মধ্যপন্থার কথা ভাবতেই হবে by গৌতম লাহিড়ী

বহুল প্রচলিত প্রবাদ_ 'দিলি্ল দিলওয়ালাকে লিয়ে'। তাই তো দিলি্ল নিয়ে এত আবেগ-অনুভূতি। পার্সি প্রবাদ_ 'দিলি্ল দূর অস্ত_ আকাঙ্ক্ষা অপূর্তির অভিব্যক্তি'। রাজধানী দিলি্ল তাই এখানকার রাজনীতি-সংস্কৃতির এক সর্বব্যাপী প্রভাব পড়ে। এবারের দিলি্ল বিধানসভার ভোটে প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরির মধ্যে অন্তর্নিহিত একটি আকাঙ্ক্ষাই রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। সেটা হলো ভারতের অন্য রাজ্যের মতো দিলি্লকে কেন পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হবে না। রাজনৈতিক দলগুলো অনেক সময় তাদের ব্যর্থতার সাফাই দিতে পূর্ণ রাজ্যের অধিকার না পাওয়াকেই অজুহাত করে থাকেন। কিন্তু এ দাবি কতটা যৌক্তিক? এ আকাঙ্ক্ষাই শেষ পর্যন্ত সংঘাতের বীজ রোপণ করে থাকে। ভারতের সংবিধান প্রণেতারা কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে এ প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলেন। সংখ্যাগরিষ্ঠদের মত ছিল_ দিলি্লকে ভারতের অন্য রাজ্যের মতো পূর্ণ রাজ্যের অধিকার দেওয়া যায় না। সংবিধান প্রণেতাদের রায় ছিল দিলি্লকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করে রাখাই শ্রেয়। তা হয়েও ছিল। এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার আগে তারা বিশ্বের বৃহৎ দেশগুলোর রাজধানী সম্পর্কে সমীক্ষা করেন। ওয়াশিংটন-লন্ডন বা প্যারিস কিংবা মেলবোর্ন (১৯২৭ সাল পর্যন্ত এটাই অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ছিল)। পৃথক স্বশাসিত প্রদেশ নয়, প্রত্যেকটি দেশের রাজধানী ফেডারেল সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সুতরাং ভারতের রাজধানী কেন পৃথক প্রদেশ হবে? এখানে কেন্দ্রের প্রতিনিধি হলেন উপরাজ্য পাল। যে প্রথা আজও চলছে।
১৯১১ সালে কলকাতা থেকে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী দিলি্লতে স্থানান্তরিত হওয়ার পর থেকে দিলি্লর জনগোষ্ঠীর বিকাশ হতে থাকে। ভারতের রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে দিলি্ল। শহরের মধ্যে এবং উপকণ্ঠে শিল্পায়ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দিলি্ল ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে 'মিনি ভারত'। দিলি্লবাসীর রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রত্যাশা প্রবল হতে থাকে। ১৯৫৩ সালে ভারতের রাজ্যগুলোর সীমানা নির্ধারণের জন্য গঠিত হলো রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন। কমিশনের সামনেও এ প্রশ্ন আসে। কিন্তু তারাও কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির সিদ্ধান্তকেই অনুমোদন করেন। ১৯৮৯ সালে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক নির্ধারণের জন্য সারকারিয়া কমিশন গঠিত হয়। তারাই প্রথম দিলি্লর রাজনৈতিক অধিকার বিস্তারের জন্য বিধানসভা গঠনের সুপারিশ করেন। তবে আইন-শৃঙ্খলা এবং জমি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে রাখারই সুপারিশ করেছিলেন। এর আগে একদল কংগ্রেস নেতা তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধীর কাছে দিলি্লর পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানান। তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বুটা সিং এককথায় দাবি খারিজ করে দেন।
