মানবাধিকার আন্দোলনের নতুন দিশা লাগবে by মং জার্নি

অধিকারভিত্তিক প্রচারণা ও মানবাধিকার-বিষয়ক বেসরকারি সংস্থাগুলো (এনজিও) নৈতিকভাবে ব্যর্থ হলেও সহজে পার পেয়ে যায়। তবে বিদ্যায়নের মানুষ ও কিছু সহানুভূতিশীল সাংবাদিকের কল্যাণে লেখক ফ্রাঞ্জ ফানোনের কথিত ‘জগতের লাঞ্ছিত ও ভাগ্যহতদের’ দুর্দশার প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে। আর এভাবেই মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের গণহত্যা করার বিষয়টি ‘নজরে রাখার মতো সংঘাতের’ তালিকায় উঠে এসেছে। মিয়ানমারের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ভুলও কম নয়; বরং অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। আমার জন্মের দেশ এক কুখ্যাত তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত হয়েছে এবং সেখানে আমরা মানবাধিকার-কর্মীরা জনগণের অধিকারের সুরক্ষা দিতে যা করেছি, তা সব বিচারেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। ফলে এখন সময় এসেছে, মানবাধিকার-বিষয়ক সংস্থাগুলো যেসব ভুল করেছে, তা কঠোরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। দেশটিতে একদিকে রোহিঙ্গাদের গণহত্যা করা হচ্ছে, অন্যদিকে কাচিন ও তাংয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক যুদ্ধ চালানো হচ্ছে। আরাকানিরা প্রতিরোধের চেষ্টা করছে এবং যে স্থানীয় সাংবাদিকেরা গণহত্যার দাপ্তরিক ভাষ্য অনুসরণ করেন না, তাঁদের ও প্রকৃত নাগরিক অধিকারকর্মীদের ওপর মারাত্মক হামলা চালানো হচ্ছে। আমি সাত বছর ধরে সতর্কবার্তা দিয়ে যাচ্ছি যে বার্মিজ স্প্রিং নিয়ে যে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হচ্ছে, তা আসলে দেশটির সামরিক বাহিনী কর্তৃক বিদেশি করপোরেট ও সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলা ছাড়া কিছু নয়। মিয়ানমারের মানবাধিকার সংগঠনগুলোই ‘গণতান্ত্রিক’ রূপান্তরের গোলকধাঁধা তৈরি করেছিল। গভীর দুঃখের সঙ্গে আমি দেখেছি, বিমানভর্তি হিউম্যান রাইটস ওয়াচের কর্মকর্তারা এমন সময় সাবেক প্রেসিডেন্ট থিয়েন সেইনের সঙ্গে মানবাধিকার নিয়ে কথা বলেছেন, যখন ১ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গাকে কাঁটাতারে ঘেরা আইডিপি শিবিরে আটকে রাখা হয়েছিল, যেখান থেকে তাদের কখনো বেরোতে দেওয়া হয়নি। হার্ভার্ডের মানবাধিকার-বিষয়ক যে গবেষকেরা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর গণহত্যার দৃশ্য ধারণ করেছেন, তাঁদের মধ্যম সারির সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে চায়ের দাওয়াতে আন্তর্জাতিক অপরাধ নিয়ে কথা বলতে হয়েছে। বার্মিজ স্প্রিংয়ের জমিন, অর্থাৎ গণতন্ত্রের বিকাশ ও সংস্কার, শেষমেশ ভৌতিক গণকবর, পোড়া গ্রাম ও গুঁড়িয়ে যাওয়া মসজিদ জমিনে পরিণত হয়েছে। ইয়াঙ্গুনে অং সান সু চির ঔপনিবেশিক আমলের সেই বাড়ি এখন আর মানবাধিকার-কর্মীদের মক্কা নয়। তিনি এখন সেনাবাহিনীর কাতারে দাঁড়িয়ে গেছেন। ব্যাপারটা হলো, মানবাধিকার-বিষয়ক তৎপরতা তখনই ব্যর্থ হলো, যখন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গণহত্যার বিষয়ে একটি বাধ্যবাধকতাহীন প্রস্তাবও পাস হলো না। মানুষকে গণহত্যা থেকে বাঁচানোর ক্ষেত্রে এই সংস্থার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তার তরফ থেকে সে রকম অতিপ্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এখনো আকাশ-কুসুম স্বপ্নের মতো, যেটা মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের বাঁচার একমাত্র উপায় ছিল। এই ভুক্তভোগীদের সমস্যা হলো, সব প্রচেষ্টা নিরাপত্তা পরিষদে এসে থেমে গেল। এ সংস্থাটি দীর্ঘদিন ধরে কোমায় আছে, যেখান থেকে সে আর কখনো ফিরে আসবে না। গত তিন বছরে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের নিপীড়নের ওপর পাঁচটি স্বাধীন সমীক্ষার ফলে দেখা যায়, তারা সবাই এক ও অভিন্ন উপসংহারে পৌঁছেছে। ওআইসি বা অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্সের নিজস্ব নথিভুক্তকরণ প্রক্রিয়া আছে, কানাডার বিশেষ দূত এই ৪০ বছরের গণহত্যার ওপর প্রতিবেদন দাখিল করবেন। সংবাদ সংস্থা এপি ও রয়টার্স নিজেরা সমীক্ষা চালিয়েছে। এ রকম আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের নাম করা যায়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এরা সবাই যেন এক বিকল্প পরিত্রাণের ভ্রমাত্মক চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত আর সেটা হলো, ‘সত্য জানো আর সত্যই তোমাকে মুক্তি দেবে।’ জাতিসংঘের ১৯৪৮ সালের গণহত্যা-বিষয়ক কনভেনশনের আওতায় তারা পাঁচটি গণহত্যামূলক অপরাধের মধ্যে চারটি করছে। তা সত্ত্বেও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এ ব্যাপারে বাধ্যবাধকতাহীন একটি বিবৃতিও দিতে পারেনি। এর পেছনে হয়তো চীন ও রাশিয়া আছে। এই অনুদার দেশ দুটি ভেটো-ক্ষমতা ব্যবহার করে গণহত্যা বন্ধে মিয়ানমারের ওপর কোনো চাপ দিতে দেয়নি।
কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদের বাকি তিন ভেটো প্রদানের ক্ষমতাধারী ভূরাজনৈতিক ও সম্পর্কিত বাণিজ্যিক স্বার্থের প্রসঙ্গে কখনোই সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে পিছপা হয়নি। ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, ইসরায়েল, সৌদি আরব ও বসনিয়ার প্রসঙ্গ স্মরণ করুন। কিন্তু গণহত্যার শিকার মানুষদের বেলায় নিরাপত্তা পরিষদ যেন মৃত মানুষের মতো। এক বছর আগে আমি কুয়ালালামপুরে এক-আড়াই দিনের ‘কৌশলগত কর্মশালায়’ অংশ নিয়েছিলাম। ওখানে মানবাধিকার-বিষয়ক শীর্ষ নেটওয়ার্ক যেমন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও তাদের দাতা, যেমন ন্যাশনাল এনডাওমেন্ট ফর ডেমোক্রেসিসহ মিয়ানমারের নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের নিয়ে যারা কাজ করে, তারা উপস্থিত ছিল। এর নাম ছিল ‘কৌশলগত কর্মশালা’। কিন্তু পুরো কর্মশালা এমনভাবে পরিচালিত করা হলো, যেখানে আমরা শুধু অ্যাংলো-মার্কিন এনজিও ও তাদের অর্থদাতাদের পরিকল্পনা গ্রহণ করলাম। সাপুড়েদের মতো এই মানবাধিকার-বিষয়ক এনজিওদের আমি সম্প্রতি মারাকেশের মেইন স্কয়ারে কিছুসংখ্যক ‘রোহিঙ্গা সংগঠন’কে ‘আগামী প্রজন্মের নেতা’, ‘শান্তিপ্রিয়’, ‘মানবাধিকার রক্ষক’ হিসেবে প্রচারণা দিতে দেখেছি। এই রোহিঙ্গা সংগঠনগুলো এনজিওদের পূর্বপরিকল্পিত অ্যাজেন্ডার প্রতিধ্বনি যেন করে, সেটাও তারা নিশ্চিত করেছে, তা সে ‘অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা’, ‘সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা’, ‘তদন্ত কমিশন’ বা ‘সত্যানুসন্ধানের মিশন’ বা যা-ই হোক না কেন। আমাদের মতো তৃণমূলের সংগঠক যারা আর এই বিশ্বব্যবস্থার ওপর ভরসা রাখতে পারে না, তাদের কাছে ইতালীয় শ্রমিক সংগঠক ও চিন্তক আন্তোনিও গ্রামসির এই স্মরণীয় উক্তি প্রণিধানযোগ্য: ‘বুদ্ধির নৈরাশ্য আর হৃদয়ের আশাবাদ’। এ কথাটি বলার কারণ হলো, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের ওপর চরম গুরুত্বারোপের কারণে মানুষের কল্যাণের ধারণা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই এ রকম সময়ে হৃদয়ও আর আশাবাদী হতে পারে না যে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর পরিচালিত এই গণহত্যা বন্ধ হবে। এই সময় আমাদের এই ভুল মানবাধিকার আন্দোলনের বিকল্প দেখা যাচ্ছে না। এটা যেন সেই বিখ্যাত উপন্যাস ক্যাচ-২২-এর মতো পরিস্থিতি, যেখানে আমাদের মধ্যকার অধিকতর সক্ষম প্রতিষ্ঠানগুলো এই ফলবিহীন মানবাধিকার গেম খেলতে বাধ্য হচ্ছে। স্বাধীনতার আন্দোলনের ধারণা প্রণয়ন, গড়ে তোলা বা তা বাস্তবায়ন করার বদলে তারা এসব করছে। সময় এসেছে, আমাদের মানবাধিকার আন্দোলনে জুলুম বা গণহত্যার মতো জুলুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অধিকার যুক্ত করতে হবে। বাংলাদেশও গণহত্যার পরিণতিতে জন্মগ্রহণ করেছিল, যার স্মৃতি দেশটির সামগ্রিক স্মৃতিতে এখনো জাগরূক।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
মং জার্নি: বিদেশে বসবাসরত মিয়ানমারের গণহত্যা বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার-কর্মী।

No comments

Powered by Blogger.