ব্রাজিলের সাম্বা ফুটবল ও দুঙ্গার বিশ্বকাপ

ব্রাজিল উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে ২-১ গোলে জিতলেও (১৫ জুন) সাম্বা ছন্দের ফুটবলের জন্য পাগল দর্শকেরা মোটেও খুশি হতে পারেনি। আর্জেন্টিনার সঙ্গে তুলনাটা স্পষ্ট। নাইজেরিয়ার বিপক্ষে মেসি তো বটেই, পুরো আর্জেন্টিনা দল যেন একটা ঘোরলাগা ফুটবল খেলেছিল। অন্যদিকে দুঙ্গার ব্রাজিল বাহিনী ‘অজানা’ উত্তর কোরিয়ার গতি এবং প্রাণশক্তির কাছে ছিল তটস্থ। তাদের রক্ষণভাগের খেলোয়াড় মাইকন ৫৫ মিনিটে সত্যিকার ব্রাজিলীয় ম্যাজিক দেখিয়ে প্রায় শূন্য দৃষ্টিসীমা থেকে বিস্ময়কর প্রথম গোলটি করলেও তাদের ‘মেসি’ অর্থাৎ কাকা ছিলেন একেবারে নিষ্প্রভ, যে রকম নিষ্প্রভ ছিলেন পর্তুগালের রোনালদো আইভরিকোস্টের বিপক্ষে। রবিনহো অবশ্য ছিলেন চমৎকার। ব্রাজিলের বিপক্ষে উত্তর কোরিয়া পাঁচজন ডিফেন্ডার নিয়ে খেলে, যা সচরাচর দেখা যায় না।
সে যা-ই হোক, খেলা শেষে মাইকন জাবুলানি বলটার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। এতে বলটির প্রস্তুতকারক এডিডাস কোম্পানির খুশি হওয়ার কথা। রবিনহোর ছন্দ ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে ব্রাজিলের কোচ দুঙ্গা বলেছেন, ‘আমার সমস্যা হলো, আমার হস্তীসম অতিকায় স্মৃতিশক্তি। ম্যানচেস্টার সিটি থেকে রবিনহোকে বাদ দিলেও আমি তাঁর প্রতিভার কথা স্মরণ রেখেছিলাম।’
১৯৯৪-এর বিশ্বকাপে দুঙ্গার নেতৃত্বেই ব্রাজিল তার চার নম্বর বিশ্বকাপ শিরোপা জেতে। তবে সেটি ছিল বিশ্বকাপের ইতিহাসে একমাত্র ফাইনাল, যার নিষ্পত্তি হয় টাইব্রেকারে। এবং রবার্তো বাজ্জো তাঁর স্পট কিকটি মিস না করলে হয়তো ইতালিই চ্যাম্পিয়ন হতো।
‘শিল্পকে ছেড়ে জয়কে বড় করে দেখার’ অপরাধে অনেক সমালোচনা হয়েছে দুঙ্গার। কিন্তু এর পেছনের ইতিহাসটার মধ্যে খানিকটা ট্র্যাজেডি আছে। ১৯৭০ সালে মেক্সিকোয় ব্রাজিল তৃতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় পেলে, কার্লোস আলবার্তো, গারসন, জেয়ারজিনহো, টোসটাও এবং রিভেলিনোর মতো অতুলনীয় ফুটবলশিল্পীদের কারণে। তাঁদের ঐন্দ্রজালিক স্পর্শে ব্রাজিল ইতালির বিপক্ষে ৪-১ গোলে জেতে। গোল করেন পেলে, গারসন, জেয়ারজিনহো ও কার্লোস আলবার্তো। ইতালির পক্ষে বনিনসেঙ্গা। জুলেরিমে কাপ চিরতরে তাদের করে নেয় ব্রাজিল ’৫৮, ’৬২, ’৭০ পরপর তিনবার বিশ্বকাপ জেতার জন্য।
