সাবধান! বাসায় বাসায় গ্যাস বোমা by মরিয়ম চম্পা

আপনি হয়তো জানেনই না যে, আপনার প্রিয় বাসাটি একটি বড় ‘গ্যাস চেম্বার বা বোমায়’ পরিণত হয়ে আছে। এই বোমাটি একটি ইলেক্ট্রিক স্পার্কিং কিংবা যুতসই থার্মাল সোর্স (আগুন) পেলেই বিস্ফোরিত হয়ে কেড়ে নিতে পারে আপনার পুরো পরিবার। অবাক হচ্ছেন? না, অবাক হবেন না। কারণ, এদেশের বর্তমান ত্রুটিপূর্ণ নগর ব্যবস্থার অসংখ্য বাসাবাড়ির ক্ষেত্রেই এই কথাটি প্রযোজ্য। ইদানীং কয়েকটি বিস্ফোরণের ঘটনা থেকে বিষয়টি হয়তো অনেকের নজরে এসেছে। কিন্তু, আমরা (বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, সিটিটিসি, ডিএমপি) দীর্ঘ ১০ বছর ধরে এই ঢাকা শহরেই প্রায় অর্ধশত বাসা, দোকান এবং অফিস কক্ষে এই ধরনের বিস্ফোরণ ঘটতে দেখেছি। এসব ঘটনায় মারাত্মকভাবে দগ্ধ হয়ে নিহত এবং আহত মানুষের সংখ্যা এই শহরের সন্ত্রাসী বোমা হামলায় হতাহতদের মোট সংখ্যার থেকেও অনেক বেশি।
কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ সানোয়ার হোসেন এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে এভাবেই সতর্ক করেছেন ‘গ্যাস বোমার’ ব্যাপারে। সম্প্রতি গ্যাস বোমায় একাধিক বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে বড় বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটে গত ২৪শে মার্চ রাতে ময়মনসিংহের ভালুকায়। গ্যাস থেকে ঘটা ওই বিস্ফোরণে মারাত্মক দগ্ধ হন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাওহীদুল ইসলাম, শাহীন মিয়া, হাফিজুর রহমান ও দীপ্ত সরকার। তাওহীদুল ইসলাম ঘটনাস্থলেই মারা যান। বাকিরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। এই চার মেধাবী শিক্ষার্থীর মৃত্যু সারা দেশের মানুষকেই নাড়া দিয়েছে। শোকের সাগরে ভাসিয়েছে তাদের সহপাঠীদের।
গত ২৭শে মার্চ পল্লবীর মুসলিমবাগ এলাকায় একটি বাড়িতে পানির ট্যাঙ্ক বিস্ফোরণের ঘটনায় শিশুসহ পাঁচজন দগ্ধ হয়। ওই বাড়ির নিচতলায় থাকা পানির ট্যাঙ্কে পানি আছে কিনা, তা দেখার জন্য দেশলাই জ্বালাতেই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে আগুন ধরে যায়। এতে দগ্ধ হন পাঁচ জন। তাদের মধ্যে হাসিন আরা বেগম, হাসান এবং ৩ বছর বয়সী শিশু রুহী মারা যান। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আবাসিক চিকিৎসক পার্থ শংকর পাল জানান, দগ্ধদের মধ্যে হাসিন আরা খানমের ৯৫ শতাংশ, রুহির ৯০ শতাংশ ও হাসানের ৮৫ শতাংশ পুড়ে যায়। জানা যায়, ঘটনার দিন ১১টার দিকে ওই বাড়ির রিজার্ভ ট্যাংক পরিষ্কার করার জন্য হাসান নামে একজন শ্রমিক ট্যাঙ্কের ঢাকনা খুলে টর্চলাইট দিয়ে আর্বজনা দেখছিলেন। এসময় তিনি ট্যাঙ্কের মধ্যে গ্যাসের গন্ধ পান। সেটা দূর করতে তিনি সেখানে মোম জ্বালান। তখনই বিস্ফোরণ হয়ে আগুন ধরে যায়। এতে সেখানে থাকা পাঁচজনই দগ্ধ হন।
পুলিশ কর্মকর্তা সানোয়ার হোসেনের স্ট্যাটাসে দেয়া তথ্যে আরো বেশকিছু দুর্ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। ২০০৯ সালে গুলশানের একটি বাসায় এমন একটি বিস্ফোরণের ফলে বিল্ডিং-এর দেয়াল প্রায় ১০/১২ ফুট দূরে গিয়ে একটি গাড়ির ওপর পড়ে। টয়লেটে গিয়ে সিগারেট ধরাতেই এই ঘটনাটি ঘটে। এতে ওই ব্যক্তি মারাত্মকভাবে দগ্ধ হওয়ার পর এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুরে নেয়ার পথে মারা যান। ২০১১ সালের দিকে কোতোয়ালি