জয়োল্লাসে ভাসে দেশ


 উত্তর আকাশের কালো মেঘ কেটে গেছে। দীর্ঘ ১৬ বছরের একদলীয় শাসনের অবসান হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারকে উৎখাত করেছে ছাত্র-জনতা। দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন  শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা। তাতেই বিজয় উল্লাসে মেতেছেন আপামর জনতা। দুপুরের পর থেকেই আন্দোলন-সংগ্রামের তীর্থস্থান শাহবাগে আসতে থাকেন মুক্তিকামী মানুষ। এদিন রাজধানীর সব বিজয় মিছিলের স্রোত মিশেছে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে। সেখান থেকে বিজয়ী ছাত্র-জনতা দখলে নেন গণভবন। বিজয়ের এ মিছিলের শক্তি হয়ে ছিলেন আবু সাঈদ ও দীপ্ত দে’র মতো তিন শতাধিক শহীদ। তাদের রক্তেই এসেছে চূড়ান্ত বিজয়। জাতির পতাকা খামচে ধরা পুরনো শকুন থেকে মুক্তি পেয়েছে। বাংলার আকাশে পত্পত্ করে উড়ছে লাল-সবুজের রক্তাক্ত পতাকা। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর এ যেন পুনর্জন্ম বাংলাদেশের। যে জন্মের পিছনে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে রয়েছে সব বয়সী ছাত্র-জনতার রক্ত। কোটা সংস্কারের যৌক্তিক আন্দোলনে নামার পর ছাত্রদের ওপর নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল হাসিনা সরকার। মাসব্যাপী চলা সংঘাত-সংঘর্ষের ইতি ঘটেছে। তবে বিজয়ের দিনও সুখকর ছিল না ছাত্রদের জন্য। এদিনও সকাল থেকে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। রাজধানীসহ সারা দেশে হত্যা করা হয়েছে ১৩ জনকে। ‘মার্চ টু ঢাকা’- কর্মসূচির অংশ হিসেবে সোমবার সকাল থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় জড়ো হতে থাকেন ছাত্র-জনতা। কিন্তু এদিনও নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জড়ো হওয়া শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা, গুলি, টিয়ারশেল নিক্ষেপ ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়া হয়। আহত হন অসংখ্য শিক্ষার্থী। আটক করা হয় তিনজনকে। একই সময়ে উত্তরাসহ বিভিন্ন এলাকায় নামতে চাওয়া শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দুপুরে যখন অন্তর্বর্তী সরকারের বিষয় আলোচনায় আসে তখনও হামলা চালানো হয় ছাত্র-জনতার ওপর। কিন্তু শেখ হাসিনার পদত্যাগ করার খবরে রাস্তায় নেমে আসে লাখ লাখ মানুষ। পিছু হটে পুলিশ। যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, উত্তরা, মিরপুর, মহাখালী, গাবতলী, নিকেতন, বাড্ডা, আজিমপুর, পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে লাখ লাখ মানুষ নেমে আসে রাস্তায়। বিজয় উল্লাসে মাতেন আপামর ছাত্র-জনতা। এ সময় সমন্বয়করা সবাইকে শাহবাগে আসার আহ্বান জানান। রাজধানীর অলিতে গলিতে শুরু হওয়া মিছিলগুলো শাহবাগের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। যে মিছিলের স্লোগান ছিল- ‘এইমাত্র খবর হলো, শেখ হাসিনা পালিয়ে গেল’, ‘হৈ হৈ রই রই, শেখ হাসিনা গেলি কই’, ‘এইমাত্র খবর হলো, বাংলাদেশ স্বাধীন হলো’, ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’, ‘কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার’, ‘লাখো শহীদের রক্তে কেনা, দেশটা কারও বাপের না’, ‘শহীদের রক্ত, বৃথা যেতে পারে না’- ইত্যাদি স্লোগান দেন। মিছিলে শামিল হয়ে একে-অপরকে মিষ্টি খাওয়ান জনতা। অল্প সময়ের মধ্যেই মিষ্টির দোকানের সবমিষ্টি পুরিয়ে যায়। শাহবাগের বিজয় উদ্যাপনে ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা। সেখান থেকে বিজয় মিছিল নিয়ে গণভবনে যান আন্দোলনকারীরা। এ সময় ছাত্রদের পাশাপাশি অভিভাবকরাও এসেছেন। শিশু থেকে আবাল বৃদ্ধ সবাই মেতেছেন আনন্দ উল্লাসে। বিজয়ের মিছিলে থাকা আয়েশা আক্তার নামে এক নারী বলেন, দেশটাকে ধ্বংস করেছেন হাসিনা। তার পতনে আমাদের এ বিজয় উল্লাস। উদ্বেলিত জনতা সংসদ ভবনে প্রবেশ করেও আনন্দ উল্লাস করেছেন। এ সময় সেখানে লুটপাটের ঘটনা ঘটে। সংসদ ভবনের সামনে বিজয় মিছিলে আসা একজন বলেন, আমাদের তিনজনকে সকালে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হাসিনার পদত্যাগের পর আমাদের ছেড়ে দেয়া হয়। এদিকে গণভবনে উল্লাসে থাকা জনতার মধ্যে অনেকে সেখানকার আসবাবপত্রসহ সব ধ্বংস ও নিয়ে যান। এদিকে রাজপথে লাখ লাখ মানুষের বিজয় মিছিল ছাড়াও আশপাশের সব দালান থেকে বিজয়ী জনতাকে অভিনন্দন জানান ঢাকাবাসী। কেউ কেউ পানিসহ বিভিন্ন খাবারও নিয়ে আসেন ছাত্র-জনতার জন্য। ঢাকা ছাড়াও দেশের সব জেলায় আনন্দ মিছিল করেছেন ছাত্র-জনতা। চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিলেট, রংপুর, বগুড়া, ঠাকুরগাঁও, সাতক্ষীরা, খুলনা, বরিশাল, পিরোজপুর, নোয়াখালীসহ দেশের সব জায়গায় আনন্দে মেতেছে জনতা। জেলা ও উপজেলা শহর ছাড়াও গ্রামে-গঞ্জেও বিজয় মিছিল করেছেন আপামর জনতা। সেখান থেকে নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নেন তারা। জানান, এখন থেকে বাংলাদেশ হবে সবার। যেখানে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সকলের অধিকার নিশ্চিত করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.