খোয়াব by মোজাফ্ফর হোসেন

একদিন ভোরে একটা দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেলে ছুটে গেলাম বাবার কাছে। মায়ের চেয়ে বাবার সঙ্গে আমার সখ্য বরাবরই বেশি। কাজেই আমার কোথাও কিছু ঘটলে বাবার কানেই পৌঁছায় সবার আগে। সেদিনের ওই স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্নটার কথা বাবাকে না বললেই নয়। স্বপ্নের হয়েছে এই এক জ্বালা—চোখ জোড়া মেলতে না মেলতেই অর্ধেকটা গায়েব; মনে হয়, যেন ঘটেও ঘটেনি। বাবা তখন কেবলই খবরের কাগজে মনটা চুবিয়েছেন। এত ভোরে কাগজ আসে না। আসলেও বাবা তোয়াক্কা করেন না, তাঁর অভ্যাস খবর বাসি করে তারপর পড়তে বসা। আমার দাদাবাড়ি ছিল গ্রামে, সে সময় গ্রামে খবরের কাগজ পৌঁছাত এক দিন পর। ফলে এখন শহরে বাস করলেও এখনো এভাবেই পেপার পড়ে অভ্যস্ত আমার বাবা। আমি যে তাঁর শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়েছি, সেটা তিনি দেখেও না দেখার ভান করলেন। এত সকালে যে নিজ থেকে উঠি না, সেটা ভালো করেই জানেন তিনি। কাজেই ভেবেছেন, আমি দৃষ্টিভ্রম, এমনিতেই চলে যাব।
‘বাবা, একটু শুনবে? শুনতে তোমাকে হবেই।’ এমন স্বরে কথাটি তাঁকে বললাম যেন যে মানুষটি আমার সামনে বসে আছেন তিনি আমার বাবা নন, আমিই তাঁর বাবা।
‘না শুনে যখন উপায় নেই, তখন বলে যা।’ আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন বাবা।
‘আমি খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখেছি।’
‘হুম।’ কাগজের ভেতর থেকে বাবা বললেন। বুঝলাম, আমার স্বপ্নের বৃত্তান্ত শোনার অত তাড়া নেই তাঁর। কথা আর না বাড়িয়ে চলে আসতে পারলেই ভালো লাগত, কিন্তু সেই ভালো লাগা বেশিক্ষণ টেকসই হবে না ভেবে আগ বাড়িয়ে বলতে হলো আমাকেই।
‘শোনো, স্বপ্নে দেখলাম দাদি উঠোনের মাঝখানে কুয়ো খুঁড়ছে। আমরা সবাই কত বারণ করছি, কিন্তু কে শোনে কার কথা! তুমি তো রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়েই গেলে। মাও খুব রাগ করল। তবে দাদির কাণ্ড দেখে আমিই খুব মজা পাচ্ছিলাম। তারপর দেখি কি—বালতিতে করে কুয়ো থেকে আমি পানি তুলছি দাদি গোসল করবেন বলে। বালতিটা সে কী ভারী! উঠতেই চায় না, আমারও জেদ চপে গেল। তুলে দেখি, বালতির ভেতরে জড়সড় হয়ে বসা দাদি। মৃত। আমি চেঁচিয়ে উঠেছি আর অমনি ঘুম ভেঙে গেল।’
