কী হচ্ছে টিপাইমুখে -নদীকথা by শাহেদ কায়েস

নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। নদী ও জলের সঙ্গে একাকার এ দেশের জনজীবন। নদীবিধৌত অববহিকায় বেড়ে ওঠা আমাদের জীবন, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি। ‘খেয়াপারের তরুণী’ কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম সেমেটিক বিশ্বাস আর ভারতীয় বিশ্বাসের সমন্বয়ে উপহার দেন এক অভিনব নদী। বাংলাদেশের নদীকেন্দ্রিক নিসর্গে আবেগপ্লাবিত অন্তরঙ্গ পত্রকাব্য রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্র, পদ্মা নদী যেখানে নায়িকা।
আমাদের সংগীতে বারবার নদী এসেছে ঘুরেফিরে—পদ্মার ঢেউ রে..., ও নদী রে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে...। চলচ্চিত্রে নদী এসেছে বিভিন্নভাবে—নদী ও নারী, তিতাস একটি নদীর নাম ; ধীরে বহে মেঘনা। ভারতীয় এবং বাংলাদেশের শত শত নদী নিয়ে রয়েছে অসংখ্য লোকপুরাণ ও ধ্রুপদী পুরাণ। মহাভারতে করতোয়া নদীর উল্লেখ রয়েছে। পার্বতীর সঙ্গে শিবের বিয়ের সময়ে হাত (কর) ধোয়ার সময়ে যে জলের (তোয়া) ধারা প্রবাহিত হয়, সেটাই হলো করতোয়া। বৌদ্ধসাহিত্যে নদীর ওপর বাঁধ দেওয়া নিয়ে উজান ও ভাটি অঞ্চলের দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাতের সৃষ্টি হয়েছিল, বোধিস্বত্ব যার মীমাংসা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মুক্তধারা নাটকে এর প্রভাবে রয়েছে। গঙ্গার অপর নাম মুক্তধারা। ওই পৌরাণিক কাহিনী আমাদের সাম্প্রতিক সময়ের টিপাইমুখ বাঁধের কথা মনে করিয়ে দেয়।

টিপাইমুখ কী
টিপাই ভারতের একটি নদীর নাম। টিপাইয়ের আরেক নাম টুইভাই। এই টুইভাই নদীর মুখ হলো টিপাইমুখ। ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পাশাপাশি তিনটি পাহাড়ি রাজ্য—নাগাল্যান্ড, মণিপুর ও মিজোরাম সীমান্তের কাছে মণিপুর রাজ্যের অত্যন্ত দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলের একটি অখ্যাত জনপদ হচ্ছে টিপাইমুখ। অপর একটি নদী হচ্ছে বরাক, যার উত্পত্তি মণিপুর রাজ্যের জাপভো পর্বতশৃঙ্গে অসংখ্য পাহাড়ি ছড়া বা ঝিরি থেকে। টিপাইমুখে টিপাই নদীর সঙ্গে মিলিত হয় বরাক নদী, যার ডান তীরে মণিপুর রাজ্য, বাঁ তীরে মিজোরাম রাজ্য। এখান থেকে নদীটি আসামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সিলেট হয়ে প্রবেশ করে সুরমা ও কুশিয়ারা নামে।

