যুক্তরাষ্ট্রে ইতিহাসের হাতছানি- রাশিয়া, চীন, ইরানের হস্তক্ষেপ!

গণতন্ত্রের এক কঠিন পরীক্ষা যুক্তরাষ্ট্রে। মঙ্গলবার, ৫ই নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে কঠিন নির্বাচন। যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু বিশ্ব মোড়ল, তাই তাদের নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে সারাবিশ্ব। কারণ, এই নির্বাচনের ফলের ওপর নির্ভর করবে বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি সহ অনেক কিছু। ডেমোক্রেট কমালা হ্যারিস ও রিপাবলিকান ডনাল্ড ট্রাম্পের সামনে  যেন অগ্নিপরীক্ষা। জনমত জরিপে সমানে সমান দু’জনই। যে-ই নির্বাচিত হবেন, তিনিই ইতিহাস গড়বেন। কমালা বিজয়ী হলে তিনি হবেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট। অন্যদিকে ডনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হলে তিনি হবেন ক্রিমিনাল হিসেবে অভিযুক্ত প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। সর্বশক্তি দিয়ে দু’জনেই মাঠে। ট্রাম্প অবশ্য ২০২০ সালে বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে পরাজিত হয়েছেন। তিনি এখনো পর্যন্ত সেই পরাজয় স্বীকার করে নেননি। তার বিরুদ্ধে দাঙ্গা উস্কে দেয়ার অভিযোগ আছে। এতে তিনি দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। একজন পর্নো তারকার সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্কে অভিযুক্ত হয়েছেন। জরিমানা দিয়েছেন। এমন নজির আছে বলে মনে হয় না। এই নির্বাচনে কোনো একটি সম্প্রদায় যদি একজন প্রার্থীর দিকে ঝুঁকে পড়ে তাহলে ফল ভিন্ন হয়ে যেতে পারে। যেহেতু কমালা-ট্রাম্প একজন অন্যজনের কাঁধের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছেন, ফলে মুসলিমরা এখন বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছেন। গাজা, লেবানন, ইরান, ইয়েমেন ইস্যুতে মুসলিমদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে জো বাইডেন প্রশাসনের বিরুদ্ধে। কারণ, তারা বিশেষত গাজায় গণহত্যায় ইসরাইলকে দ্ব্যর্থহীনভাবে সমর্থন দিচ্ছে। অর্থ দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের বহু পশ্চিমা মিত্র পর্যন্ত গাজার নিরীহ মানুষের আর্তনাদে স্তম্ভিত। তারা পর্যন্ত যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। গাজার মানুষের সঙ্গে যে নৃশংসতা চালানো হচ্ছে তাতে তাদের মনও কেঁদে উঠেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষত বাইডেন প্রশাসন ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার নিয়ে তাদের পাশে। যখন হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়ে, হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসারুল্লাহকে হত্যা করে ইসরাইল, তখন ইসরাইলের এ অভিযানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন বাইডেন। এই অভিযান চালাতে গিয়ে তারা গাজাকে পুরো মৃত্যুপুরী বানিয়ে ফেলেছে, সে বিষয়ে কোনোই কথা বলেন না তারা। এ নিয়ে কথা বলার কারণে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরাঁকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ইসরাইল। তারা এই আস্পর্দা দেখানোর সাহস পায় শুধু যুক্তরাষ্ট্রের কারণে। বাইডেন প্রশাসনের এই নীতি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী মুসলিমরা, বিশেষ করে আরব মুসলিমরা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। তাদের কিছু নেতা এরই মধ্যে রিপাবলিকান প্রার্থী ডনাল্ড ট্রাম্পের সমাবেশে মঞ্চে উঠেছেন। তারা ট্রাম্পকে সমর্থন দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন। গাজায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে যে নিষ্পেষণ, নির্যাতন, গণহত্যা চলছে, তার প্রতিবাদ হিসেবে পুরো মুসলিম সম্প্রদায় যদি নীরব বিপ্লব হিসেবে ট্রাম্পকে বেছে নেয়, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

