সুনীতির অপেক্ষায়

সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও প্রভাবশালী মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের স্বীকার করেছেন সড়কপথে চাঁদাবাজি হয়। আর এর সঙ্গে যুক্ত থাকেন রাজনৈতিক অঙ্গনের মানুষ, আইন প্রণেতা, প্রশাসনের কর্তা আর পুলিশের লোক। সাধারণ মানুষের কাছে এসব অজানা নয়, তবু দল ও সরকারের নীতিনির্ধারকরা বিষয়টি জানেন ভেবে স্বস্তি পেলাম। সাধারণ ভুক্তভোগীরা জানেন প্রতিটি সেবা খাতে কী পরিমাণ ঘুষের চাপে পড়তে হয় সাধারণ মানুষকে। শুনেছি গ্যাস স্টেশনগুলোতে অতিরিক্ত সিলিন্ডার এনে গ্যাস ভরে নিয়ে তা দিয়ে কোনো ফ্যাক্টরি বা শিল্পকারখানা চালানো নিষেধ। অথচ চন্দ্রা থেকে নবীনগর আর আশুলিয়া থেকে সাভারের বলিয়ারপুর পর্যন্ত অধিকাংশ গ্যাস স্টেশনে দিনে-দুপুরেই চলছে অবৈধ গ্যাস সরবরাহ। দুই সিলিন্ডার বহনকারী ছোট গাড়ি থেকে শুরু করে বিশাল কাভার্ড ভ্যানের ভেতর বিশেষ ব্যবস্থাপনায় ১০-১৫টি বিশাল আকারের সিলিন্ডার বোঝাই গাড়ি এসে থামে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এসব সিলিন্ডারে গ্যাস ভরা হয়। এই অবৈধ গ্যাস দিয়েই অনেক ফ্যাক্টরি চলে। সংশ্লিষ্ট সব দফতরের দায়িত্বশীলদের চোখের সামনে বছরের পর বছর এমন অবৈধ গ্যাস চুরি চলছে। সংশ্লিষ্টজনদের সন্তুষ্ট না করে কি এ ‘পুণ্য’ কাজটি করা সম্ভব! কত ওপর পর্যন্ত এ পুণ্য কর্ম হয় কে জানে! এখন আতঙ্ক নিয়ে পত্র-পত্রিকা পড়ি। কারণ চাই না বড় মানুষদের সব সুকীর্তি জেনে ফেলি। এর মধ্যে এক কাগজের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন চোখে পড়ল। পড়ার সময় আমার প্রয়াত শিক্ষক ভারতীয় ইতিহাসের গুরুনানক অধ্যাপক বিদগ্ধ ইতিহাসবিদ অধ্যাপক অমলেন্দু দে’র কথা মনে পড়ল। ১৯৯১-৯২-এর কথা বলছি। স্যার তখন ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। আমাদের দেশে যতটুকু আছে, ওখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ আরও কম। স্যার থাকেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৫-৭ কিলোমিটার দূরে বাঘাযতীনে নিজ বাড়িতে। স্যারের কোনো ব্যক্তিগত গাড়ি নেই। অটোতে শেয়ারে যাওয়া-আসা করেন। একদিন স্যারের কক্ষে বসে আছি।এমন সময় রেজিস্ট্রার অফিস থেকে ফোন এলো। পরদিন সিন্ডিকেটের একটি জরুরি বৈঠক আছে। রেজিস্ট্রার সাহেব জানতে চাইছেন তাকে আনার জন্য বাসায় গাড়ি পাঠাবেন কিনা। জবাব শুনে মনে হল স্যার অদ্ভুত একটি কথা শুনছেন। বললেন, ‘সেকি রেজিস্ট্রার সাহেব! অটোতে যাওয়া-আসায় আমার ৫ টাকা খরচ হয়, আপনি মিছিমিছি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ টাকার তেল পোড়াবেন কেন!’ বড় মানুষদের সান্নিধ্যে এসে জীবনের অনেক ছোট-বড় সঞ্চয় ধারণ করার চেষ্টা করি। এ ঘটনাটি আমার একটি বড় সঞ্চয় হয়ে আছে। কিন্তু আমাদের দেশের হিসাব আলাদা। দেশপ্রেমের সঙ্গে নিশ্চয় আচরণের সম্পর্ক থাকে। এখন তো বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. মোহাম্মদ এনামুল হক, সৈয়দ আলী আহসান বা জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর মতো প্রফেসররা পাণ্ডিত্যের ছটায় উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান না। তাই তেমন আচরণ আশা করি না। অনেক বছর আগে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম একটি অপচয় দেখে। একজন নতুন উপাচার্য নিযুক্ত হলেন। আগের উপাচার্য বছরখানেক আগে একটি ঝকঝকে গাড়ি কিনেছিলেন। এখনও নতুনের মতোই দেখায়। একদিন জানলাম সেটি বাতিল করে নতুন গাড়ি কেনা হয়েছে। এ রেওয়াজ এখন কমবেশি চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গাড়ি-ঘোড়ার সুবিধা কম।
তবুও এমন দু-চারটা উদাহরণ দেখলে কেমন বাধো বাধো লাগে। এখন পত্রিকার রিপোর্টের কথায় আসি। আমাদের মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রীদের নতুন গাড়ির প্রয়োজন হয়। তাতে সমালোচনার কিছু নেই। কয়েক বছর আগে মন্ত্রীরা নাকি দামি জিপ গাড়ি বরাদ্দ চেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী রাজি হননি। বদলে প্রায় ৭০ লাখ টাকা মূল্যের ৫০টি হাইব্রিড বিলাসবহুল গাড়ি কেনা হয়। এসব গাড়ির বিশাল অঙ্কের জ্বালানি আর ড্রাইভার খরচ তো রাষ্ট্রই বহন করে। প্রতিবেদনের সারকথা- অল্প কয়েকজন মন্ত্রী ছাড়া অধিকাংশই এই গাড়ি ব্যবহার না করে পুলে রেখে দিয়েছেন। এর বদলে নিখরচায় সরকারি পুলের গাড়ি ব্যবহার করছেন। আর নতুন গাড়ির বরাদ্দকৃত জ্বালানি খরচের টাকা জমা হচ্ছে সম্মানিত মন্ত্রী মহোদয়দের বেতনের সঙ্গে। ব্যবহার না করায় দামি গাড়িগুলো নষ্ট হচ্ছে। আমার এক সহকর্মী জীববিজ্ঞান অনুষদের প্রবীণ অধ্যাপক। অনেক বছর আগের কথা বলছি। আমাকে বিস্মিত করে জানালেন, তার বাসায় কোনো খবরের কাগজ রাখেন না। নিজে পড়েন না, চেষ্টা করেন ছেলেমেয়েরা যাতে বিরত থাকে। কিন্তু শত চেষ্টা করেও টেলিভিশন থেকে বিরত রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তাই আতঙ্ক থেকে মুক্তি নেই আত্মভোলা এ বিজ্ঞানীর। তার দৃষ্টিতে ভালো কোনো খবর থাকে না পত্রিকায়। সন্ত্রাস, খুনোখুনি, দুর্ঘটনা, ঘুষ-দুর্নীতি, রাজনৈতিক ঝগড়া এসব নেতিবাচক বিষয় পত্রিকার পাতাজুড়ে থাকে। ভালো কথা লেখার সুযোগই যেন নেই। অধ্যাপক মহোদয়ের শঙ্কা- এসব পড়ে আর শুনে নতুন প্রজন্মের এখন বড় হওয়ার আকাক্সক্ষাটিই মরে যাবে। রাজনীতি ঘরানার ক্ষমতাবান নেতানেত্রীরা যে ভাষা, শব্দ চয়ন ও দেহভঙ্গিতে কথা বলেন, টেলিভিশনের পর্দায় তা দেখে এ প্রজন্মের স্বপ্নভঙ্গ হবে। আমার এ সহকর্মীটি একদিন খুব চমকে গিয়েছিলেন। সদ্য কলেজেপড়ুয়া ছোট ছেলে আবীর বিশেষজ্ঞের মতামত দিয়ে বলল- চোর, ডাকাত, খুনিদের নিজ পেশা ঠিক রাখতে রাজনীতিতে যোগ দেয়া উচিত। অবশ্যই সরকারি বা ভবিষ্যতে সরকারি দল হবে তেমন দলে। কারণ চুরি, ডাকাতি বা খুন-খারাবি করে ধরা পড়লে, জেলে গেলে ক্ষতি নেই। দল ক্ষমতায় থাকলে বা ক্ষমতায় গেলে এগুলো রাজনৈতিক মামলা বলে চিহ্নিত হবে। দেশের আদালত নয়- রাজনীতিকদের গড়া আদালত থেকে এক কলমের খোঁচায় মুক্তি পেয়ে যাবে এসব অপরাধী। আমাদের অধ্যাপক মহোদয় এমন অন্যায়ের অক্টোপাস থেকে মুক্তি পেতে চান বলেই চলমান সময়টি নিয়ে তার হতাশা। তারপরও মনের ভেতর প্রত্যাশা লুকিয়ে রাখেন- ‘আবার সুনীতির সঙ্গে দেখা হবে আমাদের।’ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতির সঙ্গে আমাদের কমবেশি বসবাস বহুকাল থেকেই। যদি খুব বেশি পেছনে না যেতে চাই তবে স্বাধীন বাংলাদেশ পর্ব থেকে দৃষ্টি বোলাতে পারি। এ সত্যটি মানতেই হবে যে, বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে দুর্নীতি রাহুর মতো আমাদের ঘাড়ে চেপে আছে। তবে ১/১১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় যেভাবে রাজনৈতিক দুর্নীতির খেরোখাতা উন্মোচিত হয়েছিল, তা সে সময়ের বিচারে অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ করেছিল। সাধারণের কাছে রাজনীতি আর দুর্নীতি সমান্তরালে এসে দাঁড়িয়েছিল। ব্যক্তি-দুর্নীতি বরাবরই ছিল। তবে সাম্প্রতিককালের মতো এত বাড়বাড়ন্ত হয়তো ছিল না। আগে প্রশাসনিক দুর্নীতি হিসেবে ঘুষ শব্দটির সঙ্গেই মানুষের জানাশোনা ছিল বেশি। সুযোগ থাকলেও ঘুষ সব পেশাজীবী খেতেন না। যারা ঘুষ খেতেন, সমাজে তারা খুব মাথা উঁচু করে চলতেন না। নিন্দনীয় বলে ‘ঘুষখোর’ শব্দটির জন্ম হয়েছিল। এখন ঘুষের পরিধি অনেক বেড়েছে। ঘুষখোরের সংখ্যাও বেড়েছে অনেক। নানা নামে ঘুষ শাখা-প্রশাখা মেলেছে, যা সাধারণ শব্দে ব্র্যাকেটবন্দি করা হয় ‘দুর্নীতি’ নামে। এখন নাগরিক জীবনের বিভিন্ন সেবা খাতে কমিশন বা পারিতোষিক, চাকরি বাণিজ্য, বদলি বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ নানা নামে দুর্নীতির দাপুটে অবস্থান। দুর্নীতিবাজরা সমাজে বুক ফুলিয়ে চলে। কারণ রাজনীতির গুরুরা তাদের আশ্রয়স্থল। ঘুষ বা কমিশনবাজদের আয়ের ওপর আবার ক্ষমতাবান রাজনৈতিক ব্যক্তি বা দলের কমিশন আছে। এভাবে রাজনীতি এখন লাভজনক চাকরিতে পরিণত হয়েছে। এ কারণে দুর্নীতির গোড়াঘর এখন ক্ষমতাধর রাজনীতি। আমার এক বন্ধু তার অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন। বললেন, তার মতো নিরানব্বইজন ভুক্তভোগীরই একই অভিজ্ঞতা। পৈতৃক সূত্রে ঢাকায় একখণ্ড জমি ছিল তার। নিজের সামর্থ্য নেই, তাই ডেভেলপারের হাতে তুলে দিয়েছেন জমিটি। ডেভেলপার কোম্পানির এমডি বললেন, আপনি কাছে থেকে লক্ষ্য করুন হাড়গিলারা কীভাবে হাঁ করে থাকে। প্ল্যান পাস করাতে রাজউকের মুখে ঢালতে হল কয়েক লাখ টাকা। এরপর গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, সিটি কর্পোরেশনের ট্যাক্স, ফ্ল্যাট মালিকদের নামজারি, খারিজ ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে যেভাবে ঘুষ দিতে হল তা দেখে বন্ধুটি বললেন, স্বাধীন দেশে নাগরিকদের জিম্মিদশা চলছে। ঘুষ যেন ঘুষখোরদের অধিকার! প্রতিবাদ করার কোনো সুযোগ নেই। না হলে কাজ বন্ধ হয়ে থাকবে। আর এসব দুর্নীতিবাজের এমন প্রকাশ্য দাপট কেন? কারণ ঘুষখোরদের ওপর চাঁদা