১৮ বছর পর স্ত্রী ও সন্তানের স্বীকৃতি: যশোর কারাভ্যন্তরে মালা ইসলাম দম্পতির বিয়ে

১৮ বছর পর স্ত্রী সন্তানের স্বীকৃতি প্রদানকারী ইসলামের মুক্তি মেলেনি। মুক্তির আশায় যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে দিন কাটছে তার। আর কারাফটকের বাইরে অপেক্ষা করছেন স্ত্রী, সন্তান আর আত্মীয়স্বজনরা। কারা কর্তৃপক্ষ বলছেন, উচ্চ আদালতের রায়ের কপি তাদের কাছে না পৌঁছানো পর্যন্ত এ ব্যাপারে তাদের কিছু করার নেই। তবে আদালতের আদেশ পৌঁছানো মাত্রই ইসলামকে কারামুক্ত করার যাবতীয় প্রস্তুতি তারা নিয়ে রেখেছেন। একই সঙ্গে এই দম্পতির বিবাহ-উত্তর সংবর্ধনার যাবতীয় আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন কারা কর্তৃপক্ষ। জেলার আবু তালেব জানান, আমার চাকরি জীবনে এই রকম একটি ঘটনার সাক্ষী হতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। তাই ঘটনাটিকে আরো স্মরণীয় করে রাখতে ইসলাম দম্পতির বিবাহ-উত্তর সংবর্ধনার আয়োজন করা হচ্ছে।
কেনা হচ্ছে বিয়ের সব রকম পোশাক। ইসলাম ও তার স্ত্রী মালাকে নতুন করে বর-বউ সাজিয়ে তুলে দেয়া হবে তাদের একমাত্র সন্তান মিলনের হাতে। এদিকে ইসলাম দম্পতিকে ঘিরে তাদের নিজ গ্রামেও আনন্দ উৎসবের প্রস্তুতি চলছে বলে জানান কারাফটকে অপেক্ষমাণ তাদের স্বজনরা। আর পিতামাতার মিলন দেখার জন্য ছেলে মিলনেরও প্রস্তুতির কমতি নেই। সে ইতিমধ্যে পিতার জন্য শেরওয়ানি আর মায়ের জন্য লাল বেনারসি কিনেছেন। সাজাবেন ফুলের বাসর। মিলন জানান, ১৮ বছর পিতার স্বীকৃতি পাইনি। আমার মা পায়নি স্বামীর অধিকার। এখন উচ্চ আদালতের রায়ে তা সম্ভব হয়েছে। আদালতের নির্দেশে দ্বিতীয় দফায় আমার মা ও বাবার বিয়ে হয়েছে কারাগারে। এই ঘটনাটি আমিও স্মরণীয় করে রাখতে চাই। এজন্য একজন নতুন দম্পতির বিয়েতে যা যা হয় তার সবই করা হবে আমার মা আর বাবাকে ঘিরে। এখন অপেক্ষা শুধু বাবা কবে কারামুক্ত হবেন। মা ও আমি প্রতিদিন কারাগারের প্রধান ফটকে অপেক্ষা করছি। কবে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবো তা সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন। তবে অপেক্ষার প্রহর শেষ হতে চাচ্ছে না।
ঝিনাইদহের লক্ষ্মীপুর গ্রামের আজিজ মৃধার ছেলে ইসলাম। দীর্ঘদিন প্রেম করার পর ২০০০ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি পালিয়ে ইসলাম ও মালা স্থানীয় এক মৌলভীর মাধ্যমে গোপনে বিয়ে করে। মালা একই গ্রামের আবদুর রহমানের মেয়ে। মালাকে ইসলাম নিজের বাড়িতে তুলতে সাহস পাননি পরিবারের ভয়ে। কিন্তু বিয়ের পর থেকে ইসলাম ও মালা দম্পতি বিভিন্ন স্থানে শারীরিকভাবে মিলিত হতে থাকেন। এক পর্যায়ে বিয়ের পর পরই মালা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে ইসলাম তাকে অস্বীকৃতি জানায়। গর্ভের সন্তানের পিতৃপরিচয়ের দাবি নিয়ে মালা ইসলামের বাড়ি গেলে তাকে ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হয়। কুলটা-নষ্টা বলে মালাকে তিরস্কার করে ইসলামের পরিবারের লোকেরা। লোকলজ্জার ভয়ে মালা গর্ভের সন্তানসহ বহুবার আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে গিয়েও সাত-পাঁচ ভেবে তা করেননি। শেষ পর্যন্ত ১০ মাস ১০ দিন পর ২০০১ সালের ২১শে জানুয়ারি স্বাভাবিক নিয়মে মালার কোলজুড়ে আসে এক ফুটফুটে পুত্রসন্তান। নাম রাখেন মিলন। মিলন ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মালার