এসব ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বা বাইরের হস্তক্ষেপ এবার রাজনীতিতে কতোটা প্রভাব ফেলবে তা আগাম বলা যায় না। কিন্তু অনেকেই আশঙ্কা করছেন ট্রাম্পকে নিয়ে। কারণ, তিনি এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন পরাজিত হলে তিনি নির্বাচনের ফল মানবেন না। যদি তিনি পরাজিত হনই, তাহলে ফল না মেনে কি করবেন সে বিষয়ে পরিষ্কার করেননি। এক্ষেত্রে ২০২১ সালের ৬ই জানুয়ারির দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ওইদিন তার উস্কানিতে তার সমর্থকরা যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিলে দাঙ্গা চালায়। ব্যাপক ভাঙচুর, লুটপাট চালায়। ওই সময় ক্যাপিটল হিলে উপস্থিত সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স, নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সহ কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। তারা নিরাপদে সরে গিয়ে জীবন রক্ষা করেন। ওইদিন দাঙ্গায় নিহত হন কমপক্ষে ৫ জন। নির্বাচনের ফল প্রকাশের আগে কয়েকটি রাজ্যে নির্বাচনী ফল উল্টে দেয়ার জন্য তিনি নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। এমনকি ফল না মেনে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে নির্দেশ দেন, তাকে বিজয়ী ঘোষণা দিতে। কিন্তু মাইক পেন্স সেই অনুরোধে বা নির্দেশে সাড়া দেননি। তিনি নির্বাচনের ফল মেনে নিয়ে জো বাইডেনের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়ার আয়োজন সম্পন্ন করেন। এখানেই শেষ নয়, ট্রাম্প যেসব ঘটনা ঘটিয়েছেন, তারপরও তিনি প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী এবং তাকে প্রায় সমান সংখ্যক ভোটার সমর্থন করছেন- এটাই তার অর্জন। বিশ্লেষকরা বলেন, দাম্ভিকতা, অহংবোধ এবং বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজকে, রাজনীতিকে বিভক্ত করার চেষ্টা করছেন ট্রাম্প। নিকট অতীতে এতটা বিভক্ত ছিল না যুক্তরাষ্ট্র। তিনি নির্বাচিত হলে গাজা, ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু কীভাবে তা করবেন সে বিষয়ে বিস্তারিত বলেননি। এটা এমনও হতে পারে মুসলিমদের ভোট পাওয়ার কৌশল। যতটা মুসলিমপ্রেমী হিসেবে তাকে মনে করা হচ্ছে এখন, আদতে তিনি ততটা নন। মনে আছে, প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তিনি ফিলিস্তিন, সৌদি আরব সহ মুসলিমদের বিরোধিতার মুখে জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দেন। তেলআবিব থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস সেখানে স্থানান্তরিত করেন। ট্রাম্পের বিতর্ক এখানেই শেষ নয়। ২০২০ সালে করোনা মহামারিতে যুক্তরাষ্ট্রে যখন মৃত্যুর মিছিল, তখন তিনি নিজে মুখে মাস্ক না পরে টিকাবিরোধী প্রপাগান্ডা চালান। ফলে তিনি যে জনমানুষের কথা খুব বেশি ভাবেন বা তাদেরকে প্রাধান্য দেন- তেমনটা হলফ করে বলা যায় না।

তবু তিনি নির্বাচন করছেন। কারণ, নির্বাচিত হলে তার বিরুদ্ধে যারা আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছেন- তাদেরকে তিনি দেখে নেবেন।
২০১৬ সালের নির্বাচনে ডেমোক্রেট প্রার্থী ছিলেন হিলারি ক্লিনটন ও রিপাবলিকান ডনাল্ড ট্রাম্প। সেই নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের অভিযোগ আছে। তার আট বছর পর আবার মঙ্গলবার নির্বাচন। এবারও বিদেশি হস্তক্ষেপের ভয় আছে। এমন হস্তক্ষেপ করতে পারে রাশিয়া, চীন ও ইরান। আগের চেয়ে এই হস্তক্ষেপের আশঙ্কা অনেক বেড়েছে। যদি হস্তক্ষেপ হয় তাহলে তা শনাক্ত করা খুব জটিল হবে। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা ও প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা, প্রযুক্তি বিষয়ক কোম্পানি এবং একাডেমিক গবেষকদের মতে, রাশিয়া, চীন এবং ইরানের মতো বিদেশি বিভিন্ন দেশ থেকে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। তারা ক্রমশ তাদের এই কৌশল বৃদ্ধি করছে। তারা যদি সামান্য ভোটের ব্যবধান ঘটাতে পারে, তাহলে তাতে নির্বাচনের ফল বদলে যেতে পারে। গোয়েন্দা মূল্যায়নে বলা হয়েছে, গত নির্বাচনে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন করেছিল রাশিয়া। এবার তারা তা আরও বৃদ্ধি করতে পারে। তবে তার প্রতিপক্ষ কমালা হ্যারিসকে পছন্দ করে ইরান। কারণ, প্রথম মেয়াদে নির্বাচিত হয়ে ট্রাম্প ইরানের বিরুদ্ধে দেয়া নিষেধাজ্ঞা বহাল করেন। এতে ইরান নতুন করে আর্থিক সংকটে পড়ে।

