হারবে বাংলাদেশ! by আসিফ নজরুল

পৃথিবীর সব খেলার নিয়ম থাকে। খেলা আনন্দময়, তবু তা শেষ করতে হয় নির্দিষ্ট সময়ে। সে তুলনায় রাজনৈতিক আন্দোলন কখনো কখনো খুব নিষ্ঠুর। তবে এটিও একটি খেলার মতো, এখানেও দুই পক্ষ থাকে, থাকে জয়-পরাজয় এবং খেলার কিছু নিয়ম। থাকে এমনকি অনুমিত বা প্রত্যাশিত সময়কালও।
রাজনৈতিক আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হলে তার কুফল হয়ে ওঠে মারাত্মক, বিশেষ করে তা যদি হয় অপুষ্ট গণতন্ত্রের দেশে এবং দুই পক্ষই যদি হয় নৈরাজ্যকর চরিত্রের। এমন আন্দোলনে মানুষের জীবন আর জীবিকার ওপর আঘাত আসে, রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত সম্পদ ধ্বংস হয়, স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়, দেশের অগ্রগতি আর সম্ভাবনা দারুণভাবে হোঁচট খায়। জোর করে ক্ষমতায় থাকার জন্য মরিয়া সরকার আর জোর করে তাকে নামানোর জন্য মরিয়া বিরোধী দলের লড়াইয়ে নাভিশ্বাস ওঠে সাধারণ মানুষ আর রাষ্ট্রযন্ত্রের।
এই লড়াই তাই যত স্বল্পস্থায়ী হয় ততই ভালো। না হলে একটি রাষ্ট্র কীভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে, তার উদাহরণ একালেই আমরা আরবের বিভিন্ন দেশে দেখছি। বাংলাদেশে কখনোই এমন সর্বনাশা লড়াই হয়নি। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫-এর মাঝামাঝি সময় আওয়ামী লীগ বনাম জাসদের প্রাণঘাতী প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময় বাদে এ দেশে সরকার আর বিরোধী দলের দ্বৈরথ ছিল স্বল্পস্থায়ী। তাতে জীবন-জীবিকা আর সম্পদহানি ঘটেছে অনেকাংশে সহনীয় মাত্রায়।
এবার সরকার আর বিরোধী দলের হানাহানিতে এমন কোনো লক্ষণ নেই। বিরোধী দলের অবরোধ চলছে মাস দেড়েক ধরে। এর মধ্যে হরতাল হচ্ছে নিয়মিত, পেট্রলবোমা, ককটেল আর রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গুলিতে প্রাণ যাচ্ছে মানুষের, নানাভাবে হয়রানি হচ্ছে আরও বহু মানুষ, ধ্বংসলীলা চলছে সারা দেশে। তার পরও দুই পক্ষের লড়াই চলছে অবিরাম। এই যুদ্ধ হয়তো সমঝোতাহীনভাবে শেষ হবে একদিন। হয়তো সরকারের পতন হবে বা বিরোধী দলের শক্তি নিঃশেষিত হবে। এই নিষ্ঠুর খেলায় হয়তো সাময়িকভাবে জিতবে কোনো একটি পক্ষ। কিন্তু তাতে পরাজিত হবে বাংলাদেশ।
দুই
সরকারের পক্ষ থেকে এই লড়াইয়ে জেতার কৌশল খুব পরিষ্কার। সরকারের প্রধান কৌশল হচ্ছে বিরোধী দলের আন্দোলনের রাজনৈতিক বৈধতা আড়াল করে এটিকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে প্রচারণা চালানো। অথচ বিরোধী দলের আন্দোলনের সুস্পষ্ট লক্ষ্য ছিল ২০১৪ সালের প্রহসনমূলক নির্বাচনের প্রতিবাদ করা এবং সরকারকে অবিলম্বে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে বাধ্য করা। একই কাজ আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকার সময় ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর করেছিল, ২০০৬ সালেও সাজানো নির্বাচনের আশঙ্কা থেকে আওয়ামী লীগ সহিংস আন্দোলন করেছিল।