আরোপিত আছে ক্ষমতার রাজনীতির আর দলের। তাই রাজনৈতিক দুর্নীতির ছাতার নিচেই এদের অবস্থান। বিষয়গুলো আরও প্রামাণ্য করতে চারপাশের উদাহরণে মহাভারত রচিত হয়ে যাবে। সাম্প্রতিক একটি উদাহরণ দিয়ে শেষ করতে চাই। ‘দুর্ভাগ্যক্রমে’ বনানীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণ ঘটনায় ধরা পড়েছেন আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলেসহ আরও কয়েকজন। মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার না পেলে এসব পর্দার আড়ালে চলে যেত কিনা কে জানে। এ সূত্রে এতদিনে পুলিশ, র‌্যাব আর শুল্ক গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন- এত যে স্বর্ণ চোরাচালানি হয়, সেসবের গডফাদার কারা। ‘দুর্ভাগা’ আপন জুয়েলার্সের মালিক সময়ের ফেরে বাটে পড়ে গেছেন। মণে মণে স্বর্ণ আর হীরার মজুদ পেয়েছেন গোয়েন্দারা, যা বৈধ কাগজপত্রের অভাবে চোরাচালানির স্বর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। যুগ যুগ ধরে এরা অবৈধ এসব স্বর্ণের ব্যবসা করে যাচ্ছে অথচ তা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা জানত না, দেশবাসীকে তা মানানো কঠিন হবে। দেশের অধিকাংশ বড় স্বর্ণ ব্যবসায়ীর পথ যে একই, তা তো তারাই স্বীকার করেছেন। স্বর্ণ ব্যবসায়ী সমিতির প্রতিক্রিয়া দেখলাম টিভিতে। টাকা ছড়িয়ে তারা যে অবৈধ ব্যবসা করাকে অধিকারের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন তা বোঝা যায়। সমিতির নেতা প্রকাশ্যে দাবি করলেন আপন জুয়েলার্সের স্বর্ণ (অবৈধ) ফিরিয়ে দিতে। সেই সঙ্গে যা জানালেন তার মর্মার্থ হচ্ছে, তাদের কাছে এলেও তারা কাগজপত্র দেখাতে পারবেন না। এভাবেই তারা ব্যবসা করে আসছেন। যেভাবে বুক ফুলিয়ে বলছিলেন, তাতে চোরাচালানটাকে এক ধরনের বৈধতার পর্যায়ে নিয়ে গেছেন তারা। বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে মানতেই হবে কোনো না কোনোভাবে সরকারের নানা সংস্থার প্রশ্রয় তারা পেয়ে আসছেন। অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, এরা আবার ধর্মঘটও ডেকেছিলেন। আবার সরকারি আশ্বাসে ধর্মঘট উঠিয়েও নিয়েছেন। সরকার বলেছে, দাবিমতো স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের জন্য একটি নীতিমালা করে দেবে। তার আগ পর্যন্ত হয়রানি বন্ধ রাখা হবে। এই ‘হয়রানি’ শব্দটি আমাদের কাছে দুর্বোধ্য রয়ে গেল। বুঝলাম না নীতিমালা করে কি অবৈধ স্বর্ণ সব বৈধ করে দেয়া হবে? রাষ্ট্র কি আমাদের বলবে, এমন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আমাদের রাজনৈতিক সরকারগুলোর দায়িত্ববানদের কোনো সুবচন সাধারণ মানুষের অন্তরে প্রবেশ করবে? অসাধারণরা কী ভাবেন জানি না, আমরা সাধারণরা তবু স্রোতের শ্যাওলা ধরতে চাই। চাতক পাখির দৃষ্টি নিয়ে অপেক্ষা করছি একদিন নিশ্চয় সুনীতি ধরা দেবে।
এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnaway7b@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.