সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি ৬৮৩ by ফরিদ উদ্দিন আহমেদ

দেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তে এ যাবৎকালের রেকর্ড ভেঙেছে। গত দুই দশকে (২০০০ থেকে ২০১৯ সালের সাত মাস পর্যন্ত) একবছরে সর্বোচ্চ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১০ হাজার ৫২৮ জন। এর আগে গত বছর এই সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ১৪৮ জন। চলতি বছরে যেটা প্রায় সাত মাস পূর্ণ না হতেই রেকর্ড অতিক্রম করেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম এই তথ্য দিয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে রেকর্ড সংখ্যক ডেঙ্গু রোগীও ভর্তি হয়েছেন ৬৮৩ জন। গত একদিনে সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৩৩ জন। ব্যাপক হারে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ায় উদ্বেগ দেখা দিয়েছে সর্বত্র।
রাজধানীর প্রায় ঘরে ঘরেই এখন ডেঙ্গু রোগীর খবর পাওয়া যাচ্ছে। একই সঙ্গে সারা দেশে থেকেও খবর আসছে। ঢাকার বাইরে ৩৭৩ জন আক্রান্তের তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অধিক সংখ্যক রোগী আসায় বিভিন্ন হাসপাতালে তাদের ঠাঁই দিতে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বেসরকারি হিসাবে আক্রান্তের সংখ্যা কয়েকগুণ  ছাড়িয়ে যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন।

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আটজনের মৃতের খবর দিলেও এই সংখ্যা বেড়েই চলছে। গত বৃহস্পতিবার তানিয়া সুলতানা নামে একজন নারী চিকিৎসক মারা গেছেন। এই নিয়ে চলতি মাসেই তিনজন চিকিৎসকের প্রাণ গেল ডেঙ্গুতে। সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা যেটা দিচ্ছে,বেসরকারি হিসাবে তা কমপক্ষে তিনগুণ বেশি হবে। হাসপাতালগুলোতে যথেষ্ট সিট না থাকায় অনেক রোগীকে ভর্তি করা যাচ্ছে না। তারা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। ডেঙ্গু ক্রমেই ভয়ঙ্কর রূপ নেয়ায় জ্বর হলে ডেঙ্গু আতঙ্ক নিয়ে হাসপাতালে ছুটছেন রোগীরা। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা আগেই বাংলাদেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক হিসেবে বর্ণনা করেছে। এদিকে হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীদের নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন স্বজনরা। হাসপাতালের সিট থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্থানে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তাদেরকে পদে পদে ভুগতে হচ্ছে। পরীক্ষার নিরীক্ষার কেন্দ্রগুলোতে দীর্ঘলাইন থাকায় রীতিমত যুদ্ধের মতো সামিল হতে হয় তাদেরকে। যেসব ডেঙ্গু রোগীদের ঢাকায় কেউ নেই তাদেরকে পড়তে হয় মহাবিপদে।

