নামেই আধুনিক হাসপাতাল! by তৈয়ব আলী সরকার
শিশুদের নিবিড় পরিচর্যা ইউনিট |
সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরই যদি তার চিকিৎসা করাতে হয় হাসপাতালের
বারান্দায় তখন যে কোনও বাবা-মায়ের মন ভেঙে যেতে বাধ্য। কারণ, সন্তানের জন্য
তারা সবচেয়ে ভালোটাই আশা করেন। অথচ এমন মন ভাঙার ঘটনা নিয়মিতই ঘটছে
নীলফামারী সদর আধুনিক হাসপাতালে। এই হাসপাতালের নবজাতকের নিবিড় পরিচর্যা
কেন্দ্রের বারান্দায় এখন নিয়মিতই শিশুদের রেখে চিকিৎসা দিতে বাধ্য হচ্ছেন
চিকিৎসকরা। সম্প্রতি এমন দেখা গেছে, বেড সংকটের কারণে এক থেকে ২৮ দিনের
নবজাতককেও বারান্দায় রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এর একমাত্র কারণ হাসপাতালের
নবজাতকের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রটির শয্যা সংকট।
নীলফামারী সদর আধুনিক হাসপাতালের নবজাতকের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রটি
(স্পেশাল কেয়ার অব নিউ বর্ন-এসসিএএনইউ) চালু হয় ২০১৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি।
এই পরিচর্যা কেন্দ্রটিতে ১০টি শয্যা থাকার কথা থাকলেও আছে মাত্র তিনটি। গত
ছয় বছরেও শয্যা সংখ্যা বাড়ানো হয়নি। শয্যা সংকটের কারণে এখানে চিকিৎসা নিতে
আসা নবজাতকরা নানা জীবাণুর সংক্রমণে সুস্থ হওয়ার থেকে অসুস্থ হচ্ছে বেশি।
ফলে শুধু নামেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে আধুনিক হাসপাতালটি।
জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে প্রতিদিন ৫০-৬০টি নবজাতক চিকিৎসা নিতে আসে
হাসপাতালে। রেডিও থেরাপি বা অপরিপক্ব শিশুর চিকিৎসার একমাত্র নির্ভরযোগ্য
সেবাকেন্দ্র এটি।
নীলফামারী সদর আধুনিক হাসপাতালের শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এনামুল হক বলেন,
‘হাসপাতালের সিজারিয়ান নবজাতক ও স্বাভাবিক (নরমাল) প্রসবের শিশুদেরও নানা
কারণে পর্যবেক্ষণে রাখতে হয়। এজন্য প্রত্যেকটি হাসপাতালে শিশুদের নিবিড়
পরিচর্যা কেন্দ্রটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট।’
তিনি বলেন, ‘নানা সমস্যায় জর্জরিত ইউনিটটি। এখানে নেই রোগীদের শৌচাগার,
ফিডিং কর্নার, পানির ব্যবহার ও অভিভাবকদের বসার জায়গা। পাশের ওয়ার্ডে গিয়ে
শৌচকার্য (ওয়াশ রুম) সেরে আসতে হয়। নেই প্রয়োজনীয় জনবল। তাই নবজাতকদের
চিকিৎসায় হিমশিম খেতে হয়।’
ওই কেন্দ্রের কর্তব্যরত সিনিয়র নার্স (সেবিকা) ফাহিমা বেগম বলেন,
‘মেডিক্যাল অফিসার না থাকায় আমাদের দৌড়ের ওপর থাকতে হয়। শিশুদের ২৪ ঘণ্টা
চোখে চোখে রাখতে হয়। মায়ের অনুপস্থিতিতে সব ধরনের সেবা আমাদের নিশ্চিত করতে
হয়। তাই এখানে একজন চিকিৎসক সবসময় থাকা প্রয়োজন।’
হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স ও সুপারভাইজর কল্পনা রানী দাস বলেন, ‘ওই
ইউনিটটি চালাতে ১২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর দরকার। এর মধ্যে তিন জন আবাসিক
চিকিৎসা কর্মকর্তা (মেডিক্যাল অফিসার), তিন জন নার্স, আয়া ও
পরিচ্ছন্নতাকর্মী (সুইপার) লাগে। এখানে কর্মরত আছেন শুধু তিন জন নার্স।
বাকি পদগুলো শূন্য।’
সদর আধুনিক হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. আবু শফি
মাহমুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শয্যাসংখ্যা, শৌচাগার সমস্যা, ফিডিং কর্নার
ও অভিভাবকদের বসার জায়গা নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে
প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ১০০ শয্যার এই হাসপাতালে জনবল সংকট একটি
মারাত্মক সমস্যা। অনেক আগেই থেকেই এ সমস্যা বিরাজ করছে। অল্পদিনেই সমস্যার
সমাধান হবে।’
শনিবার (৬ জুলাই) রোগীর সংখ্যা ছিল ৯৪৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ওয়ার্ডে
ভর্তি ৯৩, নারী ভর্তি ১১১, শিশু রোগী ৯২, ডায়রিয়ায় ৮, নবজাতক ভর্তি ১১ জন।
সদর আধুনিক হাসপাতালের বহির্বিভাগের টিকিট মাস্টার জবেদুল ইসলাম বলেন,
গরম শুরুর থেকে রোগীর সংখ্যা আনুপাতিক হারে বেড়ে গেছে। আগের তুলনায় এখন
প্রতিদিন গড়ে ৫৫০-৬০০ রোগীর টিকিট সরবরাহ করতে হয়। এতে বাড়তি ঝামেলা পোহাতে
হচ্ছে। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট সংগ্রহ করছে রোগী ও তার স্বজনরা।
দিনাজপুর জেলার খানসামা উপজেলা থেকে নীলফামারী সদর আধুনিক হাসপাতালে
চিকিৎসা নিতে আসা জাকিয়া বেগম (২০) বলেন, তার পাঁচ দিন বয়সী সন্তান জন্মের
পর থেকে জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে নিউনেটালে ভর্তি হয়।
তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে বেড না পেয়ে বারান্দায় থেকে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।
এই ওয়ার্ডে রোগীর যত ভিড়, রোগী নিয়ে থাকার একটুও পরিবেশ নেই। পানির সংকট তো
লেগেই আছে।’
নীলফামারী সদরের চওড়া ইউনিয়নের কাঞ্চনপাড়া গ্রামের পূর্ণিমা রায় বলেন,
১১ দিনের শিশু রত্নাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ভর্তি করে সমস্যায় পড়েছি।
এখানে শৌচাগার (বাথরুম) না থাকায় অসুস্থ হয়ে পড়েছি। হাসপাতালের আশপাশের
রোগী চিকিৎসা নিয়ে বাসা বা বাড়িতে চলে যায়। আবার সময়মতো এসে রোগীর ওষুধপত্র
নেয়। আমাদের বাড়ি দূরে হওয়ায় অনেক সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
একই উপজেলার সোনারায় ইউনিয়নের কাছাড়িপাড়া গ্রামের একদিনের নবজাতক নিয়ে
আসা আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘বিছানা না থাকায় রোগী নিয়ে থাকা খুবই কষ্ট।
বারান্দায় থেকে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। এটি শিশুদের জন্য বড় যন্ত্রণার। যাদের
বাড়ি হাসপাতালের কাছে, তারা রাতে বাড়ি চলে যায় আর সকালে আসে। এতে ব্যয়
বেড়ে যাওয়ায় লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ বেশি। সরকারি হাসপাতালে শিশুর সেবাই
বড় সেবা।’
সদর আধুনিক হাসপাতালের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মো. এনামুল হক বলেন,
‘হাসপাতালের পাশেই ২৫০ শয্যার হাসপাতালটি উদ্বোধন হলে শিশুদের এই সমস্যা
কেটে যাবে। ২০১৩ সালে তৎকালীন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এই ইউনিটটি
নতুনভাবে চালু করেন। এটি এই হাসপাতালে আগে ছিল না। তাই রোগীদের সাময়িক
কষ্ট হচ্ছে। এর আগে শিশুদের নিয়ে রংপুরে যেতে হতো। এখন আর সেই ঝামেলা
পোহাতে হয় না।’
নীলফামারীর সিভিল সার্জন ডা. রণজিৎ কুমার বর্মণ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,
সদর আধুনিক হাসপাতালটি ১০০ শয্যার হলেও ৫০ শয্যার জনবল দিয়ে পরিচালিত
হচ্ছে। নবজাতকদের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সমস্যার কথা জানানো হয়েছে।
আশা করি, আড়াইশ শয্যার হাসপাতালটি চালু হলে এর দ্রুত সমস্যার সমাধান হবে।
No comments