‘হুম। যা, আর ঘুমানোর দরকার নেই। হাত-মুখ ধুয়ে পড়তে বস গে। তোর মাকে বল আমাকে এক কাপ চা দিতে।’ খবরের কাগজের ভেতর শেয়ারের পাতায় চোখ বোলাতে বোলাতে বললেন বাবা। শেয়ার বাজারে বাবার কোনো লেনদেন নেই। তাঁর ঢাকায় এক বন্ধু আছে—আজিজ অাঙ্কেল। শেয়ারের কারবার করে রাতারাতি বড়লোক হয়ে গেছেন তিনি। রীতিমতো আঙুল ফুলে কলাগাছ! একবার আমাদের এখানে বেড়াতে এসেছিলেন, বাবাকে হাতে-কলমে বুঝিয়েছেন শেয়ার ব্যবসা, তারপর থেকেই এই পাতাটা বাবা বেশ গুরুত্ব দিয়ে দেখেন। একবার কিছু টাকা গুছিয়েও ছিলেন, কিন্তু তা দিয়ে আমার ছোট ভাইয়ের আকিকার জন্য মা এক জোড়া ছাগল কিনে ফেলেছেন। কত দিন থেকে আকিকা আকিকা শুনছি, এবার ফাইনালি হচ্ছে।
‘এটা খুব বাজে স্বপ্ন না, বলো? দাদি মায়ের সঙ্গে রান্নাঘরে, তাকে কি একটু সাবধানে থাকতে বলবা? তুমি বললে শুনবে।’
‘স্বপ্ন কোনো দিন সত্যি হয় না। শোন, তোর দাদিকে কিছু বলার দরকার নেই। কুয়ো খোঁড়ার আইডিয়াটা তাঁর মনে ধরে যেতে পারে।’
স্বপ্ন যে সত্যি হয় না, সে তো আমিও জানি। হলে কবেই আমি কলেজ পাস করে এত দিনে চাকরিতে লেগে যেতাম! ডাক্তার হতাম, ইঞ্জিনিয়ারও হতাম। কারণ, বাবার স্বপ্ন আমি ইঞ্জিনিয়ার হই, মায়ের ডাক্তার। তাঁদের এই চাওয়ার পেছনে অবশ্য সামান্য হেতু আছে। বাবার বাবা চেয়েছিলেন তাঁর বড় ছেলে, মানে আমার বাবা, বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হবে, সেই আমলে দাদার মাথায় ইঞ্জিনিয়ারের আইডিয়াটা কীভাবে এল, সেটি অবশ্য ভাবার বিষয়।
বাবা শেষপর্যন্ত হলেন মানুষ গড়ার ইঞ্জিনিয়ার—স্কুলমাস্টার। আর মায়ের কেসটা ভীষণ মর্মস্পর্শী। ভুল চিকিৎসার কারণে কঠিন একটা রোগ হয়েছিল আমার নানির। কী রোগ, আমি তা ঠিকমতো না জানলেও মায়ের মুখে সব সময় ‘আকড়’ ‘আকড়’ শুনে এসেছি, ব্যাকরণ ঘেঁটে পরে জেনেছি তার অর্থ—‘কঠিন’। নানি মারা যাওয়ার আগে সব সময় নাকি বলতেন, ‘ভালো ডাক্তার পেলে আমি মরতাম না’, যদিও তখনো তিনি মরেননি। মা পণ করেছিলেন সেই সময়ই, ছেলে হলে ডাক্তার আর মেয়ে হলে তাঁর জন্য আনবেন ডাক্তার জামাই।
বাবার সঙ্গে আর কথা না বাড়িয়ে চলে এলাম আমি। স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি এমন সময় বাবা এবং দাদির বেধে গেল তুমুল আকারে। সামনেই দাদার মৃত্যুবার্ষিকী। দাদি চান মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি গ্রামের বাড়িতে হোক, তবে বাবার ইচ্ছে উল্টোটা। তাঁদের ছোট মানুষের মতো ঝগড়া করতে দেখে বেশ মজাই পাচ্ছিলাম। হাসতে হাসতে চলে গেলাম স্কুলে। ততক্ষণে সকালের স্বপ্নের কথা মন থেকে ক্লিন বোল্ড, মনে করতে চাইলেও ঠিক ঠিক আর মনে করতে পারব না।