রাশিয়া এবং ইরানের পছন্দের প্রার্থী থাকলেও চীনের দৃশ্যত কোনো পছন্দ নেই এই নির্বাচনে। কিন্তু তাদের লক্ষ্য পরিবর্তন হয়নি। তাদের উদ্দেশ্য বিশ্বের চোখে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রকে বিশৃঙ্খল ও অসম্মানিত করা। প্রচারণায় আবির্ভাব ঘটেছে পাল্টে যাওয়া মিডিয়া ব্যবস্থা এবং প্রযুক্তির নতুন নতুন হাতিয়ার। এর ফলে মানুষকে বোকা বানানো সহজ হয়েছে। ২০১৬ সালের নির্বাচন নিয়ে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দেয়ার প্রাথমিক কারিগর রাশিয়া। তারা ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে প্রধানত এটা করেছে। এখন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে প্রভাব সৃষ্টি করতে একই রকমভাবে যুক্ত ইরান ও চীন। এই তিনটি দেশ কয়েক ডজন প্ল্যাটফরমে তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। যেসব মাধ্যম মার্কিনিরা ব্যবহার করে, মার্কিনিরা চ্যাট করে, আবহাওয়া জানতে চায়- এমন সব মাধ্যমে তারা তাদের আগ্রহকে শেয়ার করছে। এসব দেশ একটি অন্যটির থেকে কৌশল জানছে। তবে তাদের মধ্যে সরাসরি কৌশলগত কোনো সহযোগিতা আছে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক আছে।  টেলিগ্রামে বিভক্তি সৃষ্টিকারী জিনিসপত্র ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে রাশিয়ান অ্যাকাউন্ট থেকে। তার মধ্যে কখনো কখনো পোস্ট দেয়া হচ্ছে বিষোদ্গারমূলক ভিডিও, মেমে ও বিভিন্ন রকম নিবন্ধ। চীন থেকে এমন শত শত অ্যাকাউন্ট আছে। তাতে গাজা যুদ্ধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাম্পাসগুলোতে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। কম গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ‘গ্যাব’-এ অ্যাকাউন্ট আছে দু’টি দেশেরই। উগ্র ডানপন্থিদের কাছে এই মাধ্যম পছন্দের। এখানে তারা ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে অনুমোদন দিতে কাজ করে। রেডিট নামের অনলাইনে ডনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন দিতে চেষ্টা করেছে রাশিয়ার অপারেটিভরা। রেডিফ ফোরামটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে উগ্র ডানপন্থিরা। এর মধ্যদিয়ে হিস্প্যানিক আমেরিকান, ভিডিও গেমার এবং ট্রাম্পের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে চিহ্নিতদের সহ ৬টি সুইং স্টেটের ভোটারদের টার্গেট করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আইন মন্ত্রণালয় এসব তথ্য প্রকাশ করেছে সেপ্টেম্বরে।

ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে দিতে সম্পদ ব্যবহার করেছে ইরান। ‘নট আওয়ার ওয়্যার’ নামের একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান সামরিক কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। এতে আমেরিকাবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি ও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। ‘আফ্রো মেজরিটি’ নামের আরেকটি সাইটে কন্টেন্ট সৃষ্টি করা হয়েছে কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিনিদের টার্গেট করে। ‘সাভানা টাইমস’ নামের আরেকটি সাইটে জর্জিয়া সুইং স্টেটের ভোটারদেরকে আন্দোলিত করার চেষ্টা করেছে। আরেকটি সুইং স্টেট মিশিগানে ইরান সৃষ্টি করেছে অনলাইন আউটলেট ‘ওয়েস্টল্যান্ড সান’। ডেট্রয়েটে বসবাসকারী আরব আমেরিকানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে তৈরি করা হয়েছে এই সাইট। ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসির সিনিয়র বিশ্লেষক ম্যাক্স লেসার বলেন, মিশিগানে আরব ও মুসলিম জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করবে ইরান। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ইরান জানে।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.