তবুও কিছু প্রাপ্তি

আরেকটি বছর বিদায় জানাচ্ছে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন। কেমন গেল বছরটা? ব্যর্থতার পাশে বলার মতো কিছু সাফল্যও আছে—একবাক্যে এটিই হতে পারে সহজ উত্তর।
এসএ গেমসে ১৮টি সোনা জয়, এশিয়ান গেমসে ক্রিকেটের কল্যাণে প্রথমবারের মতো সোনা, গলফার সিদ্দিকুর রহমানের উত্থান, এসএ গেমস ফুটবলে সোনা ফিরে পাওয়া...। খুব কি কম?
ক্রিকেটের সাফল্যের সঙ্গে এগুলো হয়তো তুলনীয় নয়। কিন্তু বরাবর সালতামামিতে গুরুত্ব পেয়ে আসা ক্রিকেটের পাশে এবার অন্য খেলাগুলোর ওপরও আলো পড়েছে কিছুটা।
তবে আলোর চেয়ে অন্ধকারই বেশি। অন্ধকার মানে, ক্রীড়াঙ্গনের বরাবরের সেই ব্যর্থতা। সেই জরাজীর্ণ ছবির বদল নেই। একই ধাঁচে ক্রীড়াঙ্গন পরিচালিত হয়েছে ২০১০ সালেও; বরং ক্ষেত্রবিশেষে অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। একটা উদাহরণ—ক্রীড়া ফেডারেশনে নির্বাচন নির্বাসিত ছিল এ বছর। থেমে গেছে ক্রীড়াঙ্গনে গণতান্ত্রিক চর্চা!
গতিশীলও কি হয়েছে? গেমসে অংশ নেওয়াই গতিশীলতার মানদণ্ড হলে উত্তর হ্যাঁ-বোধক হওয়া উচিত। বছরে তিনটি ভিন্ন গেমসে অংশ নিয়েছে বাংলাদেশ। ফেব্রুয়ারিতে ঘরের মাঠে এসএ গেমসে প্রত্যাশিত সাফল্য এসেছে ঠিকই, কিন্তু কোন খেলায়? উশু, তায়কোয়ান্দো, মার্শাল আর্ট জাতীয় খেলাগুলোর কল্যাণে সোনাপ্রাপ্তি বেশি ছিল। অ্যাথলেটিকস, সাঁতারের মতো খেলায় সোনার সাফল্য নেই। অ্যাথলেটিকসের অবস্থাও আগের চেয়ে আরও রুগ্ণ হয়ে পড়েছে এ বছর।
শ্যুটিং তো একটা বার্তাই পেয়ে গেছে এবার। স্কোর ভালো না করতে পারলে ভবিষ্যতে আর কোথাও গিয়ে দাঁড়ানো যাবে না। এসএ গেমস ও কমনওয়েলথ শ্যুটিংয়ে সোনা এলেও বছরটা শেষ হয়েছে ব্যর্থতায়। কমনওয়েলথ গেমস ও এশিয়ান গেমসে শ্যুটারদের স্কোর পাতে তোলার মতো ছিল না। এককথায় ভরাডুবি! গর্বের কাবাডি পড়ে গেছে এক শ হাত গভীর খাদে। এশিয়াডে এবারই প্রথম পদকবঞ্চিত দলের জন্য এটাই যথার্থ বিশেষণ।
হকি নিয়ে কথা কম বলাই ভালো। ওটা তো এখন আর খেলা নয়, নিছকই কৌতুক! হকি ফেডারেশন বছরজুড়েই নানা হাস্যরসের জন্ম দিয়েছে। জার্মান কোচ পিটার গেরহার্ড ছিলেন অন্যতম বড় চরিত্র, যাঁকে ঘিরে চলেছে এসব কৌতুক।
এসএ গেমসের সোনা জয় এ বছর ফুটবলের বলার মতো অর্জন। হতে পারে বাংলাদেশের ফুটবল এমন জায়গায় যায়নি যে, বড় কিছু আশা করে ফেলবে। তাই বলে ফেব্রুয়ারিতে এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপে শ্রীলঙ্কার কাছে ৩ গোলে হারবে বাংলাদেশ! এশিয়ান গেমসের তিন ম্যাচেই হার, একসময়ের প্রতিদ্বন্দ্বী হংকংয়ের কাছে ৩ গোলে উড়ে যাওয়া—আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই ব্যর্থতা বড় বেশি চোখে লাগে।
