রাজনৈতিকজট! by ড. মাহফুজ পারভেজ

বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে যানজট, মামলাজট, সেশনজট ছিল বা আছে। এখন মনে হচ্ছে রাজনীতিজট শুরু হয়েছে। মাসাধিক কাল ধরে রাজনৈতিক অচলাবস্থা চলতে চলতে ‘জট’ পাকিয়ে গেছে। বিরোধী দল আন্দোলনজট থেকে বের হতে পারছে না। সরকারও সুরাহার পথে জট এড়িয়ে পৌঁছাতে পারছে না। ফলে ভটঘট অবস্থা বিরাজ করছে। রাজনীতি প্রক্রিয়া সময়, পরিস্থিতি ও চ্যালেঞ্জ অনুযায়ী তৎপর আছে বলা যাবে না। পরস্পরবিরোধী যুদ্ধংদেহী অবস্থান তৎপরতার লক্ষণ নয়। সরকার সংলাপ করবে না; দমন করবে। বিরোধীরা আন্দোলন থামাবে না; চালিয়েই যাবে। এমন কঠোর অবস্থান সমঝোতার বড় অন্তরায়। উভয় পক্ষই নিজ নিজ অবস্থান ও কর্মসূচির আবর্তেই জটবদ্ধ থাকায় অচলায়তনের অন্ধকারই প্রলম্বিত হচ্ছে। হতাশা বাড়ছে। অনিশ্চয়তার কালোমেঘ কাটছে না।
সমাজ ও রাজনীতি একটি আরেকটির সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। একটি সমস্যা আরেকটি সমস্যাকে বাড়িয়ে দিতে পারে। যানজট বা সেশনজট বা মামলাজট যেমনভাবে সমাজের নানা স্তরে ক্ষতির দাগ রেখে যায়; রাজনৈতিকজটও তেমনিভাবে অন্যান্য নানা ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করছে। যেমন, বার বার পরীক্ষা পেছানোর ফলে শিক্ষাজট ও সেশনজট দীর্ঘায়িত হচ্ছে। অফিস-আদালতের কাজে কুপ্রভাব পড়ছে। মামলাজট বা প্রশাসনিক কাজের ক্ষেত্রে জট লাগা তাই অস্বাভাবিক নয়। এরই মাঝে শিক্ষা, শিল্প, অর্থ, বাণিজ্য, ব্যবসায় কি কি ক্ষতি হয়েছে বা হচ্ছে, সেটা মিডিয়ার সরজমিন তদন্তে বের হয়ে এসেছে। মানুষের মৃত্যু, জান-মালের ক্ষতি, আগুনের বীভৎসতা, আতঙ্ক ইত্যাদির পরিমাণও কম নয়। এসবের পরিণামে সমাজ ও মানুষের মধ্যে স্থবিরতা ও ভীতি নেমে এসেছে। বিভিন্ন রুটিন কাজ বন্ধ রয়েছে। সেখানেও লাগছে জট।
রাজনীতি সম্পর্কে বলা হয় যে, এটি একটি গতিশীল বিজ্ঞান। রাজনীতি সরকার ও বিরোধী, জনগণ ও প্রশাসনসহ সবাইকে একটি জাতীয় লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ ও গতিশীল করে। দেশ ও সমাজকে এগিয়ে যেতে নেতৃত্ব দেয়।
সেই রাজনীতি যদি পারস্পরিক   দ্বন্দ্ব-সংঘাতে আকীর্ণ হয়, রক্তাক্ত সহিংসতায় ভেসে যায়, কর্মসূচির বদলে শক্তি প্রদর্শনের ক্ষেত্র হয়, তাহলে অচলাবস্থা হবেই। সে অচলাবস্থার হাত ধরে নানা ধরনের সঙ্কট আর জট-জটিলতাও এসে হানা দেবে। যা মোটেও কল্যাণকর নয়।
বাংলাদেশে বর্তমানে যে রাজনৈতিক সঙ্কট বিগত ৪৫ দিন ধরে চলছে এবং থামার কোন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না, তার অবসান কিভাবে হবে? এ প্রশ্ন এখন সর্বত্র প্রবলভাবে আলোচিত হচ্ছে। সরকার বলছে আন্দোলনকে ‘আত্মসমর্পণ’ করানো হবে। বিরোধীরা যে কোন মূল্যে তাদের আন্দোলন-কর্মসূচি অব্যাহত রাখার পক্ষে সরব রয়েছে। এরই মাঝে বন্দুকযুদ্ধ, হামলা ইত্যাদিতে প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে। গ্রেপ্তার হচ্ছে শত শত। সাধারণ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। অচলাবস্থা এবং জটাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। এর ফলে প্রকৃত লাভবান হচ্ছে কে? কে হারছে? কে জিতছে? এসব প্রশ্নের কোনই উপসংহার মেলানো যাচ্ছে না। সবাই নিজের বিজয়ের বা লাভের স্বপ্ন দেখছে বটে; কিন্তু আসলে কে কি পাচ্ছে? দায়িত্বশীলতার নিরিখে চিন্তা-ভাবনা করলে বা হিসাব মেলালে কি পাওয়া যাবে, কে জানে! অথচ দায়িত্বশীল রাজনীতি গণতান্ত্রিক সমাজের অলঙ্কার। মানুষ দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদদের ভোট দিয়ে, ভরসা করে, আস্থা রেখে নিজেদের নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ রাখে। বাংলাদেশে তেমন জনশান্তি ও জননিরাপত্তা সুদূরপরাহত। বরং সর্বত্র অনিশ্চয়তা। থমকে আছে সব কিছু। জট লেগে গেছে সব কিছুতে। অতএব বিদ্যমান জট ছাড়ানোই এখন বড় কর্তব্য। কারণ অচলাবস্থা, জট, সমস্যা, সঙ্কট হতে পারে এবং সাময়িক সময়ের জন্য সেটা মেনে নেয়াও হয়। কিন্তু সমস্যা, সঙ্কট, জট, অচলাবস্থাই যদি স্থায়ী বা স্বাভাবিক অবস্থায় পরিণত হয়, তাহলে সমাজ ও মানুষের জীবনের স্বাভাবিকত্ব থাকে না। প্রকৃতির নিয়মেই মানুষ জটমুক্ত হতে চায়। জট বাড়াতে চায় না। যে কোন রকমের জটই হোক, সেটা ছাড়ানোর পক্ষেই মানুষের অভিমত। যানজট, সেশনজট, মামলাজট ছাড়ানোর জন্য মানুষ সব সময়ই সোচ্চার। এখন যদি অচলাবস্থাকে ভর করে রাজনৈতিকজট লেগে যায় এবং তা থেকে নানা রকমের জটের প্রাদুর্ভাব ঘটে, তাহলে সেটা হবে বিপদের উপর বিপদ। সবাইকে এখন মানুষের বিপদ কমানোর দিকে মনোযোগী হতে হবে। মানুষ অধৈর্য হলে যারা বিপদ সৃষ্টি করছে, তাদের ওপর মহাবিপদ নেমে আসবে। অতএব, জটমুক্তকরণেই মুক্তি।

No comments

Powered by Blogger.