এ বাজেট হিসাব-নিকাশের, দর্শনভিত্তিক নয়

প্রতিবছর যখন অর্থমন্ত্রী সংসদে বাজেট পেশ করেন, তারপর তা পাস হওয়া অবধি বাজেট নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল আলোচনা ও বিতর্ক চলতে থাকে। সরকার পক্ষ উঁচু গলায় বলতে চেষ্টা করে বাজেটটি কতটা জনবান্ধব এবং উন্নয়নমুখী হয়েছে। অপরদিকে সরকারবিরোধীরা প্রমাণ করার চেষ্টা করে বাজেটটি কীভাবে জনগণের জন্য দুঃখ-দুর্দশার কারণ হবে এবং তাদের জন্য অকল্যাণ বয়ে আনবে। আমার জীবনে সেই পাকিস্তান আমল থেকে যতগুলো বাজেট পেশ হতে দেখেছি, তার একটিও এ ধরনের বিতর্ক থেকে মুক্ত থাকতে দেখিনি। মানতেই হবে বাজেটের কাজ-কারবার অর্থনীতিকেন্দ্রিক হলেও বিষয়টি চূড়ান্তভাবে রাজনৈতিক তাৎপর্যমণ্ডিত। বাজেটের মাধ্যমে একটি দেশের সরকার তার বার্ষিক আয়-ব্যয়ের খতিয়ান তুলে ধরে। বাজেটে নানাবিধ কর্মকাণ্ডের জন্য অর্থের বরাদ্দ দেখানো হয়। অন্যদিকে এ অর্থ কোথা থেকে আসবে, কাদের কাছ থেকে আসবে এবং কীভাবে আসবে তারও একটি বিবরণ তুলে ধরা হয়। অর্থাৎ শেষ বিচারে বাজেট হল এমন এক ধরনের অনুশীলন, যার মাধ্যমে জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন অংশের মধ্যে সম্পদের হস্তান্তর ঘটে থাকে। অর্থনীতিবিদরা একেই বলে থাকেন Allocation and distribution of resources. এই নিরিখে বিচার-বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে বাজেট সমাজের বিশেষ শ্রেণীর স্বার্থে অন্য শ্রেণীগুলোকে প্রদেয় প্রদানে বাধ্য করে। এভাবেই সমাজে একটি সুনির্দিষ্ট শ্রেণী কাঠামো বজায় রাখার প্রয়াস পায় শাসকগোষ্ঠী। প্রশ্ন উঠতে পারে, শাসকগোষ্ঠী যেভাবে বাজেটের মধ্য দিয়ে সম্পদ বিন্যস্ত করার প্রয়াস পায়, তার ফলে কি কেবল ধনীরাই সুবিধাপ্রাপ্ত হয়, গরিবরা কিছুই পায় না? ব্যাপারটি সম্পূর্ণভাবে এরকম নয়।
আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম তখন বিশেষ করে অর্থনীতি ও সমাজতত্ত্ব বিভাগে শ্রেণী বিশ্লেষণের ব্যাপক চর্চা হতো। এর একটি বড় কারণ সেই সময়কার বিশ্ব পরিস্থিতি। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে সারা পৃথিবী টালমাটাল হয়ে উঠেছিল। তখন মনে হতো বিশ্ব ব্যবস্থায় একটি পরিবর্তন অত্যাসন্ন। ভিয়েতনামে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রাণপণ মুক্তির লড়াই চলছিল। ভিয়েতনামের জনগণের নেতা হো চি মিন বিশ্বের ঘরে ঘরে আলোচিত হতেন। তিনি আঙ্কল হো নামে পরিচিতি অর্জন করেছিলেন। শুধু ভিয়েতনামই নয়, মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গোটা ইন্দোচীন তথা লাওস, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়াতে এ প্রতিরোধ যুদ্ধের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়েছিল। কম্বোডিয়া ও লাওস দুটি দেশই ছিল রাজতন্ত্রশাসিত। কিন্তু দেশ দুটির রাজা ছিলেন মার্কিনবিরোধী। কম্বোডিয়ার রাজা নরোদম সিহানুক রাজা হওয়া সত্ত্বেও ঘোর মার্কিনবিরোধী হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছিলেন। মার্কিনিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের কাহিনী তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ My war with CIAতে তিনি তুলে ধরেছেন। একইভাবে প্রতিরোধ যুদ্ধ করছিল প্যালেস্টাইনিরা। প্যালেস্টাইন কন্যা লায়লা খালেদ একটি বিমান হাইজ্যাক করে বিশ্বময় তোলপাড় সৃষ্টি করেছিলেন। উপনিবেশবাদবিরোধী প্রতিরোধ যুদ্ধ চলছিল আফ্রিকার দেশে দেশে। মোজাম্বিক, অ্যাঙ্গোলা, দক্ষিণ আফ্রিকায় সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম তীব্র আকার ধারণ করেছিল। কিউবায় বিপ্লব হয়ে গেছে। কিউবার বিপ্লবী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন আর্জেন্টিনার চিকিৎসাবিদ চে গুয়েভারা। তিনি কিউবার মন্ত্রিত্বের পদ ত্যাগ করে ছুটে গিয়েছিলেন বলিভিয়ায় সশস্ত্র সংগ্রাম সংগঠিত করতে। সেখানে সিআইয়ের সহযোগিতায় বলিভীয় সেনাবাহিনী তাকে হত্যা করে। আজও চে গুয়েভারা একটি কিংবদন্তির নাম।
পাশ্চাত্যের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। ফ্রান্সের ছাত্রনেতা কোন ব্যান্ডিট ও রুডি ডাটস্কি ফ্রান্সজুড়ে দ্যা গলের প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের বিরুদ্ধে যে গণঅভ্যুত্থান গড়ে তুলেছিলেন তা ইউরোপকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। প্রেসিডেন্ট দ্যা গল এক পর্যায়ে ফ্রান্স ছেড়ে জার্মানির সেনাছাউনিতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। মুক্তি সংগ্রামের এ উত্তাল জোয়ারের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেছিলেন আফ্রিকা-এশিয়ার অনেক রাষ্ট্রনায়ক। সেটি ছিল এক ভিন্ন সময়, ভিন্ন যুগ। মনে হয়েছিল গোটা দুনিয়ায় পরির্তন অত্যাসন্ন। এমনই এক বিশ্বপরিস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের রিডার ও প্রধান ড. আবু মাহমুদ বাজেট সম্পর্কে আমাদের শিখিয়েছিলেন, Budget is an instrument of transfer of resources from the poor to the rich. অর্থাৎ বাজেট হল, গরিবদের কাছ থেকে সম্পদ ধনীদের হাতে নিয়ে যাওয়ার একটি হাতিয়ার। পাকিস্তান আমলে যে বৃহৎ বাইশ ধনী পরিবারের সৃষ্টি হয়েছিল তা সম্ভব হয়েছিল বাজেট ও পলিসি নামক হাতিয়ার ব্যবহার করে। আজকের বাংলাদেশে কোনো বুদ্ধিজীবী বা বিশেষজ্ঞকে এ ধরনের উক্তি করতে দেখি না। সাদামাটাভাবে বাজেট সরকারের বার্ষিক আয়-ব্যয়ের দলিল হলেও এর গভীরে থাকে একটি দর্শন। বাজেট সম্পর্কিত সব আলোচনা একেবারেই দর্শনশূন্য মনে হয়। তবে আপাতভাবে দর্শনশূন্যতাও একটি দর্শন। এর মাধ্যমে সুকৌশলে অনেক কিছু আড়াল করা হয়। বিশেষ করে ধনীদের লুণ্ঠন প্রক্রিয়া। বাংলাদেশে বিশাল আকারের ধনিক শ্রেণীর উদ্ভব ঘটেছে। এদের উদ্ভবের পেছনে যতটা না সঞ্চয় ও কৃচ্ছ্রসাধনের চেষ্টা কাজ করেছে, তার চেয়েও হাজারগুণ কাজ করেছে লুণ্ঠন ও তস্করবৃত্তি। মেনে নিতে আপত্তি নেই, এদের একটি অংশ উৎপাদন ও উদ্যোগের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়েছে। এ সম্পর্কিত অংশটি পোশাকশিল্প, চামড়াশিল্প, সিরামিকশিল্প এবং ওষুধশিল্পসহ নানা ধরনের শিল্প কারখানা গড়ে তুলেছে। এদের উৎপাদিত শিল্পসামগ্রী বিদেশেও রফতানি হয়।