ঘরোয়া ফুটবল ভালোভাবে চললেই তো আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ফল আসবে। সেই ঘরোয়া ফুটবলের জীর্ণ ছবি তো এতটুকু বদলায়নি। পেশাদার ফুটবল লিগ জুনে শেষ হয়ে দুই দিন আগে আবার শুরু হয়েছে, এটার ধারাবাহিকতাই সব নয়। ধারাবাহিকতা থাকলেও অবকাঠামোগত পরিবর্তন নেই। সেটির প্রতিশ্রুতি ক্লাব-বাফুফে কেউই রাখেনি।
সুপার কাপ তো থমকেই দাঁড়িয়েছে। প্রতিবছর কোটি টাকার এই টুর্নামেন্ট আয়োজন করার প্রতিশ্রুতি থাকলেও এ বছর টুর্নামেন্টটি হয়নি। প্রতিবছর একটি করে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট করার অঙ্গীকার আছে বাফুফের, তা-ও হয়নি। পরিবর্তন তাহলে কোথায় হলো? ফুটবলে কথার তুবড়ি ছুটেছে, কাজ হয়েছে কম!
সবচেয়ে বড় কথা, তৃণমূল ফুটবল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। দুই বছর পর প্রথম বিভাগ হয়েও দ্বিতীয়-তৃতীয় বিভাগের খবর নেই। অনেক ঠেলে-ধাক্কিয়ে বাফুফেকে কিছুটা নড়ানো গেছে বছরের শেষ দিকে। আড়াই বছর পর এই সেদিন শুরু হয়েছে পাইওনিয়ার লিগ। গতকাল ঢাকা মহানগরী স্কুল ফুটবলও আলোর মুখ দেখল। তা-ও পাঁচ বছর পর!
কর্মকর্তাদের ভাষায় সমস্যার নাম মাঠ। কিন্তু এ বছরও মাঠ খোঁজার ব্যাপারে বাফুফের উদ্যোগী ভূমিকা দেখা যায়নি। ঢাকার তৃণমূল ফুটবলেই যখন এ অবস্থা, সারা দেশে তৃণমূল ফুটবল যে হচ্ছে না, তা বললেও চলছে। ঘরোয়া ফুটবলে প্রত্যাশিত পরিবর্তনের ছিটেফোঁটাও নেই বরং আরও খারাপ হয়েছে!
বাফুফের দৃষ্টি বেশি আন্তর্জাতিক ফুটবলের দিকে। ঘরোয়া ফুটবলের ব্যাপারে তারা উদাসীন এবং কর্মকর্তা-কর্মী সবাইকেই ওই রোগে পেয়ে বসেছে। কর্তারা মাঠে যান খুব কম, এসি রুমে বসেই বাফুফে চালানোর প্রবণতা বেশি। তবে কর্মকর্তাদের সম্মান বৃদ্ধি হয়েছে। পাঁচ কর্মকর্তা পেয়েছেন এএফসির পুরস্কার।
চমকও কি নেই? সবচেয়ে বড় বাজেটের দল গড়ে চমক হয়ে এসেছে শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব। ছিল নাটকীয়তাও। এসএ গেমসে বাংলাদেশ দলকে সোনা এনে দিয়েই নিজের উচ্চ মূল্য হাঁকিয়েছেন কোচ জোরান জর্জেভিচ। পরে বহু নাটক করে যুক্ত হয়েছেন বাংলাদেশের সাবেক কোচদের তালিকায়!
জর্জেভিচের উত্তরসূরী হিসেবে এসেছেন রবার্ট রুবচিচ। ২০১১ সালে ফুটবলের সালতামামিটা তাঁর হাত ধরে যদি একটু ভিন্ন হয়!

No comments

Powered by Blogger.