গতকাল সরজমিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, হাসপাতালের সব জায়গায় শুধু ডেঙ্গু রোগী। নতুন ভবনের দ্বিতীয় তলায় ক্লিনিকাল প্যাথলজি  বিভাগে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ২০০ নম্বর কক্ষের সামনে  বিকাল ৩টা পর্যন্তও দীর্ঘ লাইন। এখানে কথা হয় ডেঙ্গু আক্রান্ত সন্দেহে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মো. নুরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি ঢাবির ভূতত্ত্ব বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। তার গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা। জ্বরও আছে। চিকিৎসকরা তাকে সিবিসি ও ডেঙ্গু এনএস-১ পরীক্ষা করতে দিয়েছেন। একই ভবনের পঞ্চম তলায় গিয়ে দেখা যায়, ৫০২ নম্বর মহিলার ওয়ার্ডের সিঁড়ির গোড়া থেকে শুরু করে ওয়ার্ডের মধ্যে কোথাও ফাঁকা জায়গা নেই। যেদিকে তাকাই রোগী আর রোগী। সিঁড়ির গোড়ায় সিট না পেয়ে স্যালাইন লাগিয়ে শুয়ে আছেন শাকিলা। বয়স ২৬ বছর। গত ছয় দিন ধরে প্রচণ্ড জ্বরে ভুগছেন। ছিল পাতলা পায়খানও। পরীক্ষা নিরীক্ষায় তার ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। ফলে বাধ্য হয়ে দ্রুত শানির আখড়া থেকে এসে হাসপাতালে গতকালই ভর্তি হয়েছেন। ওয়ার্ডের ভিতরে ঢুকে দেখি ডানে বামে সিট ছাড়া ফ্লোরে শুধু ডেঙ্গু রোগী। এই মহিলা ওয়ার্ডে দুপুর ৪টায় দিকে সাথী নামের এক ডেঙ্গু রোগী জানান, সকালে হাসপাতালে এসেছেন। কিন্তু কোনো সিট পাননি তিনি। জ্বরে কাতরাচ্ছেন। চিকিৎসকরা তেমন পাত্তা দিচ্ছেন না। এই ওয়ার্র্ডের একজন নার্স জানান, তাদের ওয়ার্ডে ৮০টি সিট রয়েছে। কিন্তু রোগী আছে দ্বিগুণেরও বেশি। গুনে গুনে ১৭৯ জনের হিসাব দেখিয়ে তিনি বলেন, এদিক ওদিক সবই ডেঙ্গু রোগী। হাসপাতালটিতে গত ২৪ ঘণ্টায় ২৩৩ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। বর্তমানে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৬৫৮ জন। ঢামেক থেকে চলতি বছর এই পর্যন্ত সুস্থ হয়ে বাড়ি গেছেন এক হাজার ৩২জন। হাসপাতালটির চিকিৎসক ও নার্সরা জানিয়েছেন, তারও ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে ব্যাপক আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ৬৮৩জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চলতি জুলাই মাসেই আক্রান্ত হয়েছে ৮ হাজার ৩৮৪ জন। আর এবছর আক্রান্তের সংখ্যা ১০ হাজার ৫২৮ জন। সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মারা যাওয়ার হিসাব আটজন দিলেও বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা অন্তত তিনগুণ ছাড়িয়ে যাবে। আক্রান্ত বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা আরও কয়েকগুণ বেশি হবে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। ঢাকার বাইর থেকেও দিন দিন রোগী বেশি আসছে। গতকাল ৩৭৩ জনের আক্রান্তের খবর দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর আগের দিন এই সংখ্যা ছিল ২৪৭ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের পরিসংখ্যান মতে, জুলাই মাসে গড়ে প্রতিদিন ৩১০ জনের উপরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। গাজীপুরে ৬১ জন, মুন্সীগঞ্জ ৩জন, কিশোরগঞ্জ একজন, নারায়ণগঞ্জ ১৩জন, চট্টগ্রামে ৪৯ জন, ফেনীতে ৪৯ জন, কুমিল্লায় একজন, চাঁদপুরে ২৯ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৪ জন, লক্ষ্মীপুর ৪জন, নোয়াখালী ৫ জন, কুষ্টিয়া ১৯ জন, খুলনা ২৪ জন, যশোর ২০ জন,  ঝিনাইদহে ৩ জন, বগুড়ায় ৪০ জন,  বরিশাল থেকে ৩৫ জন, সিলেটে ১৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ২৭শে জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আটজনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তাদের মধ্যে এপ্রিলে দু’জন, জুনে দু’জন ও জুলাই মাসে চারজন মারা যান। তবে বিভিন্ন হাসপাতাল সূত্র বলছে মৃত্যুর সংখ্যা কমপক্ষে তিনগুণের বেশি হবে।

বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছে মিটফোর্ড হাসপাতালে বর্তমানে ২০০ জন, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ৮৭ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ২০৭ জন, বারডেম হাসপাতালে ৩৩ জন, পুলিশ হাসপাতাল রাজারবাগ ১০১ জন, মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ১৯৪ জন, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ১৭২ জন, বিজিবি হাসপাতালে ২৬ জন, রাজধানীর ধানমন্ডি বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১২২ জন, সেন্ট্রাল হাসপাতালে ১০৪ জন, ইবনে সিনা হাসপাতালে ৫৯ জন, স্কয়ার হাসপাতালে ১২ জন, গ্রীন লাইফ হাসপাতালে ২০ জন, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল কাকরাইলে ৯৩ জন, ইউনাইটেড হাসপাতালে ৯৭ জন, খিদমা হাসপাতালে ৩১ জন,  সিরাজুল ইসলাম মেডিকেলে ৮৫ জন, এ্যাপোলো হাসপাতালে ৬০ জন, আদ-দ্বীন হাসপাতালে ৪৪ জন, সালাউদ্দি হাসপাতালে ৬২ জন, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৯ জন,  ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ৫৪ জন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বছরওয়ারী প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুসারে ২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা যথাক্রমে ৫ হাজার ৫৫১, ২ হাজার ৪৩০, ৬ হাজার ২৩২, ৪৮৬ জন, ৩ হাজার ৪৩৪, ১ হাজার ৪৮, ২ হাজার ২০০, ৪৬৬ জন, ১ হাজার ১৫৩, ৪৭৪ জন, ৪০৯, ১ হাজার ৩৫৯, ৬৭১ জন, ১ হাজার ৭৪৯, ৩৭৫ জন, ৩ হাজার ১৬২, ৬ হাজার ৬০, ২ হাজার ৭৬৯, ১০ হাজার ১৪৮ ও ১০ হাজার ৫২৮ জন (২০১৯ সালের ২৭শে জুলাই পর্যন্ত)।

No comments

Powered by Blogger.