এর পর থেকে ধারণা করা হয়, ব্রাজিল মানে সাম্বার ছান্দসিক ফুটবল। ১৯৮২ সালের ব্রাজিল দলটাকে বলা হয় অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি দল, যারা বিশ্বকাপ জেতেনি। তাদের দলে তখন এডার, ফ্যালকাও, সার্জিনহো, সক্রেটিস এবং পেলের ছায়া যাঁর মধ্যে ছিল, সেই জিকো। সে সময় দ্বিতীয় রাউন্ডের ‘গ্রুপ অব ডেথ’-এ পড়ল ইতালি, আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল। আর্জেন্টিনাকে ইতালিও হারায়, ব্রাজিলও হারায়। ব্রাজিলের সঙ্গে খেলার সময় ম্যারাডোনা একটি কাণ্ড করেন। তিনি তখন ২১ বছরের দুর্ধর্ষ উঠতি ফরোয়ার্ড। স্বভাবতই ব্রাজিলের রক্ষণ ভাগ তাঁকে চেপে রাখে। বিরক্তির চরমে পৌঁছে ম্যারাডোনা একসময় ফালক্যাওয়ের পিঠে লাথি মারলে রেফারি সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে লাল কার্ড দেখান।
যা হোক, ব্রাজিল যেহেতু গ্রুপে গোলগড়ে এগিয়ে ছিল, তারা ড্র করলেও হয়ে যেত। ওদিকে ইতালির কোচ বিয়ারজোট একটি বাজি ধরলেন পাওলো রসিকে নিয়ে। রসি বাজির কেলেঙ্কারির জন্য তিন বছরের জন্য বহিষ্কৃত ছিলেন। কিন্তু শাস্তি কমিয়ে দুই বছরে আনা হলে তিনি বিশ্বকাপের জন্য নির্বাচিত হন। ম্যারাডোনা, উরুগুয়ের ফ্রান্সিস কোলি বা রুমানিয়ার হাজ্জির মতো সারা মাঠ দাপিয়ে খেলা রসির কায়দা ছিল না। তাঁর অভ্যাস ছিল, ডি বক্সের বাইরে কোথাও ওত পেতে থেকে বল পাওয়ামাত্র জালে ঢুকিয়ে দেওয়া। খেলার পাঁচ মিনিটেই রসি গোল করলেন। সক্রেটিস সেটা ১২ মিনিটে ফেরত দেন। ব্রাজিলের ড্র হলেই চলত। কিন্তু সাম্বাশিল্পীরা তো আর গা বাঁচানো খেলায় অভ্যস্ত নন। তাঁরা গোল সামলে বসে রইলেন না। সেই ফাঁকে সুযোগসন্ধানী রসি আবার ২৫ মিনিটে গোল করেন। সে গোলও শোধ করে ব্রাজিল ৬৮ মিনিটে। তারা আবার আক্রমণে যায়, আর সে সুযোগে রসির তৃতীয় গোল এবং হ্যাটট্রিক আসে ৭৫ মিনিটে। রসির এ কৃতিত্বে মুগ্ধ ব্রাজিলের গোলরক্ষক বলটি জাল থেকে কুড়িয়ে নিয়ে হাসিমুখে তাঁর হাতে ফেরত দেন। ফল, ব্রাজিল আউট। ফুটবলপণ্ডিতেরা এ খেলাটিকে একটি শ্রেষ্ঠ খেলা বললেও এখনো বুঝতে পারেন না, কিসের নেশায় ব্রাজিল বারবার আক্রমণে যাচ্ছিল, যখন তাদের রক্ষণাত্মক হলেই চলত।
তাই দুঙ্গা সবার পছন্দের সাম্বা শিল্পরীতি বাদ দিয়ে জয় নিয়েই ফিরতে হবে—এ দর্শন বেছে নিলেন। দুঙ্গা বলেন, ‘আই লাইক উইনিং।’ কিন্তু ব্রাজিলীয় কোচ বাংলা জানলে তাঁকে রবীন্দ্রনাথের ‘জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায় না’ গানটি শোনানো যেত।

No comments

Powered by Blogger.