এমপি হারুনের নির্বাচনী এলাকায় তোলপাড়

পড়ন্ত বিকালে প্রায় প্রতিদিনই ভিড় জমে রাজাপুরের বাগরী বাজারের ছোট ছোট চায়ের দোকান আর হোটেলে। আশপাশের বিভিন্ন বয়সী মানুষ এখানে আসে বিকালের আড্ডায়। তবে শুক্রবার আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ভিন্ন। ঘুরেফিরে সবাই-ই বলছিলেন তাদের এমপি উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা বিএইচ হারুনের কথা। রাজধানী বনানীতে তার হোটেল রেইনট্রিতে দুই তরুণীকে ধর্ষণকারীদের সঙ্গে এমপি হারুনের ছেলে মাহির হারুনের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে ক’দিন ধরেই আলোচনা চলছিল। কিন্তু শুক্রবার রেইনট্রির মালিকানা আর ৪-৫ বছরে বিএইচ হারুনের বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার খবর প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়েছে তার নির্বাচনী এলাকার মানুষকে। ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর-কাঁঠালিয়ার মানুষ ভাবতেই পারছে না, পাকিস্তান আমলে সুরেলা ওয়াজের জন্য আইয়ুব খানের কাছ থেকে বুলবুলে পাকিস্তান খেতাব পাওয়া মাওলানা আবদুর রবের ছেলে বিএইচ হারুন তার ‘আলহাজ আল্লামা’ নামের আড়ালে এত বড় দুর্নীতি করতে পারে। সেই সঙ্গে ছি ছি আর ধিক্কারও জানাচ্ছিল অনেকে। এদিকে বিশ্বস্ত একটি সূত্রে জানা গেছে, বিএইচ হারুনের দুর্নীতি-অনিয়মের খোঁজে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু করেছে। রাজাপুর বাইপাসের পাশেই বাড়ি সত্তর পেরোনো এক বৃদ্ধের সঙ্গে কথা হয়। নিরাপত্তার কারণে নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে ওই বৃদ্ধ বলেন,
‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে ছিলেন না মাওলানা আবদুর রব। এ কারণে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নানাভাবে হেনস্থাও হন তিনি। তারপরও মাওলানা রবের সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেনি কেউ। অথচ তারই ছেলে বিএইচ হারুন কেবল অবৈধ হোটেল ব্যবসাই নয়, সাধারণ ঠিকাদারের শত কোটি টাকাও মেরে খেয়েছে। এ রকম একজন মানুষ আমাদের এমপি এই লজ্জা আমরা রাখব কোথায়?’ রাজনীতি সচেতন মীরেরহাট এলাকার এক মাঝবয়সী রিকশাচালক বলেন, ‘উনার বাবা ছিলেন মাওলানা। বিয়ে করেছিলেন বরিশালের গৌরনদীর কাশেমাবাদ দরবার শরীফের পীর সাহেবের মেয়েকে। সেই ঘরের সন্তান হয়ে বিএইচ হারুন যা করলেন তা ধর্মে সইবে না।’ বিএইচ হারুনের নির্বাচনী এলাকার দুই উপজেলা রাজাপুর ও কাঁঠালিয়ার প্রায় প্রতিটি বাজার, চায়ের দোকান আর যে কোনো আড্ডায় ঘুরেফিরে একই আলোচনা। এমপি বিএইচ হারুন, তার স্ত্রী ও ৪ ছেলেমেয়ের দুর্নীতি। মীরেরহাট বাজারে কথা হয় সেখানকার এক চা দোকানির সঙ্গে। যুগান্তরকে তিনি বলেন, ‘পুরো পরিবারের ইসলামিক লেবাসধারী। এটা দেখেই হয়তো তাকে ধর্ম মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর সেই ধর্মের জায়গায় থেকে তিনি কি করলেন? স্ত্রীর নামে কেনা জমিতে অবৈধ আর অনৈতিক কর্মকাণ্ডের আখড়া হোটেল রেইনট্রি গড়ে তুলেছেন। আবার এ হোটেলের বৈধতা পেতে চিঠি দিয়েছেন গণপূর্ত মন্ত্রীকে। এখন যখন বিপাকে পড়েছেন তখন বলছেন, ওই হোটেলের মালিক তিনি নন। পেপারে দেখলাম, তিনি নাকি এই ৪-৫ বছরে শত শত কোটি টাকা আর অগাধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। এসব তিনি কীভাবে করলেন? ভাবতে কষ্ট লাগে যে, এ রকম একজন মানুষকে আমরা ভোট দিয়ে এমপি বানিয়েছিলাম।’ এমপি হারুনের গ্রামের বাড়ি কানুদাসকাঠিতে গিয়ে আরও অবাক হতে হয়! বুলবুলে পাকিস্তান খেতাব পাওয়া বাবা মাওলানা আবদুর রবের জমিতে বিশাল ইসলামী কমপ্লেক্স গড়েছেন বিএইচ হারুন। মসজিদ, মাদ্রাসা,
লিল্লাহ বোর্ডিং থেকে শুরু করে ইসলামী প্রায় সব ক’টি প্রতিষ্ঠানই ওই কমপ্লেক্সে আছে। এমপি হারুনের বাড়ির আশপাশের লোকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, এলাকায় যখন আসেন তখন পুরোপুরি ইসলামী লেবাসেই আসেন এমপি। নিজেকে প্রচার করেন আলহাজ আল্লামা বলে। তার পরিবারের অন্য সদস্যরাও এর ব্যতিক্রম নয়। অথচ এখন একে একে বেরিয়ে আসছে এই পরিবারের ভেতরের খবর। এমপির ছেলে ধর্ষকের সহায়ক। এই পরিবারের সদস্যরা শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক। বিএইচ হারুনের ব্যাংকে (প্রিমিয়ার ব্যাংক) টাকা রাখতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়া পাশের উপজেলা ভাণ্ডারিয়ার বাসিন্দা খলিলুর রহমান বলেন, ‘এমপি হারুনের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে তার মালিকানাধীন ব্যাংকে টাকা রেখে আমি সর্বস্বান্ত হয়েছি। সে ভুয়া চেক আর ভুয়া স্বাক্ষর দিয়ে আমার প্রায় দেড়শ’ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ দিয়েও আমি কোনো প্রতিকার পাচ্ছি না। একদিকে প্রভাব খাটিয়ে সে এসব অভিযোগের তদন্ত আটকে রেখেছে আর অন্যদিকে আমাকে দিচ্ছে প্রাণনাশের হুমকি। চেক প্রতারণার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলাও করেছি। বৃহস্পতিবার ওই মামলার অভিযোগ গঠনের তারিখ ছিল। এমপি হারুনের আইনজীবীর আবেদনের পর সেই তারিখ পেছানো হয়েছে।’ রাজাপুরের মতো কাঁঠালিয়া উপজেলাবাসীও এখন ধিক্কার জানাচ্ছে বিএইচ হারুনকে। কাঁঠালিয়া বাসস্ট্যান্ডের একাধিক দোকানি আর সাধারণ মানুষ জানান, আওয়ামী লীগে উড়ে এসে জুড়ে বসা হারুন এখন দলের জন্য বিষফোঁড়া। ক্ষোভের সুরে তারা বলেন, ‘যে মানুষটা ১৯৯১ সালে বিএনপির মনোনয়নে নির্বাচন করল, পরে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন চাইতে গিয়ে ব্যর্থ হল, তাকে কেন মনোনয়ন দিল আওয়ামী লীগ? বাছবিচার না করে তার মতো হাইব্রিডদের দলে এনে এমপি বানানোর কারণেই আজ এ রকম একটি সম্মান হারানোর মতো অবস্থায় পড়েছে আওয়ামী লীগ। কে না জানে যে বিএইচ হারুনের পরিবার স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধী পক্ষ। তারপরও কেন তাকে এত বড় সুযোগ দিল মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের দলটি।’ রাজাপুর-কাঁঠালিয়ার সাধারণ মানুষের পাশাপাশি তার দলের নেতারাও এখন সোচ্চার এমপি হারুনের দুর্নীতি আর অপকর্মের বিরুদ্ধে।
কাঁঠালিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তরুণ সিকদার বলেন, ‘নির্বাচনী এলাকার সবাই জানে যে এমপি হারুনের পরিবার একটি ধর্ম ব্যবসায়ী পরিবার। তারপরও তাকে সুযোগ দিয়ে আজ আমাদের মুখ দেখানোর পথ অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে। মানুষের নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি না আমরা। সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হচ্ছে, উনি এমপি হওয়ার পর চরমভাবে অবহেলিত আর বঞ্চিত অবস্থায় রয়েছে দলের ত্যাগী পরীক্ষিতরা। উনি উনার পছন্দের লোকজন নিয়ে চলাফেরা করেন। যারা আওয়ামী লীগের মুলধারার কেউ নন। উনি এমপি হওয়ার পর কাঁঠালিয়ায় মাদক ব্যবসায়ীদের অবাধ রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মাদক ব্যবসায় জড়িতদের প্রায় সবাই এমপির লোক। আর এখন তো বেরিয়ে পড়ছে তার অবৈধ সম্পদের বর্ণনা। আমরা চাই দুদক তার সম্পদের হিসাব নিক। অবৈধ সম্পদের তালিকা জনসমক্ষে প্রকাশের পাশাপাশি তার কঠোর বিচার হোক।’ রাজাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জিয়া হায়দার খান লিটন বলেন, ‘স্বাধীনতাবিরোধী ধর্ম ব্যবসায়ীদের চরিত্র যে কখনই পরিবর্তন হয় না তার জ্বলন্ত উদাহরণ বিএইচ হারুন। ধর্মীয় খোলসের আড়ালে উনি ঠিকই উনার অপকর্ম করে গেছেন। তার ফসল আজ এই অগাধ সম্পদ আর শত শত কোটি টাকার মালিকানা। তার কারণে আমরা এখন মুখ দেখাতে পারি না। দলের এত বড় ক্ষতি করা এই এমপির বিচার চাই আমরা।’ রাজাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা ও ঝালকাঠি জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মেসবাহ উদ্দিন মাসুদ সিকদার বলেন, ‘বিএনপির মনোনয়নে নির্বাচন করে উনি হেরেছেন।
আওয়ামী লীগের মনোনয়নেও ভোট করে হেরেছেন একবার। তাছাড়া জাতীয় পার্টির মনোনয়ন চেয়ে হয়েছেন ব্যর্থ। উনি জিতলেন ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী রাজনৈতিক জটিলতায়, যখন শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির শাহজাহান ওমর এলাকাছাড়া। আর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তো জিতেছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। উনার রাজনৈতিক চরিত্র বলে কিছু নেই। যে কারণে সর্বশেষ নির্বাচনের আগে তৃণমূলের জনসমর্থন প্রশ্নে তিনি ভোটে সবার পেছনে পড়েন। তারপরও তাকে মনোনয়ন দেয় দল। বাধ্য হয়ে আমরা নৌকার নির্বাচন করি। কিন্তু আজ যা পরিস্থিতি তাতে নির্বাচন সামনে রেখে কেবল আমাদেরই নয়, দলকেও একটা বড় ধরনের ধাক্কা দিলেন হারুন। এই পরিস্থিতি থেকে আমরা কিভাবে উঠে আসব সেটাই ভাবনা। এমনিতেই তিনি জনবিচ্ছিন্ন। এলাকার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বলতে কিছু নেই। দুই হাজার টাকা লঞ্চ-বাস ভাড়া দিয়ে ঢাকায় গিয়েও তার দেখা পায় না এলাকার মানুষ। আর এখন তো তাকে নির্বাচনী এলাকার সবাই বলতে গেলে প্রত্যাখ্যানই করেছে। দেখছেন না উনি এত বড় বিপদে পড়েছেন অথচ তার পক্ষে এলাকায় একটা মিছিল পর্যন্ত হচ্ছে না। কেউ নেই তার সঙ্গে। আমরা এ রকম একজন ঘৃণ্য মানুষের কঠোর বিচার চাই।’ এসব বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য এমপি বিএইচ হারুনের মোবাইলে একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। বেশ কয়েকটি ক্ষুদে বার্তা দেয়ার পরও তার কোনো জবাব দেননি তিনি।

No comments

Powered by Blogger.