টিফিন শেষ করে সবে ক্লাসে ঢুকেছি, খবরটা গেল এমন সময়—শহরে আমাদের সঙ্গে যে বাড়িতে থাকেন দাদি, সেখানে বাথরুমে পড়ে বড় রকম আঘাত পেয়েছেন তিনি। হেড স্যারকে বলে বাড়ি চলে এলাম আমি। এসে দেখি, কান্নাকাটির তুমুল হিড়িক পড়ে গেছে। দাদি নেই। এরপর আর বহুদিন স্বপ্ন দেখিনি। দেখলেও ঘুমের ঘোর কাটতে না-কাটতেই কেটে গেছে তার রেশ।
তো, সেদিন একটু দেরিতেই ঘুমিয়েছিলাম। ঘুম ভাঙলও দেরিতে। শুক্রবার, স্কুল ছুটি, কাজেই আমাকে কেউ ডাকার প্রয়োজন বোধ করেনি। হয়তো ঘুমাতাম আরও কিছুক্ষণ যদি ওই আজব স্বপ্নটা না দেখতাম।
যথারীতি ছুটে এলাম বাবার কাছে। বাবাও যথারীতি অন্যান্য দিনের মতো বাসি খবর গিলছিলেন গোগ্রাসে ।
‘বাবা?’ একবার ডেকে কোনো সাড়া পেলাম না। ‘বাবা?’ আবার ডাকলাম। ‘শুনছি তো! বল।’  খুব আজব একটা স্বপ্ন দেখলাম।’ বাবা জানেন আমি না বলে যাব না, তাই বললেন, ‘বলে যা। শুনছি।’ ‘দেখলাম, বিকেলে আমি আর তুমি বাজার করতে বেরিয়েছি। চারদিক কেমন ঘোলা ঘোলা। বাড়িঘরগুলো খুব ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। গাছপালা সব কেমন বিবর্ণ মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব রং কে বা কারা যেন ধুয়ে দিয়েছে। একবার দেখি, রিকশা চালাচ্ছে একটা কঙ্কাল, আবার দেখি একটা রোবট। তুমি কোনো কথা বলছ না। আমি তোমাকে চিৎকার দিয়ে ডাকছি, তুমি গা-ই করছ না! একবার দেখি, কেমন শকুন হয়ে গেছে সব মানুষ। আবার দেখি, চারদিকে কুকুর আর কুকুর, মানুষ কোথায়! কুকুরগুলো কেমন জিব বের করে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে—যেন অনেক দিন কিছু খায়নি, এখনই আমাদের গিলে খাবে। তুমি যে কী করে কিছু হয়নি এমন একটা ভাব নিয়ে বসে ছিলে, কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না আমি। তোমার নীরবতা ভয়ংকর একটা শব্দের মতো আমাকে আঘাত করে চলেছিল বিরতিহীন। ভীষণ ভয় পেয়ে আমি যেই ধরেছি তোমার হাত, অমনি আস্তে আস্তে গলে যেতে লাগল তোমার শরীর। আর সেই সময়ই তো ঘুমটা ভেঙে গেল আমার।’
বাবা কোনো কথা বললেন না।
‘কিছু বলছ না যে!’
‘কাল খেলায় পাকিস্তান কেমন হারল দেখলি। তুই বললি বাংলাদেশ পারবে না। দেখলি তো?’
‘বাবা, আমি তোমাকে একটা স্বপ্নের কথা বলছিলাম! আর বাংলাদেশ পারবে না, সে কথা তো আমি বলিনি; বলেছি, খেলাটা খুব জমবে।’
‘হুম।’
‘আমার স্বপ্নটা?’
‘স্বপ্ন কোনো দিন সত্যি হয় না। যাহ্। এখন থেকে চিত হয়ে শুবি না। দেখবি, স্বপ্ন দেখা কমে গেছে। আর দাঁত মেজে শুবি, তাহলে এমন পাগলাটে স্বপ্ন দেখবি না।’ হতাশ হয়ে চলে এলাম আমি। স্বপ্নের কথা যাতে বেমালুম ভুলে না যায়, এ জন্য ডায়েরিতে লিখে রাখলাম দু-তিন লাইনে। আমি আসলে দেখতে চাচ্ছিলাম দিনটাতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আসে কি না।
