জিএসপি এখন নতুন রাজনৈতিক ইস্যু by ড. তুহিন মালিক

যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা স্থগিত হওয়ায় বাংলাদেশ বিশ্বজুড়ে মারাÍক ইমেজ সংকটের মধ্যে পড়েছে। আর দেশের সরকার তার দায় এড়ানোর জন্য পিলো পাসিং খেলছে। রাজনৈতিক পাশা খেলায় পারদর্শী সরকার এ ব্যর্থতার পুরো দায়টি চাপিয়ে দিচ্ছে বিরোধী দলের নেত্রীর কাঁধে। বিদেশী পত্রিকায় নিবন্ধ লিখে নাকি বেগম খালেদা জিয়া জিএসপি বাতিল করেছেন। পত্রিকায় নিবন্ধ লিখে জিএসপি বাতিল করা সম্ভব হলে পত্রিকায় নিবন্ধ লিখে কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় না কেন, তা বোধগম্য নয়। আর খালেদার চিঠিতে জিএসপি বাতিল হলে সরকারের এক চিঠিতে সেটা চলে আসে না কেন? আসলে দায় এড়ানোর পন্থা হিসেবে এসব ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দিয়ে এখন আর রাজনীতি করা যায় না। তাই দেশের ললাটে কলংক লেপন করে বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশকে পঙ্গু করার আÍঘাতী রাজনীতি থেকে আমাদের সরে আসার কোনো বিকল্প নেই।
জিএসপি স্থগিতের মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি কী করে ভিলেজ পলিটিক্সের অংশ হয়ে গেল তা ভাবতে অবাক লাগে। যেখানে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত সংসদে দাঁড়িয়ে জিএসপি বাতিল, শেয়ার মার্কেট, হলমার্ক ও পদ্মা সেতুতে বিএনপি জড়িত বলে অভিযোগ করেন, সেখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, সবই যখন বিএনপি করছে তাহলে সরকারের কাজটা কী? পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থা, প্রশাসন, পররাষ্ট্র দফতর কি এতটাই ব্যর্থ বিএনপির কাছে? তবে তো সরকার নয়, বরং বিএনপিরই দেশ পরিচালনা করা উচিত। আসলে দেশ পরিচালনা করে সরকার। আর দোষ চাপানো হচ্ছে কিনা বিরোধী দলের ওপর। দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারকেই তো ব্যর্থতার দায়-দায়িত্ব নিতে হবে। আমরা বুঝতে পারছি না, নেত্রীরা জিএসপি নিয়ে কেন এত ঝগড়া করছেন। কেন জিএসপি স্থগিত হল, সেটা নিয়ে আমরা কাজ করছি না কেন? যাদের জন্য এই বিপর্যয়, তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে না কেন? কাদের কারণে দেশের আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সম্প্রসারণ ব্যাহত হল? দেশের ভাবমর্যাদা নষ্ট করার পেছনে কারা দায়ী?
জিএসপি সুবিধা স্থগিত হওয়ার বিষয়টি কিন্তু হঠাৎ করে ঘটেনি। কয়েক মাস ধরে এটি আলোচিত হয়ে আসছিল। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চার দফা শুনানিও হয়। স্থগিত হওয়ার আশংকা বরাবরই ছিল। শেষ পর্যন্ত সেটাই বাস্তব রূপ পেল। এ সময়ের মধ্যে আমরা কী করলাম? মূলত তাজরিন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যুর পর থেকেই বাংলাদেশের পোশাক কারখানার শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা নিয়ে নড়েচড়ে বসে পশ্চিমা দেশগুলো। রানা প্লাজা ধসের পর সেটা আরও ত্বরান্বিত হয়। রানা প্লাজা ধসের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন পোশাক কারখানায় শ্রমমান ও কর্মপরিবেশ উন্নয়নে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তাগাদা দিয়ে আসছিল। বলা হয়েছিল, তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রম অধিকারের গুরুতর পদ্ধতিগত লংঘন চলতে থাকলে ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা প্রত্যাহার করা হতে পারে।
খুব সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন জাগে, সরকার পশ্চিমা দেশগুলোর এই হুশিয়ারিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিল কিনা? শ্রমমান, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও নিরাপত্তা নিয়ে সরকারের অঙ্গীকার কোথায় ছিল? জিএসপির বিষয়টিতে সরকার যথাযথ গুরুত্ব দেয়নি কেন? এই সুবিধা বহাল রাখার জন্য যে ধরনের লবিং ও কার্যকর ব্যবস্থা অবলম্বন করা প্রয়োজন ছিল, সরকার তা করেছে কিনা? কূটনৈতিক দুর্বলতা ছিল কিনা? বিষয়টি হ্যান্ডলিং করার মতো সক্ষমতা সরকারের কর্তাব্যক্তিদের ছিল কিনা? সবচেয়ে বড় কথা, অন্যান্য ইস্যুর চেয়ে এ বিষয়টিকে সরকার গুরুত্ব দিয়েছিল কিনা? এসব প্রশ্নের জবাব আমাদের জানা নেই। তবে প্রশ্ন ওঠে, জবাব কেন নেই? বিএনপির দোষে এটা হয়েছে বলে জবাব দিলে তা কী করে যুক্তিযুক্ত বা গ্রহণযোগ্য হবে?