এলাকায় একটি সেলুনে বিস্ফোরণ ঘটে। একই বছর এলিফ্যান্ট রোডের একটি শোরুমে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ২০১২ সালে মিরপুরের একটি বাসায় বিস্ফোরণ হয়। ২০১৩ সালে ভূতেরগলির একটি বাসায় এ ধরনের ঘটনা ঘটে। ২০১৫ সালে হাজারীবাগে একটি টয়লেটে বসে সিগারেট ধরাতে গেলে বিস্ফোরণ ঘটে। অনুসন্ধান করে দেখা যায় যে, বাসার টয়লেটের লাইনের একটি ছিদ্র গ্যাস লাইনের একটি ছিদ্রের সঙ্গে কাকতালীয়ভাবে একটি জায়গায় মিশে গেছে। সেই ছিদ্র দিয়ে গ্যাস প্রবেশ করায় দু’তলার ঐ টয়লেটটি একটি ‘গ্যাস চেম্বার’-এ পরিণত হয়। এতেই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ২০১৮ সালে ভালুকা এবং পল্লবী ছাড়াও কুমিল্লায় একটি ঘটনা ঘটেছে। এভাবে গত ১০ বছরে প্রায় একশ’টি ঘটনা বা বিস্ফোরণ ঘটেছে।
ঢামেকের বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, প্রতিদিন ইনডোরে গড়ে ৩০-৪০ জন দগ্ধ রোগী ভর্তি হচ্ছেন। এছাড়া আউটডোরে প্রায় ১০০-১৫০ জন রোগী চিকিৎসাসেবা নিতে আসে। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি আগুনে দগ্ধ হয় রান্না করতে গিয়ে। তিনি বলেন, ৮০%, ৯০% বার্ন আমরা কোনোদিন বাঁচাতে পারবো না। আমরা প্রতিদিনই আপনাদের বলবো যে রোগীর শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। এটা কোনো সমাধান নয়। মানুষ যাতে না পোড়ে সেদিকে আমাদের নজর দিতে হবে। এটা হচ্ছে আমাদের সকলের এখন মেইন কাজ। নির্দিষ্ট একটি মনিটরিংয়ের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করতে হবে। গতকাল রাতে ও আজ সকালে তিনজন এসেছে। এভাবে আসতেই থাকবে। চারটা ব্রিলিয়ান্ট ছেলে যারা মারা গেল তাদেরকে বাবা-মা কতো কষ্ট করে পড়াশোনা করিয়েছে। অনেক চেষ্টা করেও তাদের বাঁচানো গেল না। কারণ একজন মানুষের শরীরের ৯০% যখন পুড়ে যায় সেই রোগী আর বাঁচে না। এ বিষয়ে সোচ্চার না হলে শুধু আমরা কি চিকিৎসা করলাম আর আপনারা কি প্রতিবেদন লিখলেন এটা কোনো সমাধান নয়। সামন্ত লাল বলেন, আমাদের দেশের অধিকাংশ দুর্ঘটনার বিষয় আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সত্ত্বেও আমরা দুর্ঘটনার শিকার হই। এর প্রধান কারণ হচ্ছে সচেতনতার অভাব। এক্ষেত্রে ওয়াসা, বিদ্যুৎ বিভাগ, তিতাস প্রত্যেকেরই উচিত গণ ও জনসচেতনতা তৈরি করা। পোশাক কারখানার দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাবো মালিকরা কোনোদিন ব্রয়লার ঠিকমতো চেক করে দেখে না। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৬ লাখ মানুষ আগুনে দগ্ধ। যদি একটু সচেতনতা তৈরি করা যায় তাহলে এই ৬ লাখ মানুষের বেশিরভাগকেই সুরক্ষা দেয়া সম্ভব।
এদিকে শ্রমিক অধিকারবিষয়ক সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)-এর তথ্যমতে, ২০১৭ সালের প্রথম ১০ মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে সেপটিক ট্যাঙ্কে নেমে ৩১ জন শ্রমিক মারা গেছেন, যা বিগত বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