আগের যেকোনো আন্দোলনের তুলনায় এবারে সহিংসতার মাত্রা অবশ্য অনেক বেশি, অনেক বেশি রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দমন-নির্যাতনও। প্রচারণা যুদ্ধে বহুগুণ এগিয়ে থাকার কারণে এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকেও সরকার জায়েজ বলতে পারছে পেট্রলবোমার দায় পুরোপুরিভাবে বিএনপি-জামায়াতের ওপর চাপিয়ে দিয়ে। অথচ দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রগুলোয় বোমা, ককটেলসহ বিএনপি-জামায়াতের লোকদের গ্রেপ্তারের খবর যেমন রয়েছে, তেমনি কিছু ক্ষেত্রে রয়েছে আওয়ামী লীগের লোকদের বোমাসহ প্রেপ্তারের সংবাদও। পার্থক্য হচ্ছে, আওয়ামী লীগের লোকজন অনেক ক্ষেত্রে ছাড়া পাচ্ছেন পুলিশ হেফাজত থেকেই, তাঁদের পক্ষে সাফাই গাইছে স্বয়ং পুলিশই। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে ভয়াবহ পেট্রলবোমা হামলার পর পুলিশ দ্রুত অভিযান চালিয়ে পেট্রলবোমাসহ যে মানিক ও বাবুলকে গ্রেপ্তার করেছিল, তারা ছিল যুবলীগের নেতা। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে পুলিশ তাদের ছেড়ে দেয়। পুলিশের বক্তব্য ছিল: অপরাধীরা হয়তো মানিককে জড়ানোর জন্য তার বাসার পেছনে বোমা রেখেছিল এবং তাই আমরা তাকে ছেড়ে দিয়েছি (নিউএজ, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)। এ রকম উদাহরণ আরও রয়েছে। তবে এসব সংবাদকে ধর্তব্যের মধ্যে না নিয়ে সংসদ, প্রশাসন ও গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকার কারণে শুধু বিএনপি-জামায়াতের গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের ঢালাওভাবে বোমাবাজ হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে এবং আন্দোলনের রাজনৈতিক লক্ষ্য থেকে মানুষের মনোযোগ নিবদ্ধ করা যাচ্ছে বোমাবাজির নৃশংসতার ওপর।
প্রচারণা কৌশলের সুফল নেওয়ার জন্য সহায়ক বিভিন্ন শক্তিও আওয়ামী লীগের রয়েছে। অতীতে বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগ সফল হতে পেরেছিল অন্যান্য শক্তির (আমলা, বিভিন্ন বাহিনী, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়) সমর্থন বা নিরপেক্ষতার জন্য। ২০০৯ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ বিভিন্ন সুচিন্তিত পদক্ষেপের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন শক্তিকে নিয়ন্ত্রিত বা একাত্ম করতে পেরেছে। একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জঙ্গিবাদ দমন ও সন্ত্রাস ইস্যুতে সুকৌশলী প্রচারণা চালিয়ে বিএনপিকে অনেকের কাছে অগ্রহণযোগ্য করে তুলে ধরতে পেরেছে। ফলে আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে অপ্রতিনিধিত্বশীল নির্বাচন করেও ক্ষমতায় থাকার দৃঢ়চেতা ও একগুঁয়ে মনোভাব দেখাতে পারছে।
তিন
বর্তমান রাজনৈতিক মোকাবিলায় তাই আওয়ামী লীগের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে এই জয়ের প্রতিফল অন্য অনেকের জন্য হবে মারাত্মক। ক্ষমতায় থাকার জন্য আওয়ামী লীগ এখন নির্ভর করছে মূলত রাষ্ট্রীয় শক্তির ওপর। নির্বিচার মামলা, গ্রেপ্তার, হত্যা ও হামলা চলছে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর দ্বারা। এসব বাহিনীতে পছন্দসই ব্যক্তিদের উঁচু আসনে বসিয়ে একটি কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী তৈরি করা হয়েছে। বাহিনীগুলোর নেতৃত্বে থাকা এসব ব্যক্তি সরাসরি হত্যার নির্দেশ দিচ্ছেন, অমিত ক্ষমতা প্রয়োগ করছেন এবং সীমাহীন নানা সুবিধা ভোগ করছেন। তাঁরা জানেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকতে পারলে তাঁরা যে শুধু পদচ্যুত হবেন তা নয়, তাঁদের কঠিন বিচারের সম্মুখীনও হতে হবে। ফলে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখতে এঁরা বদ্ধপরিকর হয়েছেন নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থে। বিরোধী দলের আন্দোলন পরাজিত হলে জিতবেন এঁরাই।
