পৃথিবীতে নাইট্রোজেনের দূষণ বাড়ছে by মুশফিকুর রহমান

আমাদের কৃষক জমির উর্বরতা বাড়াতে বিপুল ব্যয়ে যে পরিমাণ ইউরিয়া বা নাইট্রোজেন সার জমিতে প্রয়োগ করছেন, দুর্ভাগ্যক্রমে তার মাত্র ৩০ শতাংশ ফসলের কাজে লাগছে। বাকিটা বায়ুমণ্ডল ও জলাভূমিতে গিয়ে দূষণ করছে।
জীবনচক্র অব্যাহত রাখতে নাইট্রোজেনের ওপর আমাদের নির্ভরতা ব্যাপক। ছয় বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাওয়া পৃথিবীর মানুষের খাদ্যের জোগান দেওয়ার জন্য নাইট্রোজেন সারের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করতে হয়। কেবল উদ্ভিদের বৃদ্ধি নয়, প্রাণীর টিস্যু বা কলা গঠনেও নাইট্রোজেনের ওপর নির্ভরতা প্রাকৃতিক জীবনচক্রে গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রায় ৭৮ শতাংশ নাইট্রোজেন গ্যাসীয় অবস্থায় বিদ্যমান থাকলেও অধিকাংশ প্রাণী ও উদ্ভিদের পক্ষে গ্যাসীয় নাইট্রোজেন গ্রহণ করা সম্ভব নয়। নাইট্রোজেন ও হাইড্রোজেন গ্যাস সংযুক্ত হয়ে অ্যামোনিয়া গঠন করে, যা পানির সঙ্গে মিশে অ্যামোনিয়াম আকারে মাটিতে নাইট্রোজেন সারের জোগান দেয়। প্রকৃতিতে বজ্রপাত ও কিছু ব্যাকটেরিয়া বাতাসের নাইট্রোজেনকে উদ্ভিদের গ্রহণ-উপযোগী অক্সাইডে রূপান্তর করে। পরে উদ্ভিদ সেই নাইট্রোজেন যৌগকে প্রথমে অ্যামাইনো এসিড ও পরে প্রোটিনে রূপান্তর করে, যা প্রাণী ও উদ্ভিদের জীবনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রযুক্তির উন্নয়ন মানুষকে নাইট্রোজেন সার উৎপাদন ও তার ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছে। এতে খাদ্য উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। কৃষিতে ব্যবহূত রাসায়নিক সারের ব্যাপক অংশ জুড়ে রয়েছে ইউরিয়া বা নাইট্রোজেন সার। ১৯০৮ সালে জার্মান রসায়নবিদ ফ্রিট্জ হাবার বাতাসের নাইট্রোজেন গ্যাসকে অ্যামোনিয়ায় রূপান্তর করার কৌশল এবং পরে সুলভে নাইট্রোজেন সার তৈরি করার প্রযুক্তি আবিষ্কার করেন। প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায়, পৃথিবীতে বছরে কৃষিজমিতে প্রায় ৮০ মিলিয়ন মেট্রিক টন অ্যামোনিয়া সার ব্যবহূত হচ্ছে। এর মধ্যে মাত্র ১৭ মিলিয়ন টন ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে ব্যবহূত এবং অবশিষ্ট অংশ অপচয় হয়। বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ বছরে ২২০ মিলিয়ন টন নাইট্রোজেন সার কৃষিজমিতে ব্যবহূত হবে। কিন্তু পরিবেশের সহনক্ষমতা অনুযায়ী পৃথিবীতে নাইট্রোজেন সারের ব্যবহার বছরে ৩৫ মিলিয়ন টনের মধ্যে সীমিত রাখার পক্ষে মত দেওয়া হয়েছে নেচার পত্রিকার এক নিবন্ধে।
ফসলের মাঠে ব্যবহূত রাসায়নিক সার, বিশেষত নাইট্রোজেন সারের বিপুল অংশ সন্নিহিত পুকুর, খাল, নদী ও জলাভূমিতে গিয়ে পড়ছে। কৃষিতে যত বেশি মাত্রায় রাসায়নিক সার, কীটনাশক ব্যবহূত হচ্ছে, তত বেশি জলদূষণ ঘটছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহূত নাইট্রোজেন সারের প্রায় ৪০ শতাংশ এবং চীনের ধানখেতে ব্যবহূত নাইট্রোজেন সারের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কৃষিজমি থেকে জলাশয়ে গিয়ে কেবল দূষণ করছে না, সঙ্গে সঙ্গে অনিয়ন্ত্রিতভাবে জলজ উদ্ভিদ ও শ্যাওলা বিস্তারে সাহায্য করছে। এতে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর জীবন বিপন্ন হচ্ছে। প্রধান নাইট্রোজেন সার ব্যবহারকারী হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ছাড়া অন্য দেশের কৃষি থেকেও বিপুল পরিমাণ নাইট্রোজেন সার প্রতিনিয়ত জলাভূমি ও নদীতে গিয়ে পড়ছে। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, নদীবাহিত রাসায়নিক সার (প্রধানত নাইট্রোজেন সার) গালফ অব মেক্সিকোর মিসিসিপি নদীর মোহনায় প্রায় আট হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার জলজ মাছ, প্রাণী ও উদ্ভিদের জীবনধারণের পরিবেশ বিপন্ন করায় কার্যত তাদের দূরে সরিয়ে দিয়েছে। রাসায়নিক সারের দূষণে কেবল গত বছরই পৃথিবীর দুই লাখ ৪৫ হাজার বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত অনুরূপ প্রায় ৪০০ ‘মৃত উপকূলীয় এলাকা’ চিহ্নিত করা হয়েছে।