মানুষের জন্য কর্মসংস্থানও এতে সৃষ্টি হয়েছে। এরা উৎপাদক হলেও এদের ভোগবিলাস এবং আরাম-আয়েশের মাত্রা কিছুটা হলেও কদর্যরূপে চোখে ধরা পড়ে। ধনিক গোষ্ঠীর যে অংশটি উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কহীন, তারা অনেকেই চোরা কারবার, চোরাচালান, আদম ব্যবসাসহ ব্যাংকের পুঁজি লুণ্ঠনের সঙ্গে সম্পর্কিত। এরা আমাদের আর্থিক খাতকে চরম বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। সরকারি ব্যাংকগুলো পুঁজির অভাবে ভেঙে পড়ার উপক্রম। ব্যাংকগুলো যাতে ভেঙে না পড়ে তার জন্য এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে ২০০০ কোটি টাকা পুনর্ভরণ তহবিল হিসেবে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ তহবিল জনগণের করের টাকায় তৈরি করা হবে। লক্ষকোটি সাধারণ মানুষ ব্যাংকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ডিপোজিটের মাধ্যমে যে শতসহস্র কোটি টাকার তহবিল গড়ে তোলে, সেই তহবিলের অর্থ চলে যায় ঋণখেলাপিদের হাতে। তারপর তারা পাড়ি দেয় বিদেশে। ঋণ জালিয়াতকারী ও ঋণখেলাপিরা যে অপরাধ করল, তার জন্য শাস্তি পাচ্ছে সাধারণ মানুষ। এ ব্যবস্থাকে অনেকেই অনৈতিক বলে আখ্যায়িত করেছেন। এভাবে পুনর্ভরণের ব্যবস্থা পূর্ববর্তী বছরেও করা হয়েছিল। তখনও দেয়া হয়েছিল ২০০০ কোটি টাকা। অবাক লাগে যারা এটাকে অনৈতিক বলছেন তারা কেউ সোজাসাপটা বলছেন না, এটিও সাধারণ গরিব মানুষের অর্থ বাজেটারি প্রক্রিয়ায় ধনীদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। এরা কোন ধরনের ধনী? এদের সঙ্গে উৎপাদনের কোনো সম্পর্ক নেই। এদের বলা যায় Filthy rich. অর্থাৎ নোংরা প্রকৃতির ধনী। একভাবে বলা যায় বাংলাদেশ এখন নোংরা ধনীদের যুগ পার করছে। এসব ব্যক্তির শাসকগোষ্ঠীর লোকদের সঙ্গে নানা ধরনের সম্পর্ক রয়েছে।
এ জন্য একে বলা হয় সাঙাৎ পুঁজিবাদ। ইংরেজি ভাষায় এর নাম Crony capitalism. পুঁজিবাদীদের মধ্যে নিকৃষ্ট হল এই Crony capitalist-রা। এরা সমাজে যে ধরনের অবাঞ্ছিত মূল্যবোধ তৈরি করে তাতে সমাজের অবক্ষয় হয়ে ওঠে অনিবার্য। দেশে কোনো ধরনের উৎপাদনমূলক প্রতিষ্ঠান এরা গড়ে তোলে না বলে এদের স্বদেশকেন্দ্রিক কোনো স্বার্থবোধ কাজ করে না। এরা হয় দেশপ্রেমবর্জিত। কেউ কেউ বলতে চাইবেন, বাজেটে গরিব মানুষদের জন্য নিরাপত্তা জাল তৈরি করার উদ্দেশ্যে নানা নামে ও নানা ধরনের বরাদ্দ রাখা হয়েছে। কাজেই বাজেটটির একটি কল্যাণমুখী চরিত্র রয়েছে। অস্বীকার করব না, এ বরাদ্দ গরিবদের টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন। এর ফলে পানিতে তলিয়ে যাওয়া মানুষ নাকটি পানির ওপর কোনোরকমে ভাসিয়ে রেখে বেঁচে থাকার প্রয়াস পায়। গরিব মানুষের জন্য বরাদ্দ করা এ অর্থ নিয়েও নয়-ছয় হয়। তারপরও বলতে হয় দরিদ্রদের জন্য নিরাপত্তা জাল তৈরি করার পেছনে একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কাজ করে। রাষ্ট্রতত্ত্ব সম্পর্কে যাদের জানা আছে, রিলেটিভ অটোনমি অফ দ্য স্টেট নামক একটি তত্ত্বের সঙ্গে তাদের অনেকেই পরিচিত। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অধ্যাপক ড. নাজমুল করিম বলতেন, State is an instrument of class tyranny. অর্থাৎ রাষ্ট্র হল শ্রেণী নিপীড়নের যন্ত্র। যদিও অধিপতি শ্রেণীটির হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা ন্যস্ত থাকে, তদসত্ত্বেও অধিপতি শ্রেণীর মধ্যে বিভিন্ন দল-উপদল থাকে। এদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে রাষ্ট্র। এছাড়াও শাসিত শ্রেণীর মধ্যে যারা বিত্ত ও সামর্থ্যহীন, তাদের কোনোক্রমে বাঁচিয়ে রাখাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তা না হলে রাষ্ট্রের বদনাম হয় এবং সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হয়। এ জন্যই বিত্ত ও সামর্থ্যহীনদের প্রতি করুণার বারি হিসেবে সিঞ্চিত হয় নিরাপত্তাজালের ছিটেফোঁটা। এটা দেখে বলা যায় না রাষ্ট্র কল্যাণ রাষ্ট্র হয়ে গেছে। ইউরোপে কল্যাণ রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছিল শ্রেণী সংগ্রামের চাপে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় যুক্তরাজ্যে বিভারিজ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী। এর ফলে যুক্তরাজ্যে বেকার ভাতা ও স্বাস্থ্য সুবিধার প্রবর্তন হয়। এসব কল্যাণ রাষ্ট্রে দরিদ্র নাগরিকরা কল্যাণ সুবিধা পেয়ে মোটামুটি পরিচ্ছন্ন জীবনযাত্রা ভোগ করতে পারে। আমাদের সেই পর্যায়ে পৌঁছতে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। রাষ্ট্র কল্যাণধর্মী হলেও তার সুনির্দিষ্ট শ্রেণীচরিত্র হারিয়ে ফেলে না। কল্যাণ সুবিধাদি রাষ্ট্রকে কিছুটা ভদ্রসম্মত চেহারা দেয় মাত্র। এবারকার বাজেট নিয়ে সবচেয়ে বড় বিতর্কটি তৈরি হয়েছে ভ্যাট আইনের বাস্তবায়ন নিয়ে। সিপিডির মতো গবেষণা সংস্থাও মনে করে, ১৫ শতাংশ ভ্যাট অনেক পণ্যের ওপর কার্যকর হলে মধ্যবিত্ত, নিন্মবিত্ত ও গরিব মানুষ ক্ষতির সম্মুখীন হবেন।
এদের অতিরিক্ত দামে জিনিসপত্র কিনতে হবে। আরও দাবি করা হয়েছে এতদঞ্চলের অনেক দেশের মধ্যে বাংলাদেশের ভ্যাটের হার সর্বোচ্চ। ভ্যাট একটি পরোক্ষ কর। এটি আনুপাতিক হারে আদায় করা হলেও এর জন্য কষ্ট বাড়বে নিন্মবিত্ত মানুষের। এটি এক ধরনের ভোগ কর। মনে রাখতে হবে নিন্মবিত্ত মানুষের নিন্ম আয় থেকে ১০ টাকার প্রান্তিক ব্যয় আর উচ্চবিত্তদের বড় আয় থেকে ১০ টাকার প্রান্তিক ব্যয় সমতুল্য নয়। কারণ গরিব মানুষের টাকার প্রান্তিক ব্যয়ের কষ্ট ধনীদের তুলনায় অনেকগুণ বেশি। অথচ ভ্যাট থেকেই সর্বাধিক রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর ফলে দরিদ্র মানুষ অবিচারের সম্মুখীন হবেন। কিন্তু আয়করের মতো প্রত্যক্ষ কর যা সমাজে বৈষম্য হ্রাস করে, তা সার্থকভাবে আদায়ের কোনো প্রক্রিয়া বাজেটে লক্ষ্য করা যায় না। আসলে বিত্তশালীদের অসন্তুষ্ট করতে চায় না সরকার। আয়কর জাল বিস্তার করার জন্য বিভিন্ন উদ্ভাবনী কৌশল প্রয়োগ করা যেতে পারে। