্থ উদ্ধার করছেন, তা খুব কম পাঠকেরই জানার সুযোগ হয়। অনেক সরলমনা পাঠক এখনো সংবাদপত্রের সব খবর বা নিবন্ধকে খুব আস্থার সঙ্গে পড়েন। কিন্তু সব সংবাদপত্র যে ‘সাংবাদিকতা’ করার লক্ষ্যে সংবাদপত্র প্রকাশ করে না, তা অনেকেই জানেন না। তবে কিছু সংবাদপত্র নিয়মিত পাঠ করে অনেক পাঠক ইতিমধ্যে বুঝতে পেরেছেন, কয়েকটি সংবাদপত্রের বিশেষ অ্যাজেন্ডা কী? একটা পুরোনো প্রবাদ আছে, কিছু মানুষকে কিছু সময়ের জন্য বোকা বানানো যায়। অনেক মানুষকে বেশি সময়ের জন্য বোকা বানানো যায় না।
সাংবাদিকতার কিছু আন্তর্জাতিক নিয়মরীতি আছে। কিন্তু সংবাদপত্রের প্রকাশক বা সম্পাদক যদি তা মানতে না চান, তাহলে তাঁকে বাধ্য করবে কে? কারণ তাঁর হাতে রয়েছে সংবাদপত্র, রিপোর্ট, ছবি, কলাম ও আরও কত কী। টিভি চ্যানেলের মালিকের রয়েছে ক্যামেরা, ক্যাসেট, এডিটিং টেবিল ও সম্প্রচারের যন্ত্র। আর কী চাই? তিনি যা চান, তা-ই প্রচার করতে পারেন। ইচ্ছেমতো বক্তৃতা কাটতে পারেন। এক কথার সঙ্গে সুবিধামতো আরেক কথা জোড়া দিতে পারেন। বক্তার একটা কথার দুটি শব্দ বাদ দিয়েও প্রচার করতে পারেন। একই কথা দুবার প্রচার করতে পারেন। এক ছবি ১০ বার দেখাতে পারেন। দেখানোর উপযুক্ত হলেও তা না দেখানোর স্বাধীনতাও তাঁর রয়েছে। টিভি চ্যানেলের স্বাধীনতার (পড়ুন স্বেচ্ছাচারিতা) কোনো শেষ নেই। টিভি চ্যানেলও যদি নিয়মরীতি মানতে না চায়, কে তাকে বাধ্য করবে? সমাজে এমন কোনো শক্তি আছে কি, গণমাধ্যমকে রীতিনীতি মানতে বাধ্য করতে পারে? হ্যাঁ, একমাত্র সরকারই পারে। কিন্তু সরকারের প্রশ্রয়ে যদি এ রকম স্বেচ্ছাচারিতা ঘটে, তাহলে কে গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করবে?
আমার মাঝেমধ্যে সন্দেহ হয়, এর পেছনে কি কোনো সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র কাজ করছে? আমাদের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল দূষণ ও দুর্বৃত্তায়নের শিকার। দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান পরিবারতন্ত্রের ওপর দল দুটি নির্ভরশীল। দলের প্রধানের একনায়কত্ব এবং কিছু পেটুয়া নেতার নিয়ন্ত্রণে প্রধান দুটি দলের নীতিনির্ধারণ হয়ে থাকে। দলের সম্মেলন, নানা কমিটি ও নানা সভা অনেকটাই লোক দেখানো। দলের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত অন্যত্র নেওয়া হয়। দল দুটির ঐতিহ্যবাহী ছাত্র শাখাও টেন্ডারবাজি ও দুর্বৃত্তায়নের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। সুস্থ ও গণতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে বড় দুটি দলের ছাত্র শাখার কোনো সম্পর্কই নেই। বড় দুটি দল তাদের দলের সরকারের আমলে বিচারব্যবস্থাকে কলুষিত করে ফেলেছে। সাম্প্রতিক টিআইবি রিপোর্ট তা আরও ভালোভাবে তুলে ধরেছে। গণতন্ত্রচর্চার কেন্দ্রবিন্দু ‘জাতীয় সংসদ’ পর পর দুই মেয়াদ প্রায় বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়াই চলছে। বিরোধী দল ছাড়া ‘জাতীয় সংসদ’ এক প্রকার প্রহসন ছাড়া আর কিছু নয়। সেই প্রহসন আমরা প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করছি।
দেশের প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমে দূষিত, অকার্যকর ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে। ঠিক সে রকম অবস্থায় সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলের মতো শক্তিশালী ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় সুপরিকল্পিতভাবে কিছু লোক তাদের নানা অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করে গণমাধ্যমকেও জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ ও হাস্যকর করে তুলছে। ভূমিদস্যু, ঋণখেলাপি বা গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্টরা প্রকাশক ও সম্পাদকের ছদ্মবেশে গণমাধ্যমের ইতিবাচক শক্তিকে ভোঁতা করে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে নেমেছে বলে আমার সন্দেহ হয়। কারণ সংবাদপত্র যদি প্রায়ই ভুল খবর ছাপিয়ে পরদিন ভুল স্বীকার করে, তাহলে পাঠক সংবাদপত্রের ওপর আস্থা রাখবে কীভাবে? গুজবই যদি সংবাদপত্রের শীর্ষ খবর হয় এবং পরদিন তা ভুল বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে পাঠক সেই সংবাদপত্রকে বিশ্বাস করবে কেন? এভাবে চলতে থাকলে সংবাদপত্র, টিভি বা সাংবাদিকতা পেশার প্রতিই মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলবে। উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যা, ভুল ও অর্ধসত্য তথ্য দিয়ে যদি প্রতিদিন সংবাদপত্র প্রকাশ করতে হয়, সেই সংবাদপত্রকে পাঠক গুরুত্ব দেবে কেন?