আসলে নিষ্ঠুর বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশকে এক কলংকজনক ঘটনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। একক দেশ হিসেবে জিএসপি সুবিধা বাতিলের এ ঘটনা নিশ্চিতভাবেই বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা ম্লান করে দিয়েছে। এটি দেশের জন্য যেমন লজ্জার, তেমনি দুর্ভাগ্যের। আসলে সরকার রাজনৈতিক দলগুলো দমনে ব্যস্ত সময় পার করতে গিয়ে পোশাক খাতটির দিকে মোটেও নজর দেয়নি। শ্রমিকদের স্বার্থের দিকে না তাকিয়ে কর ও শুল্ক ছাড়সহ নানা সুবিধা নিয়ে মালিকদের স্বার্থরক্ষা করেছে সরকার।
যুক্তরাষ্ট্রের দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস জিএসপি স্থগিত করার পর এ নিয়ে সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। নিবন্ধে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র আশা করে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিকের স্বার্থে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এ সিদ্ধান্ত শেখ হাসিনার সরকারের ওপরে চাপ তৈরি করবে। শেখ হাসিনার সরকার বারবার আশ্বাস দিয়েছিল, কারখানায় কর্মপরিবেশের মান উন্নত করা হবে এবং শ্রমিকরা যাতে সহজে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করতে পারে, সেটি নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এগুলো আশ্বাসই থেকে গেছে। নিবন্ধে আরও বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার মতো নেতারা খুব চাপে না পড়লে এমন কোনো পরিকল্পনা হাতে নিতে চান না যাতে কারখানার মালিক ও তাদের পরিবার ক্ষুব্ধ হয়। বাংলাদেশের লাখ লাখ শ্রমিকের জীবন যখন বিপন্ন, তখন বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ তৈরির জন্য মার্কিন ও ইউরোপীয় নেতাদের হাতে যে দু-একটি ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা আছে, সেগুলোকে কাজে লাগাতে হবে।
যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধা স্থগিতের কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং তা ৬০ দিন পর কার্যকর হবে, তাই দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে এবং উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূর করতে এসওএস ভিত্তিতে উদ্যোগ নিতে হবে। এর প্রভাব যাতে কানাডা ও ইউরোপের দেশগুলোতে না পড়ে তার জন্য এখন থেকেই জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। একে অন্যের ঘাড়ে দোষ না চাপিয়ে ব্যর্থতার কারণগুলো চিহ্নিত করে এখনই কার্যকর, জোরালো ও শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, এই স্থগিতাদেশ সাময়িক। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র ১৭টি দেশের বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নিলেও ইতিমধ্যে ১৪টি দেশের ওপর থেকে তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। তবে এর জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন আমাদের আÍশুদ্ধি। মার্কিন নীতিও তাই বলে। তারা সুযোগ দেয় সংশোধিত হওয়ার। আমাদের এই সুযোগকে অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে জাতীয় স্বার্থে। এতে লজ্জার কিছু নেই। আÍনির্ভরশীল না হওয়াটাই বরং বেশি লজ্জার। তাই এটাকে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ইস্যু না বানিয়ে বরং জাতীয় ঐক্য ও সংহতির প্রেক্ষাপটে দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হবে। যদিও আগামী জাতীয় নির্বাচনে এটি নিঃসন্দেহে একটি নতুন ইস্যু হিসেবে কাজ করবে। তবে সেটা অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয়। এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও রফতানিকে গুলিয়ে ফেললে মারাÍক ভুল হবে। মনে রাখতে হবে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আমরা মরণপণ প্রতিযোগিতা করছি। এটাও মনে রাখতে হবে, আমাদের জিএসপি বাতিলে লাভ কোন দেশের।
ড. তুহিন মালিক : আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ

No comments

Powered by Blogger.