মোহালিতে ক্রিকেটের জয়

উসাইন বোল্টের গতিতে মাঠে ছুটে গেলেন মুরালি বিজয়, পাওয়েল-গে হয়ে পেছনে ছুটছেন আরও কজন। কোচ গ্যারি কারস্টেন গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন ইশান্ত শর্মাকে। কজন আবার ড্রেসিংরুমে পাগলের মতো লাফাচ্ছেন, যেন বুঝতে পারছিলেন না কী করবেন! প্রজ্ঞান ওঝা কি কখনো ভাবতে পেরেছিলেন দলকে জিতিয়ে এভাবে ব্যাট উঁচিয়ে ধরবেন? আর ভিভিএস লক্ষ্মণ?
চতুর্থ ইনিংসে ম্যাচ জেতানো ইনিংস বা অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে একা দাঁড়িয়ে যাওয়া—লক্ষ্মণের জন্য এ আর নতুন কি! কিন্তু পিঠের চোটে যাঁর ব্যাটিং করাই অনিশ্চিত, সেই তিনিই ম্যাচ জেতাবেন রানার নিয়ে খেলে, কে ভেবেছিল? এর চেয়েও ভাবনার ঊর্ধ্বে বোধ হয় লক্ষ্মণের আবেগ আর উত্তেজনায় ফেটে পড়া। নিরীহ লোকটিই রান নিতে ভুল বোঝাবুঝি হওয়ায় কী রাগটাই না ঝাড়লেন ওঝার ওপর! ভাবলেশহীন ভাবমূর্তির ক্রিকেটারটিই বাঁধনহারা উল্লাসে মাতলেন দলের জয়ের পর।
মুঠো থেকে জয় ফসকে যাওয়ায় অস্ট্রেলীয়রা তখন হতাশ, বিহ্বল। রিকি পন্টিংয়ের মনোজগতে কী চলছিল, কে জানে! ভারতের মাটিতে একটা জয় অধরাই থেকে রইল ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি টেস্টজয়ী (৪৭) অধিনায়কের।
টেন্ডুলকারই প্রধান বাধা জেনে পঞ্চম দিন শুরু করেছিল অস্ট্রেলিয়া। ‘নৈশপ্রহরী’ জহির খানের সঙ্গে সেই টেন্ডুলকার ফিরে গেলেন ঘণ্টাখানেকের মধ্যে। চতুর্থ ইনিংসে দুর্দান্ত একটা ইনিংস খেলে দলকে জেতানোর সুযোগটা আরও একবার কাজে লাগাতে ব্যর্থ ‘লিটল মাস্টার’। মিনিট দশেক পর যখন একই ওভারে ফিরে গেলেন ধোনি ও হরভজন, জয় তখন আক্ষরিক অর্থেই অস্ট্রেলিয়ার নাগালে। ২ উইকেট হাতে নিয়ে ভারতের প্রয়োজন ৯২ রান। লক্ষ্মণকে না হয় বধ করা না-ই গেল, ওপাশে তো বাকি ইশান্ত ও ওঝা। উইকেটও ব্যাটসম্যানদের সঙ্গে করছে বৈরী আচরণ। লাঞ্চ পর্যন্ত ম্যাচ যাবে কি না, সন্দেহ তখন তা নিয়েই।
কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার দুর্ভাগ্য আর ভারতের অবিশ্বাস্য ঘুরে দাঁড়ানোর সূচনা এখান থেকেই। দুর্দান্ত বোলিং করতে থাকা (৮ ওভারে ৩ উইকেট) বলিঞ্জার মাঠ ছাড়লেন চোট নিয়ে। আউট হচ্ছি-হব করতে করতে টিকে রইলেন ইশান্ত। বরাবরের মতোই চোখধাঁধানো সব শট খেলতে থাকলেন লক্ষ্মণ। সাহস পেয়ে দু-একটি দারুণ শট খেললেন ইশান্তও। একসময় ম্যাচ চলে এল ভারতের নাগালে। তখনই আরেক নাটক!
অমূল্য ৩১ রান করে, ৮১ রানের অসাধারণ জুটি গড়ে ইশান্ত এলবিডব্লু হলেন জয় থেকে মাত্র ১১ রান দূরে। যদিও টিভি রিপ্লে দেখিয়েছে, লেগ স্টাম্প মিস করত ডেলিভারিটি। নাটকের চূড়ান্ত হলো জয় আসার ঠিক আগেও। ভারতের রান ৯ উইকেটে ২১০, জনসনের বল ওঝার পায়ে লেগে চলে গেল পয়েন্টে। এগিয়ে আসা ওঝাকে রান আউট করতে নর্থের থ্রো, স্টাম্পে না লেগে ওভার থ্রো চার। টিভি রিপ্লে এবার দেখাচ্ছিল, পরিষ্কার এলবিডব্লু ছিলেন ওঝা। এক বল পরই দুটি লেগবাইয়ে জয় ভারতের।
টেস্ট শুরু হওয়ার আগের দিন পন্টিং বলেছিলেন, এই সিরিজটা দুটো টেস্ট ম্যাচের চেয়েও আরও বেশি কিছু। ক্রিকেটের ভাবমূর্তি ফেরানোর সিরিজ। নাটক, রোমাঞ্চ, উত্তেজনা, আবেগময় শেষ দুটো দিনের পর লোকের দৃষ্টি ক্রিকেটে ফিরতে বাধ্য। ম্যাচ শেষে দুই অধিনায়কের কণ্ঠেই একই সুর, ‘ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ম্যাচ।’
আসলে তা-ই। মোহালিতে জয়ী হলো ক্রিকেটই।

No comments

Powered by Blogger.