পিতা বাদী হয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে ২০০১ সালে ধর্ষণের একটি মামলা করেন ঝিনাইদহ নারী ও শিশু নির্যাতন স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে। আদালতের নির্দেশে পুলিশ ইসলামকে আটক করে। কিন্তু ইসলাম আদালতেও মালা ও তার সন্তানকে অস্বীকার করে। ফলে মালার আবেদনের প্রেক্ষিতে পুত্র মিলনের ডিএনএ টেস্ট করা হলে তার পিতৃপরিচয় নিশ্চিত হয়। আদালত ওই মামলায় ইসলামকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ প্রদান করেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে ইসলাম আপিল করলে রায় বহাল রাখেন উচ্চ আদালত। উচ্চ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন করলে সেখানেও ইসলামের সাজার রায় বহাল থাকে। পরে আপিল রিভিউ আবেদন করেন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ইসলাম। ইসলামের করা রিভিউ শুনানিতে আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির বেঞ্চে মালা ও মিলনের স্বীকৃতির বিষয়টি সামনে আনেন। ১৮ বছর পর ইসলামের আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল আপিল বিভাগকে জানান মালা ইসলামেরই স্ত্রী। আর মিলন যে ইসলামের সন্তান সেটা উচ্চ আদালতের আদেশের পর ডিএনএ প্রতিবেদনেও প্রমাণিত। বর্তমানে ইসলাম মালাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে চাই। মিলনকে সন্তানের স্বীকৃতি দিয়ে স্ত্রী ও সন্তানকে সে নিজ বাড়িতে তুলে নিতে চায়। ইসলামের আইনজীবীর এই বক্তব্য শোনার পর গত রোববার প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এক আদেশে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষকে কারাভ্যন্তরে ইসলাম ও মালার পুনরায় বিবাহ পড়ানোর নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলারকে আগামী ২৯শে আগস্ট এ বিষয়ে অগ্রগতি জানাতে নির্দেশ দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার আবু তালেব বলেন, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ইসলাম আদালতে জামিনের জন্য আবেদন করেন। আদালত শর্ত দেন মালাকে স্ত্রী ও মিলনকে সন্তানের স্বীকৃতি দিলে জামিন দেয়া হবে। আদালতের শর্তে ইসলাম রাজি হন। এরপর আদালতের নির্দেশে জেলা প্রশাসকের অনুমতিক্রমে বুধবার কেন্দ্রীয় কারাগারের ভারপ্রাপ্ত সুপার, দু’পক্ষের আত্মীয়স্বজন ও তাদের ছেলে মিলনের উপস্থিতিতে ইসলাম ও মালার বিয়ে দেয়া হয়। বিয়ের কাবিন উচ্চ আদালতে জমা দেন।
এ বিষয়ে গতকাল বিকালে জেলার আবু তালেবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, উচ্চ আদালতের আদেশ হাতে পৌঁছানো মাত্রই ইসলামেক কারামুক্ত করা হবে। তার যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রাখা হয়েছে। এছাড়া এমন একটি ঘটনাকে আরো স্মরণীয় করে রাখতে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। জামিনে মুক্ত হলে ইসলামকে নতুন পোশাকে বরের বেশে সাজানো হবে। মালাকে সাজানো হবে বউয়ের বেশে। তার পর কারাগারের সামনের উন্মুক্ত মঞ্চে তাদের বিবাহ-উত্তর সংবর্ধনা প্রদান করা হবে। এরপর ফুল দিয়ে সাজানো বিয়ের গাড়িতে করে বর-বউ ও তাদের একমাত্র পুত্রকে বাড়িতে পাঠানো হবে। এ ধরনের প্রস্তুতি জেল কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেছে।

No comments

Powered by Blogger.