রণাঙ্গনের লড়াকু নারী আনোয়ারা

স্বাধীনতা যুদ্ধে নিজের মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ে গেছেন অনেক নারী। জীবনকে তুচ্ছ মনে করে যে ক’জন নারী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন তাদের মধ্যে অধ্যাপক ড. এসএম আনোয়ারা বেগম আনু অন্যতম। তার আরেক বোন মনোয়ারা বেগম মনু ও ভাই সরদার রশিদও ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। ’৬০-এর দশকের শেষভাগে রাজপথের লড়াকু এসএম আনোয়ারা ছাত্রলীগ পটুয়াখালী জেলার কর্মী, সংগঠক ও নেত্রী ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স ও জাহারঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রিধারী এ নারী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান, শিক্ষক সমিতির সহ- সভাপতি, নীল দলের আহ্বায়ক ও ছাত্রকল্যাণ পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য। ১৯৫৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পটুয়াখালীর কালিকাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আনোয়ারা ও মনোয়ারা। মা-বাবা, পাঁচ বোন ও এক ভাই নিয়ে ছিল তাদের পরিবার। পারিবারিকভাবেই রাজনৈতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠেন তারা। বড় ভাই সরদার আবদুর রশিদ পটুয়াখালী জেলা ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বড় ভাইকে অনুসরণ করে রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন দুই বোন। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন ছিল রাজনীতিতে তার হাতেখড়ি। সাহসিকতার জন্য এলাকার সবার মুখে তখন আনু ও মনু নাম শোনা যেত। আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নেয়ার কারণে আনোয়ারাকে স্কুল থেকে বের করে দেয়ার হুমকিও আসে। কিন্তু থেমে থাকেনি তার পথ চলা। গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলনে আনোয়ারাসহ তার পরিবারের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। মিছিলে মিছিলে যখন রাজপথ প্রকম্পিত, তখন মিছিলের সামনের সারিতে থাকতেন আনোয়ারা ও তার ভাই-বোন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আটক হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর পরিবারের জন্য এলাকায় মানুষের কাছে গিয়ে সাহায্য চান এবং সাধ্য অনুযায়ী বড় ভাইয়ের মাধ্যমে আর্থিক সহযোগিতাও পাঠান। ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু মুক্তি পাওয়ার পর নির্বাচনের আগে দক্ষিণাঞ্চলের অবস্থা দেখতে যান। সেখানে সরদার রশিদ এবং তার দুই বোনের আন্দোলন-সংগ্রামের কথা শুনে বঙ্গবন্ধু তাদের বাসায় যান এবং দুই বোনের মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে দেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পটুয়াখালী সরকারি কলেজের ছাত্রী আনোয়ারা এবং মনোয়ারা এলাকার তরুণদের সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন।
১১ এপ্রিল আক্রান্ত হয় পটুয়াখালী। মেজর নাদের পারভেজ নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে। মা-বোনদের সম্ভ্রমহানি এবং ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। তখন আনোয়ারা তার মাকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। ৪-৫ দিন পর এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নেন তারা। মাকে ওই বাড়িতে রেখে রাতেই আনোয়ার তার ভাই-বোনকে নিয়ে অন্যত্র চলে যান। একই রাতে হানাদার বাহিনী তাদের মাকে ধরে নিয়ে প্রথমে গলাচিপা থানা এবং পরে পটুয়াখালী সদর থানায় চালান করে। তখন এলাকায় ঘোষণা করা হয় আনু ও মনুকে জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দিতে পারলে ৫০ হাজার টাকা ও ৩০ ভরি স্বর্ণ পুরস্কার দেয়া হবে। তখন তাদের আশ্রয় দিতে অনেকেই আপত্তি জানান। তবে নিশানবাড়িয়ার সফিউদ্দিন বিশ্বাস নামে এক পীর তার মুরিদদের বলেন, তাদের আশ্রয় দিতে। কিন্তু নিরাপত্তাজনিত কারণে মুরিদরা তিন ভাইবোনকে আগুনমুখা নদীর ধারে একটি গভীর জঙ্গলে রেখে আসেন। সেখানে তারা ৩ দিন না খেয়ে অবস্থান করেন। ইতিমধ্যে ৯ নম্বর সেক্টরের অধীন সাব সেক্টরের প্রধান মেজর জিয়া উদ্দিনের কাছে তাদের খবর পৌঁছায়। পরে রাত ২টার দিকে একদল সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা তিনটি নৌকায় তাদের উদ্ধার করে। ৯ নম্বর সেক্টরের অধীনে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেন আনোয়ারা এবং মনোয়ারা। দুই বোন সুন্দরবনে সেন্ট্রি ও অপারেশনে রেকির কাজ করেন। সুন্দরবন, শরণখোলা, রায়েন্দ, নামাজপুর, তুশখালী, কাকছিঁড়া, ডোবাতলা, পটুয়াখালীসহ বিভিন্ন জায়গায় মেজর জিয়া উদ্দিনের নেতৃত্বে সরাসরি যুদ্ধ করেন তারা। শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য আনোয়ারাকে ২০১৫ সালে শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের স্বর্ণপদক দেয় ‘ড. এমএ ওয়াজেদ মিঞা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন।’ মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি পান একাধিক সম্মাননা পদক।

No comments

Powered by Blogger.