দিনের বেলাটা রোজকার মতোই গেল। পড়ন্ত দুপুরে ঘুরতে বের হলাম হাফিজুল চাচার সাঙ্গে। পুরো নাম হাফিজুল হলেও লোকটিকে আমি ডাকি হাফি চাচা বলে। হাফি চাচা আমাদের বাড়ির মালিক। দোতলায় থাকেন। একাই থাকেন। একটা মেয়ে এসে রান্না করে দিয়ে যায় তাঁকে। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর আর বিয়ে করেননি। কোনো ছেলেমেয়ে নেই। লোকে বলে, হাফি চাচার নাকি শারীরিক সমস্যা ছিল তাই বাচ্চাকাচ্চা হয়নি। মায়ের মুখেও শুনেছি একই কথা। লোকটা যে ভালো, এ নিয়ে এলাকায় কেউ দ্বিমত করবে না। বাবা ঘুরতে বেরোন কম, তাই হাফি চাচা মাঝেমধ্যে বেড়াতে নিয়ে যান আমাকে। বাইরে থেকে তাঁকে গম্ভীর মনে হলেও তিনি কিন্তু বেশ রসিক মানুষ, আমাদের ঘোরাঘুরিটা এ জন্য বেশ জমে। সেদিন আমরা বাড়ির কাছেই এক পার্কে গিয়ে বসলাম। হাফি চাচা মন দিয়ে তাঁর ছেলেবেলার গল্প করছিলেন, মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম আমিও। এরই এক ফাঁকে আমাদের স্যান্ডেল জোড়া উধাও। হাফি চাচা হাসতে হাসতে বললেন, ‘অতি মনোযোগী হলে হিতে বিপরীতও হতে পারে।’ দূরত্ব পায়ে হাঁটার হলেও স্যান্ডেল না থাকায় রিকশাই চেপে বাড়ি ফিরলাম আমরা। ভাড়া নিয়ে রিকশাচালকের সঙ্গে চাচার বাধল মহা ক্যাচাল। হাফি চাচা দশ টাকার এক টাকাও বেশি দেবেন না। আর রিকশাচালক গোঁ ধরে আছে, বিশ টাকা নিয়েই ছাড়বে। তার মেয়ের নাকি বিয়ে, জামাই বিশ হাজার টাকা নেবে, তাই সে কিছু টাকা ধরে চাচ্ছে। ‘এত্তগুলান ট্যায়া জোগাড় করতি হবি। তাই স্যার এ কয় মাস রেকশা থেকি নামিনি।’ রিকশাচালক অতি বিনয়ের সঙ্গে বলে। আমার আবার সবকিছুতে আগ্রহ বেশি, হাফি চাচা না রিকশাচালক—শেষ পর্যন্ত কে জেতে না দেখে সরছি না।  ‘তুই যেটা দিবি, সেটা যৌতুক, বুঝলি? এটা অন্যায় কাজ, আর আমি জেনেশুনে দিল দরিয়া সেজে তোর সেই অন্যায়ে সায় দিতে পারব না। অন্য কারণ নিয়ে আসিস।’ রিকশার ছিটের ওপর দশ টাকার নোটখানা রেখে হাঁটা ধরলেন চাচা। আমিও হাঁটা দিলাম পিছু পিছু। আমি আর বাবা বসেছিলাম সন্ধ্যায়। বাবা চা খাচ্ছিলেন আর আমি মুড়ি চিবোচ্ছিলাম। ‘এই শুনেছ?’ এমন সময় মায়ের প্রাত্যহিক হাঁক। শুনেছি তো অনেক কিছু, আবার অনেক কিছুই শুনিনি! তুমি কোনটার কথা বলছ?’ বাবার চিরচেনা উত্তর। ‘তিন মাস আগে পাগলি মেয়ের বিয়ে দিল না—ছয়মন নাম, আমি তখনই বলেছিলাম, পাগলি মেয়ের বিয়ে দিচ্ছে, দেখো কোনো কাহিনি আছে। জানা গেল, ছয়মন গেছে হাসপাতালে, পেট ফেলতে! ফলল তো আমার কথা?’