শিল্প-কারখানা ও মোটর গাড়ির চলাচল বাড়ার সঙ্গে বাতাসে নাইট্রোজেন অক্সাইডের দূষণও দ্রুত বাড়ছে। মূলত, উচ্চতাপে জীবাশ্ম জ্বালানির দহন থেকে বায়ুমণ্ডলে নাইট্রোজেনের অক্সাইড দূষণ ঘটছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে যেসব জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে, তার দুই-তৃতীয়াংশেরই নাইট্রোজেন অক্সাইড অপসারণের ব্যবস্থা নেই। প্রস্তাবিত নতুন পরিবেশ আইনের সংশোধনী গৃহীত হলে যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে নাইট্রোজেনের অক্সাইড দূষণ ৯০ শতাংশ হ্রাস করার সুযোগ তৈরি হবে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও এ লক্ষ্যে বিভিন্ন তৎপরতা চলছে।
বিষাক্ত এই নাইট্রোজেনের গ্যাস অপর বিষাক্ত গ্যাস ওজোন উৎপাদনে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে। ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি বায়ুমণ্ডলে সৃষ্ট ওজোন গ্যাস মানুষের হাঁপানি ও শ্বাসকষ্টের কারণ হয় এবং উদ্ভিদের জীবনের জন্য হুমকি সৃষ্টি করে। ঊর্ধ্বাকাশে (স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে) নাইট্রোজেনের অক্সাইড মহাজাগতিক ক্ষতিকর বিকিরণ থেকে পৃথিবীকে রক্ষাকারী ওজোন স্তর ধ্বংস করে। তা ছাড়া নাইট্রোজেনের অক্সাইড গ্রিন হাউস প্রভাব সৃষ্টিকারী গ্যাস। আবার প্রধান গ্রিন হাইস গ্যাস কার্বন ডাই-আক্সাইডের তুলনায় নাইট্রোজেনের অক্সাইড ৩০০ গুণ বেশি ক্ষতিকর গ্রিন হাউস প্রভাব সৃষ্টি করে। বায়ুমণ্ডলে ভাসমান নাইট্রোজেনের অক্সাইড এসিড বৃষ্টি আকারে মাটি ও জলাশয়ে নেমে আসে। এসিড-বৃষ্টি জমির উর্বরতা এবং জলাভূমির প্রাণী ও উদ্ভিদের জীবন বিপন্ন করে। এসব কারণে নাইট্রোজেনের অক্সাইডকে পৃথিবীর জন্য অন্যতম প্রধান দূষণ সৃষ্টিকারী ও হুমকির কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
কৃষিতে নাইট্রোজেন সারের ব্যবহার যৌক্তিকীকরণ এখন গবেষকদের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এ জন্য বিভিন্ন গবেষণায় রাসায়নিক সারের ব্যবহার হ্রাস করে জৈব সারের ব্যবহার বৃদ্ধি, মাটির গুণাগুণ যথাযথভাবে পরিমাপ করে প্রয়োজনীয় সার প্রয়োগ, জমিতে একবারের বেশি সার প্রয়োগ করার বদলে অল্প অল্প করে কয়েকবারে জমির প্রয়োজনীয় পরিমাণ সার প্রয়োগ, কৃষি জমি ও জলাশয়ের মাঝখানে খানিকটা বাফার জোন বা খালি জায়গা রেখে দেওয়া, গাড়ি কম চালানো, বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়া এবং খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনে মাংস কম খাওয়ার অভ্যাস গড়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। শিল্পোন্নত দেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের বিষয়ে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কেননা মাংসনির্ভর খাদ্যের জোগান দিতে বেশি মাত্রায় নাইট্রোজেনের দূষণ অবধারিত [একজন গড় মার্কিন নাগরিকের মাংসনির্ভর প্রতিদিনের খাদ্যের জোগান দিতে বছরে প্রায় ১২০ পাউন্ড (প্রায় ৫৪ কিলোগ্রাম) নাইট্রোজেন সার ব্যবহার করতে হয়। শস্য ও শাকসবজিনির্ভর সমপরিমাণ খাদ্য জোগান দিতে প্রায় ৭০ পাউন্ড (প্রায় ৩২ কিলোগ্রাম) নাইট্রোজেন সার ব্যবহার করতে হয়]।
আমাদের দেশে ১৯৫১ সালে ২৬৯৮ টন অ্যামোনিয়াম সালফেট আমদানির মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় রাসায়নিক সারের ব্যবহার। সেই থেকে সারের ব্যবহার ক্রমাগত বাড়ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে রাসায়নিক সারের চাহিদা বছরে প্রায় চার মিলিয়ন টন। উচ্চফলনশীল ধান ও অন্যান্য ফসলের চাষ বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নাইট্রোজেনসহ অন্যান্য রাসায়নিক সারের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। দেশে ব্যবহূত রাসায়নিক সারের মধ্যে ইউরিয়া বা নাইট্রোজেন সার শীর্ষে। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোয় জমিতে ব্যবহূত নাইট্রোজেন সারের প্রায় ৭০ শতাংশ অপচয় হয়। এ অপচয় রোধ করতে ২০০৭ সালে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত ‘ইউরিয়া ব্রিকেট’ তৈরি করে তা জমিতে ব্যবহার করার প্রযুক্তি দেশে ও আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চল, ভিয়েতনাম, লাওসসহ বিভিন্ন দেশে মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। বাংলাদেশে এ প্রযুক্তির কল্যাণে ৪০ শতাংশ কম ইউরিয়া ব্যবহার করে ২০ শতাংশ বেশি ধান উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। এখন চ্যালেঞ্জ হলো সহজ এই প্রযুক্তিকে ছড়িয়ে দেওয়া।
ড. মুশফিকুর রহমান: পরিবেশবিষয়ক লেখক।

No comments

Powered by Blogger.