কী হচ্ছে টিপাইমুখে
টিপাইমুখে ভারত সরকার নির্মাণ করছে একটি বৃহত্ বহুমুখী প্রকল্প। এই প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ‘ড্যাম’ ও ‘ব্যারেজ’ নির্মাণ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ড্যাম কী এবং ব্যারেজ কী? বাংলায় ড্যাম ও ব্যারেজ উভয়কেই বাঁধ বলা হয়। কিন্তু দুইয়ের মধ্যে রয়েছে আলাদা উদ্দেশ্য। ড্যামের উদ্দেশ হচ্ছে জলবিদ্যুত্ উত্পাদন, যেমন—বাংলাদেশের কাপ্তাই ড্যাম।
আর ব্যারাজের উদ্দেশ্য হলো পানি ধারণ করে সুবিধামতো প্রত্যাহার করে অন্যত্র বয়ে নিয়ে যাওয়া, যেমন—ভারতের ফারাক্কা ব্যারেজ।
টিপাইমুখ প্রকল্পে প্রথমে নদীতে বাঁধ দিয়ে ভাটির দিকে (বাংলাদেশ) নেমে আসা পানির প্রবাহ রুদ্ধ করা হবে, এরপর এই পানি যাতে উজানে (ভারতে) থেকে যায় সে ব্যবস্থা করা হবে। ভারত এই রুদ্ধ পানির প্রবাহকে বিদ্যুতে পরিণত করবে এবং ভারতের আসাম রাজ্যের কাছাড় অঞ্চলে এই পানি বন্যানিয়ন্ত্রণের উপায় হিসেবে ব্যবহার করা হবে। এ ছাড়া ধরে রাখা এই পানি কৃষিতে ব্যবহার করবে ভারত।

টিপাইমুখ প্রকল্পে বাংলাদেশের কী কী ক্ষতি হতে পারে
১০ থেকে ২০ হাজার বছর আগে বাংলাদেশে বিরাট সাগর ছিল। হিমালয় থেকে নেমে আসা নদীর পলি বহন করে এই বদ্বীপটি তৈরি। এ জন্যই বলা হয় বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। অর্থাত্ নদী এ দেশের মা। টিপাইমুখ প্রকল্প নির্মিত হলে নিম্নোক্ত ক্ষতিগুলো হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা:
এক. পর্যাপ্ত পলির অভাবে সিলেট ও হাওর অঞ্চলে ভূমির অধোগমন (নিচের দিকে দেবে যাওয়া) ঘটবে, যা মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।
দুই. কোনো কোনো অঞ্চল হবে মরুভূমিসদৃশ এবং কখনো কখনো দেখা দিতে পারে (বন্যার কারণে টিপাইমুখের পানি ছেড়ে দিলে) ব্যাপক প্লাবন।
তিন. টিপাইমুখ প্রকল্প যেখানে হচ্ছে ওই অঞ্চল ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। ভূমিকম্পে যদি কখনো এই বিপুল জলাধার ফেটে যায়, তাহলে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল ৯ থেকে ৩২ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে, যা হবে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ; ধ্বংস হবে জীববৈচিত্র্য, হাজার বছর ধরে লালিত মানুষের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের করণীয় 
টিপাইমুখ প্রকল্প সম্পর্কে বাংলাদেশ ও ভারতের পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার আন্দোলনে যাঁরা জড়িত তাঁদের বিভিন্ন এনজিও, মানবাধিকার সংস্থাকে সম্পৃক্ত করে একটা আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তুলতে হবে। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক পানি আইনে বিষয়টি নিয়ে এগোতে হবে। ‘নো হার্ম রুল’: ইউএন কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ৭ অনুসারে ভিন্ন দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত অভিন্ন নদীর বেলায় উজানের দেশ ভাটির দেশের ক্ষতি করতে পারবে না। এ ছাড়া ‘নন-ন্যাভিগ্যাবল ইউসেজ অব ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার কোর্সেস’-এর অনুচ্ছেদ ৫ এবং বার্লিন রুল অব ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার রিসোর্সেস (২০০৪)-এর প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে ভারতের সঙ্গে তার পানির ন্যায্য হিস্যা নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে তত্পর হতে হবে।
সর্বোপরি দেশের এই দুঃসময়ে দলমতনির্বিশেষে— সরকার, বিরোধী দল, জনগণ, গণমাধ্যম সবাইকে এই বিষয়ে নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থে বাংলাদেশের জন্য মরণফাঁদ টিপাইমুখসহ বাংলাদেশ-ভারতের অন্যান্য যৌথ নদীর ওপর পরিকল্পনাধীন ড্যাম, ব্যারেজ কিংবা বৃহত্ প্রকল্প নির্মাণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।
শাহেদ কায়েস: কবি। প্রতিষ্ঠাতা—সুবর্ণগ্রাম। প্রিন্সিপাল—সুবর্ণগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল স্কুল।

No comments

Powered by Blogger.