‘ও, এটা আমি জানতাম না। দুপুরে যে মফা মাস্টারের মেয়েকে বখাটেরা অ্যাসিড মেরেছে, সেটা শুনলাম। বাদ দাও এসব। আজ রাতে তোমার স্পেশাল খিচুড়ি আর ভুনা গরুর মাংস করো না, আয়েশ করে খাই।’ বাবা খুব সুন্দর করে একটা কথার মধ্য আরেকটা কথা ঢুকিয়ে দেন। মূল প্রসঙ্গটা খুব সহজেই ছিটকে যায়। এটা তিনি ইচ্ছে করে করেন, না স্বভাবদোষে—ধরা যায় না। রাতে আমরা বেশ আয়েশ করে ভুনা মাংস আর খিচুড়ি খেলাম। দিনটা আর পাঁচটা দিনের মতো করে চলে গেল খুব সাধারণভাবেই। গত রাতের স্বপ্নের সঙ্গে কোনোভাবেই মিলল না। স্বপ্ন যে সত্যি হয় না, সে তো আগে থেকেই জানতাম।
বছর খানেক পরের কথা। সেদিন কী জন্য যেন স্কুল বন্ধ ছিল। দুপুরে খেয়েদেয়ে কেবল ঘুমিয়েছি আমি, চোখের পাতা বুজে আসতেই দেখলাম, আমি কালো অন্ধকার সুড়ঙ্গের ভেতর তলিয়ে যাচ্ছি, এমন সময় একটা অচেনা কণ্ঠস্বর। সে বলল, ফিরে আয়। তোর বাবা চাপা পড়ে মারা গেছে। তারপর গুহার ভেতরে ঘুরে-ফিরে কে যেন বলতেই থাকল—চাপা পড়ে মারা গেছে! ধড়ফড় করে উঠে পড়লাম আমি। বাবা ব্যস্ত ছিলেন স্কুলের খাতা দেখায়। কাছে যেতেই বললেন, ‘বিরক্ত করিস না। মাথার ওপর অনেক চাপ।’
‘এই তো, এই কথায় তো বলতে এসেছি। খুব বাজে স্বপ্ন বাবা। তোমাকে বলা ঠিক হবে কি না...কিন্তু না বলে থাকতেও পারব না যে!’
‘অত ঢং না করে বলে ফেল। হাতে অনেক কাজ। বহুবার বলেছি, স্বপ্ন কখনো সত্যি হয় না। তা-ও বল শুনি, না শুনিয়ে ছাড়বি না যখন।’ বাবা আমাকে একবার দেখে নিয়ে বললেন। অমনি তাঁকে আমি জানালাম স্বপ্নের কথা। শোনামাত্রই মুখটা শুকিয়ে খটখটে এঁটেল মাটির মতো হয়ে গেল বাবার। হাতের কলম আর নড়ছে না।
‘বেশ। ভাগ এখন।’ তিনি যে স্বপ্নটিকে আমলে নেননি সেটা বোঝানোর চেষ্টা করলেন অস্থিরভাবে হাঁটাহাঁটি করে।
‘বাবা, স্বপ্ন কখনোই সত্যি হয় না। তোমার কোনো স্বপ্ন আজ অবধি সত্যি হয়েছে, ফলেছে, বলো?’ বাবা আমাকে বারবার বলছিলেন এ কথা। ওদিকে তাঁকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলাম আমিও। এবার হাতের কাজ বন্ধ করে ওপরের দিকে একবার তাকালেন তিনি। আমাদের বাসাটা ছিল অনেক দিনের পুরোনো, হাফি চাচার দাদার হাতে তোলা। এক দিক চুন-সুরকি গাঁথুনি, অন্য দিকটা মাটির। ছাদে স্থানে স্থানে ফাটল ধরেছে। শুনেছি মাকে নিয়ে বাবা এ বাড়িতে এসেছেন বিয়ের পরপর। এখানেই আমার ও আমার ছোট ভাইয়ের জন্ম। জন্মানোর পর থেকে দেখছি বাড়িটা টালমাটাল-কার্নিশের উত্তর কোনার কয়েকটি ইট খসে গেছে। প্রতিটা ঘরেরই কিছু অংশ লোনা ধরা। বাবা কী যেন ভেবে কিছুক্ষণের মধ্যে বের হয়ে গেলেন বাড়ি থেকে। যাওয়ার আগে বললেন, ‘মাকে বলিস, ফিরতে রাত হবে’। সমস্ত বিকেল মাথায় এই পড়ে সেই পড়ে ভেবে ভেবে, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ক্লান্ত হয়ে মধ্য রাতে ফিরলেন বাসায়।
শেষ রাতের দিকে ঘটল দুর্ঘটনাটা। একটা চক্কর, এরপর সহসা পিলে চমকানো শব্দ। ভূমিকম্প ভূমিকম্প বলে চিৎকার দিয়ে আমরা সবাই বের হয়ে এলাম বাইরে। সবার আগে আগে এলেন বাবা। হাঁপাতে হাঁপাতে বসে পড়লেন বুক ধরে।
ওই রাতেই ছাদ চাপা পড়ে মারা পড়লেন হাফিজুল—আমার হাফি চাচা।

No comments

Powered by Blogger.