নানা ধরনের সুবিধা, পদমর্যাদা, সম্মান ও ক্ষমতা প্রদান করে এমন সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি করা হয়েছে সংসদ, বিভিন্ন কমিশন, রাষ্ট্রীয় অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমেও। আওয়ামী লীগ আন্দোলন দমন করে ক্ষমতায় থাকলে আরও বাড়বে এদের ক্ষমতা, প্রতিপত্তি আর অর্থবিত্ত অর্জনের সুবিধা। এই গুটি কয়েক মানুষের অসম সুবিধা লাভের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চরিত্র, রাষ্ট্রের বদলে এরা আরও বেশি পরিণত হবে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতিষ্ঠানে, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের সুবিধাভোগী অংশটি হয়ে উঠবে আরও বেশি একচোখা ধরনের, সরকারের ওপর গোটা রাষ্ট্র ও সমাজের তদারকির শক্তি হবে আরও অনেক দুর্বল। বিভিন্ন ধরনের সুবিধাভোগী ব্যক্তিদের একচ্ছত্র দাপট আর অন্ধ সমর্থনে সরকার হয়ে উঠবে আরও অত্যাচারী, নিপীড়নমূলক ও স্বেচ্ছাচারী।
চার
আর যদি বিএনপি জিতে যায় এই আন্দোলনে? যদি নতি স্বীকার করে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ায় সরকার? এই সম্ভাবনা আসলেই কম। বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল হচ্ছে জনজীবন ও অর্থনীতিকে জিম্মি করে সরকারকে হটে যেতে বাধ্য করা। কিন্তু এই সরকারকে আপাতদৃষ্টিতে তা নিয়ে বিচলিত মনে হয় না। ক্ষমতা থেকে হটে গেলে সরকার ও আওয়ামী লীগকে চরম মূল্য দিতে হবে। ক্ষমতায় থাকলে যতই আন্দোলন হোক, এতে ক্ষতি হবে আসলে জনসাধারণ বা বড়জোর তৃণমূলের কিছু নেতা-কর্মীর। এই হিসাব আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের না বোঝার কথা নয়।
আন্দোলন একমাত্র দীর্ঘস্থায়ী এবং আরও ব্যাপক হলেই হয়তো আওয়ামী লীগকে বাধ্য হয়ে ক্ষমতা ছেড়ে নির্বাচন দিতে হতে পারে। বিএনপির এমন বিজয়ের সম্ভাবনা কম হলেও আছে, তবে সত্যি এটি হলে তার পরিণতিও হতে পারে মারাত্মক। বিএনপি-জামায়াতের প্রতিশোধস্পৃহা, ক্ষমতায় এলে দুর্নীতি, দলীয়করণ আর সন্ত্রাসের যে চিত্র আমরা অতীতে দেখেছি, তা এমন পরিস্থিতিতে আরও বাড়তে পারবে। তা ছাড়া সহিংস আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিএনপি বিজয়ী হলে, বিরোধী দলে গেলে আওয়ামী লীগও একই কাজ করবে। দেশে কুশাসন, সংঘাত, নিরাপত্তাহীনতা তখন আরও বাড়তে পারে।
বিএনপি বিজয়ী হলে তাতেও তাই হারতে পারে বাংলাদেশ। জাতি হিসেবে আমাদের পরাজয় আর পিছিয়ে পড়া শুধু রোধ হতে পারে দুই দলের মধ্যে একটি স্বতঃস্ফূর্ত সমঝোতার মাধ্যমে। ১৯৯০ সালে তিন জোটের রূপরেখা এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য একটি স্থায়ী কাঠামোর ভিত্তিতে এই সমঝোতা হলেই কেবল বিবদমান দুই পক্ষের কমবেশি বিজয় হতে পারে, এগোতে পারে বাংলাদেশ।
পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, এমন সম্ভাবনা খুবই কম এখন।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.