সারকারিয়া কমিশনের যুক্তি ছিল_ দিলি্লকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়ার অর্থ কেন্দ্রীয় সরকারকে যোজনা কমিশনের রাজস্ব বণ্টনের ফর্মুলা অনুযায়ী দশ শতাংশ রাজস্ব দিলি্ল সরকারকে দিয়ে দিতে হবে। অথচ রাজধানীর স্বাভাবিক উন্নয়নমূলক কাজ কেন্দ্রীয় সরকারকে করতে হবে। এমনিতেই দিলি্ল সরকারের মোট বাজেটের অর্ধেক কেন্দ্রীয় সরকারকে দিতে হয়। কেন্দ্র শাসিত প্রত্যেক অঞ্চলকেই এ অর্থ কেন্দ্র সরকারকে দিতে হয়। ১৯৮৭ সালে প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধী দলের অসন্তোষ প্রশমিত করতে দিলি্লর প্রশাসন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে কমিটি গঠন করেন। সে কমিটি গঠনের পর কেন্দ্রের সরকার পরিবর্তন হয়। তারপর একেবারে ১৯৯১ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এসবি চ্যবন সংসদে ৬৯তম সংবিধান সংশোধনী পেশ করে দিলি্লকে জাতীয় অঞ্চল বলে ঘোষণা করেন এবং সংবিধানেই তা উল্লেখ করে দেওয়া হয়। সে সংবিধান সংশোধনী বিলে অতীতের দেওয়া সব যুক্তিকেই মেনে নেওয়া হয়। অর্থাৎ পূর্ণ রাজ্য করা যাবে না। তবে বিধানসভা থাকবে এবং একটি মন্ত্রিপরিষদ থাকবে, যারা দিলি্লবাসীর দৈনন্দিন জীবনের সম্পর্কিত বিষয়গুলো তত্ত্বাবধান করবেন। ফলে এখন দিলি্লর কোনো পরিবর্তন করার জন্য প্রয়োজন হবে সংবিধান সংশোধন। রাজনৈতিক সর্বসম্মতি ছাড়া যা করা এক রকম অসম্ভব। দেশের মধ্যে দিলি্ল ও পুন্ডুচেরি এমন রাজ্য যেখানে রাষ্ট্রপতি মুখ্যমন্ত্রী ও তার মন্ত্রিসভা নিয়োগ করেন।
২০০৩ সালে এনডিএ সরকারের আমলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদভানি সংসদে দিলি্লকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়ার জন্য সংবিধান সংশোধনী বিল পেশ করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিলটি পাস করানোর কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার। তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন আজকের ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। তিনিই পরামর্শ দিয়েছিলেন দিলি্লকে ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মতো মর্যাদা দেওয়া সম্ভব নয়। এবারও নির্বাচনের সময় এ দাবির কথা শোনা গেছে। অন্যতম প্রধান দাবি হয়ে উঠেছিল; কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এ বিষয়ে নীরব ছিলেন। তিনি জানতেন_ এ দাবি পূরণ করা আদৌ সম্ভব নয়। যে দাবি পূরণ করা যাবে না, তাকে রাজনৈতিক ইস্যু করা অর্থহীন নয় কি?
দিলি্লতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও সরকারি নির্মাণ কাজের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর নির্ভর করতে হয়। দু'বছর আগের নির্ভয়া কাণ্ড এ রাজ্য গঠনের দাবিকে সোচ্চার করে তুলেছিল। তখনকার দিলি্ল সরকার যাবতীয় দায় কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল; কিন্তু ওই ঘটনার জন্য জনতার রোষের মুখে পড়ে দিলি্ল সরকার।
রাজনৈতিক নেতাদের এ দাবির নেপথ্যে একটিই উদ্দেশ্য_ পুলিশের এবং দিলি্লর যাবতীয় জমির ওপর অধিকার। যেমনটা অন্য রাজ্যের রয়েছে। অর্থাৎ রাজনৈতিক প্রশাসন পুলিশের বদলি ও নিয়োগের ক্ষমতা পাবে। দিলি্লর ক্ষেত্রে এ দাবি জরুরি কি? তবে এবার বোধহয় কেন্দ্রীয় সরকার এবং দিলি্লর নতুন জনপ্রিয় আম আদমি সরকারের মধ্যে সহযোগিতার রাস্তা বের করার জন্য মধ্যপন্থা কোনো উপায় ভাবতেই হবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছুরই পরিবর্তন হয়। নিরাপত্তা ও রাজ্য সরকারের স্বার্থে জমি ব্যবহারের অনুমতি না দিলে ফের রাজধানী অশান্ত হতে পারে। যেটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। দিলি্ল সরকার যদি স্কুল-কলেজ তৈরি করার ন্যায্য প্রস্তাব দেয় তাহলে সেটা কেন্দ্রকে ভেবে দেখতেই হবে। রাজধানী দিলি্লর ছবিই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের প্রতিচ্ছবি। তাই এবার বোধহয় সাবেক দিলি্লর পরিবর্তন হতে চলেছে। নতুবা ফের অশান্তি। রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কা।
সমকাল প্রতিনিধি, নয়াদিলি্ল

No comments

Powered by Blogger.