‘রাজনীতি’ ছিল সমাজসেবার এক মহান পেশা। রাজনীতিবিদেরা ছিলেন ত্যাগী মানুষ হিসেবে সমাজে পরিচিত। সেই রাজনীতিকদের এখন কী ভাবমূর্তি দাঁড়িয়েছে, পাঠক তা ভালোভাবে জানেন। একটি ক্ষুদ্র মহল সুপরিকল্পিতভাবে সাংবাদিকতা পেশাকেও এভাবে কালিমালিপ্ত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে বলে আমার সন্দেহ হয়। পেশাদার সংবাদপত্র বা সৎ সাংবাদিকতাকে ছাপিয়ে ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ সমাজে বেশি আলোচিত হয়। মানুষ নেতিবাচক খবর নিয়ে গল্প করতে পছন্দ করে। এটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার। এর ব্যাখ্যা মনস্তত্ত্ববিদেরা ভালো দিতে পারবেন।
সমাজ কি সাংবাদিকতা পেশাকে এভাবে কলুষিত হতে দেবে? মতলববাজ রাজনীতিবিদ, ভূমিদস্যু, ঋণখেলাপি ও গোয়েন্দা দপ্তরের এজেন্টদের তথাকথিত ‘মিশন’ থেকে সৎ ও নীতিনিষ্ঠ সাংবাদিকতাকে উদ্ধার করার উপায় কী? এখনো উদ্ধার করার সময় আছে। জাতীয় ও ছাত্ররাজনীতির মতো সাংবাদিকতা পেশা এখনো একেবারে কলুষিত হয়নি। এখনো ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ সংখ্যায় কম। কিন্তু ব্যবসা, বিজ্ঞাপন, নানা রাজনৈতিক প্রলোভন বা ব্ল্যাকমেইলিং করে পেশাদার সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেলকে ‘হলুদ’ করে ফেলা অসম্ভব কিছু নয়। সেটা আরও ভয়ের। পুলিশ বিভাগ বা বিচার বিভাগের মতো জাতীয় প্রতিষ্ঠানের স্বরূপ যেভাবে উন্মোচিত হয়েছে, তার পেছনে স্বাধীন সংবাদপত্রের অবদান অনেকখানি। সে জন্য স্বাধীন সংবাদপত্র তথা পেশাদারি সাংবাদিকতাকে ধ্বংস করার জন্য আজ অনেকে তৎপর। স্বাধীন সংবাদপত্র দেশে আছে বলেই আজ দূষিত রাজনীতি, দুর্বৃত্তায়ন ও দুর্নীতির অনেক খবর জনসমক্ষে তুলে ধরা সম্ভব হচ্ছে। পাঠককে সংবাদপত্রের এই ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।
হলুদ সাংবাদিকতাকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারত ‘প্রেস কাউন্সিলের’ মতো সরকারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু আমাদের তথ্যমন্ত্রীর নির্লিপ্ততার কারণে প্রেস কাউন্সিল আজ একটি প্রায়মৃত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আজ যদি প্রেস কাউন্সিল সত্যিকার অর্থে কার্যকর প্রতিষ্ঠান হতো, তাহলে হলুদ সাংবাদিকতার অভিযোগ প্রমাণের পর অনেক প্রকাশক বা সম্পাদককে নানা শাস্তি পেতে হতো। প্রেস কাউন্সিলকে আমি তখনই কার্যকর প্রতিষ্ঠান বলব, যখন সংবাদপত্রে মিথ্যা সংবাদ প্রকাশের অভিযোগ প্রমাণিত হলে সেই সংবাদপত্রের রিপোর্টার, প্রকাশক ও সম্পাদকের অর্থদণ্ড হতো; সম্পাদক ক্ষমা প্রার্থনা করতে বাধ্য হতেন। এক বছরে তিনবার অভিযোগ প্রমাণিত হলে সেই সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বাতিল করে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকা উচিত। প্রেস কাউন্সিল যদি সাংবাদিকতার মান রক্ষার জন্য কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে পারে, তাহলেই সেটা একটি কার্যকর প্রতিষ্ঠানের দাবিদার হতে পারবে। তা সম্ভব না হলে আমাদের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যবাহী পেশাদারি সাংবাদিকতা একদিন হলুদ সাংবাদিকতার গহ্বরে ঢুকে পড়লে আমি অবাক হব না।
সাংবাদিকেরা সংবাদপত্রে বা টিভিতে অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ধরেন। সেটা তাঁদের দায়িত্ব। কখনো ‘মিডিয়া ট্রায়ালের’ মাধ্যমে অনেককে আগাম শাস্তিও দিয়ে থাকেন। কিন্তু হলুদ সাংবাদিকতার মাধ্যমে তাঁরা যে অপকর্মটি করছেন, সে জন্য তাঁদের শাস্তি দেবে কে?
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: উন্নয়নকর্মী ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.