সাবধানতার পরামর্শ পুলিশ কর্মকর্তার: নিজের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার, বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট স্পেশাল অ্যাকশন ডিভিশন, কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম, ডিএমপি মোহাম্মদ সানোয়ার হোসেন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে আরো লিখেছেন, গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত গ্যাসের ত্রুটিপূর্ণ চুলা বা সরবরাহ লাইনের ত্রুটির কারণে গ্যাস লিকেজ হয়ে ঘরের আনাচে কানাচে তা জমে থাকে। জমে থাকা এই গ্যাস কোনো আগুন কিংবা ইলেক্ট্রিক শর্টসার্কিটের সংস্পর্শে আসা মাত্র প্রজ্বলিত (ওমহরঃবফ) হয়ে প্রচুর তাপ, চাপ ও শব্দের উৎপত্তি করে বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে। এভাবেই কিছু বুঝে ওঠার আগে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে অগণিত শহুরে মানুষের প্রাণ।
এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনাই সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশ পেলেও ত্রুটিবিচ্যুতি নির্ণয় করে পুরোপুরি সচেতন করা সম্ভব হয়নি। সেই সঙ্গে কোনো সমন্বিত উদ্যোগও চোখে পড়েনি। গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা ত্রুটিবিচ্যুতিগুলো তুলে ধরায় কিছু কিছু মানুষ জানলেও তা মোট নগরবাসীর তুলনায় অপ্রতুল। ফলে অনেকের অগোচরেই একেকটি বাসা একটি ‘বৃহৎ গ্যাস বোমা’য় পরিণত হয়ে যাচ্ছে। এতে মারাত্মকভাবে ঝুঁকির মধ্যে পরে যাচ্ছে আমাদের আধুনিক, তবে ত্রুটিপূর্ণ নগর সভ্যতার অসংখ্য বাসাবাড়ি, অফিস-আদালত এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। শুধুমাত্র একটু সচেতন হলেই সবাই সপরিবারে সম্পূর্ণরূপে নিরাপদ। আমি কাউকে আতকিঙ্কত করছি না, আবার একেবারে নিরাপদ আছেন তাও বলছি না। বরং সচেতন হতে পরামর্শ দিচ্ছি।
আর করণীয় সম্পর্কে একটু ধারণা দিচ্ছি: ১. ত্রুটিমুক্ত গ্যাসের চুলা এবং মানসম্মত গ্যাস পাইপ ব্যবহার করে তা নিয়মিতভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। ২. বাসার আর্কিটেকচারাল ডিজাইন প্রস্তুত করার সময় নিশ্চিত রাখতে হবে যেন পুরো বাসার আনাচে কানাচে বাতাস অবিরাম যাতায়াত (ঈরহংঃধহঃ ঋষড়-িঈঋ) করতে পারে। ৩. বাসা দীর্ঘ সময় ধরে বদ্ধ থাকলে দরজা- জানালা খুলে এয়ার ফ্লো নিশ্চিত করে বিদ্যুতের সুইচ চাপতে হবে, কিংবা চুলায় আগুন জ্বালাতে হবে। ৪. রান্নাঘরে সর্বোচ্চ পরিমাণ ভেন্টিলেশন সিস্টেম নিশ্চিত করতে হবে। ৫. বাসার ভেতর কোনো গ্যাস সিলিন্ডার রাখা যাবে না। পাইপের মাধ্যমে দূর থেকে চুলায় গ্যাস সংযোগ নিতে হবে। ৬. বাসার ইলেক্ট্রিক ওয়ারিং-এ ভালো মানের তার ব্যবহার করতে হবে। তারের মধ্যে কোনো প্রকার জোড়াতালি থাকা যাবে না। ত্রুটিমুক্ত সুইচ ব্যবহার করতে হবে। ৭. বাসায় ত্রুটিপূর্ণ কোনো ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস না রাখাই ভালো। কেননা, ইলেক্ট্রিক এবং থার্মাল- এই দুটো ইগনিশন সোর্সই যেকোনো ত্রুটিপূর্ণ ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস থেকে সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি খোদ ডিভাইসটিও বিস্ফোরিত হতে পারে। ২০১০ সালে রামপুরায় একটি মাইক্রোওয়েভ ওভেন বিস্ফোরিত হয়ে ব্যবহারকারী দগ্ধ হয়ে মারা যায়। ৮. বাসার ভেতর আবদ্ধ জায়গায় মোমবাতি জ্বালানো এবং ধূমপান করা থেকে বিরত থাকাই উত্তম। ৯. বাসার ভেতর জমে থাকা গ্যাসের অস্তিত্ব নিশ্চিত করার জন্য স্বল্প মূল্যের এক ধরনের ‘গ্যাস ডিটেকশন ডিভাইস’ পাওয়া যায়। সেগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে। আপনারা সবাই সপরিবারে সুস্থ থাকুন এবং অন্যদের সুস্থতাও নিশ্চিত করুন।

No comments

Powered by Blogger.