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে অনেকটাই নির্বিকার। ব্যাংকে সঞ্চয় আমানতের ওপর দ্বিগুণ কর বৃদ্ধি সঞ্চয় প্রবণতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ব্যাংকের মতো আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানে আমানত রাখার প্রবণতা হ্রাস পেলে আমাদের অর্থনীতির চরিত্র প্রকটভাবে অনানুষ্ঠানিকতার দিকে ধাবিত হবে। এমনিতেই আমাদের অর্থনীতিতে আনুষ্ঠানিক খাতের পরিসর মোটেও সন্তোষজনক নয়। ফলে বিনিয়োগের জন্য অর্থ সংকুলান কঠিন হয়ে পড়বে। যার অভিঘাত পড়বে কর্মসংস্থানের ওপর। এমনিতেই বাংলাদেশে বেকার সমস্যা অত্যন্ত প্রকট। এ সমস্যা যদি আরও প্রকট হয়ে ওঠে, তাহলে অর্থনীতির ভবিষ্যৎ যাত্রা হবে অনিশ্চিত।
রফতানি প্রবৃদ্ধিতে মন্থরতা, রেমিটেন্স আয় প্রবৃদ্ধিতে মন্থরতা এবং ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ মন্থরতা চার লাখ দু’শ ছেষট্টি কোটি টাকার বাজেট বাস্তবায়ন অসম্ভব করে তুলবে। এমনিতেই রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য পূরণ হয় না, ব্যয়ের লক্ষ্যও পূরণ হয় না। তার মধ্যে কীভাবে ৭.৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য পূরণ হবে তাও বোঝা কঠিন। বাংলাদেশের মেগা প্রকল্পগুলোর ব্যয়স্বচ্ছতা নিয়ে মিডিয়াতে বেশ প্রশ্ন উঠেছে। এগুলোকে ভর করে কোনো গোষ্ঠী রেন্ট সিকিংয়ে লিপ্ত হচ্ছে কিনা সে ব্যাপারে জনমনে প্রশ্ন আছে। এভাবে রেন্ট সিকিংকেন্দ্রিক ধনিক গোষ্ঠীর সৃষ্টি ও বিস্তার ক্যাপিটালিজমের অভিশাপের বিপদ সৃষ্টি করছে কিনা সেটিও এক বড় প্রশ্ন। পুঁজিবাদী উৎপাদনমুখী বাজার অর্থনীতির প্রধান উপযোগিতা এর প্রতিযোগী, দক্ষ এবং স্বচ্ছ বৈশিষ্ট্য। ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের তুলনায় এ রকম পুঁজিবাদ অনেক বেশি কাম্য হতে পারে। বাংলাদেশে এ প্রক্রিয়া যেন অনেকটাই নিস্তেজ। এটি জাতির জন্য শুভ সংবাদ নয়। গোটা বাজেট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কীভাবে ক্রোনি ক্যাপিটালিজম দানা বিস্তার করছে সেটি একটি গভীর ও অনুপুঙ্খ গবেষণার বিষয়। সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় হল, বাংলাদেশের বাজেট পর্যালোচনায় দর্শনবিমুখতা। এটি আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার দারিদ্র্য ছাড়া আর কিছু নয়। অর্থনৈতিক দারিদ্র্যের চেয়ে এ দারিদ্র্য অনেক বেশি বিপজ্জনক।
ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ

No comments

Powered by Blogger.