বই-বসন্তে ভালোবাসা

কৃষ্ণকলির সঙ্গে দেখা হলো আচমকা! গায়ের বরন কালো, চোখ দুটো টানা টানা; ‘কৃষ্ণকলি আমি তারে বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক’—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই যে লিখেছিলেন গানে, সেই কৃষ্ণকলির সঙ্গে আমাদের দেখা হয়ে গেল গতকাল, বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। আদতে তাঁর নাম কৃষ্ণকলি নয়, মাকসুদা আক্তার। তবে এই মাকসুদার সঙ্গে রবিঠাকুরের কৃষ্ণকলির চেহারা যেন মিলে যায়। কিন্তু মাথায় বর্ণিল ফুলের টায়রা পরা এই মেয়ের হাতে তো দেখা যাচ্ছে হুলমায়ূন আহমেদের বই নবনী। বইটির দিকে তাকাতেই সলজ্জ হাসি দিয়ে বললেন, ‘ও কিনে দিয়েছে।’ এবার আমরা ‘ও’র দিকে তাকাই। আরিফুল ইসলাম, মাকসুদার হবু স্বামী। আর কদিন বাদে মাকসুদা-আরিফুলের বিয়ে।
ভালোবাসা দিবসের আনন্দক্ষণে তাঁরা এসেছিলেন বইমেলায়, দুজন দুজনকে বই উপহার দেবেন বলে। একে বসন্তের ছোঁয়া—ফাল্গুনের উতাল বাতাস, তার ওপর ভালোবাসা দিবস। বইমেলার ১৪তম দিনে তাই দেখা মিলল অসংখ্য ‘জুটি’র। এসব জুটির অনেকেই গতকাল একে অন্যের প্রতি ভালোবাসা জানিয়েছেন পরস্পরকে বই উপহার দেওয়ার মাধ্যমে। আহা, বই-বসন্তে ভালোবাসার আবাহন কতই না মনোহর! ‘ভালোবাসার এই দিনে প্রিয় মানুষকে বই দিলাম, সম্পর্কের ভিত্তি শক্ত হবে।’ অন্যপ্রকাশের স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে ডাক্তারি পড়ুয়া আরিফুল যখন কথাটি বলছিলেন, মাকসুদার মুখ তখন আবারও লাল। বেশ কয়েক বছর বইমেলা হুেমায়ূন আহমেদহীন, কিন্তু কোথায় নেই তিনি! ইডেন কলেজে পড়েন ত্রপা চক্রবর্তী, তাঁর হাতে হিমুসমগ্র। আবার যশোরের অভয়নগর থেকে এক দিনের ছুটিতে এসেছিলেন যে এস এম জাকারিয়া, তিনিও সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন এক গাঁটরি হুেমায়ূন। অন্যপ্রকাশের অন্যতম পরিচালক সিরাজুল কবির চৌধুরী বললেন, ‘হ্‌ুমায়ূন আহমেদের বই এখনো সবার প্রথম পছন্দ। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়ে, যাঁরা হ্‌ুমায়ূনের প্রথম দিককার বই পড়েননি, তাঁরাই বইগুলো বেশি কেনেন। হু‌মায়ূন এখনো সচল।’ প্রকৃতির বসন্তের সঙ্গে সংগতি রেখে বইমেলায়ও বইছে বাসন্তী হাওয়া। এখন অব্দি বিক্রি মন্দ নয়। প্রকাশকেরা কথাটি বলছেন বেশ সন্তুষ্টির সঙ্গে। তাঁদের ভাষ্য, বিক্রির দিক দিয়ে এগিয়ে আছে উপন্যাস ও সায়েন্স ফিকশন। মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ইমদাদুল হক মিলন ও আনিসুল হক তরুণ ক্রেতাদের পছন্দ। বলছিলেন অবসর প্রকাশনীর ব্যবস্থাপক মাসুদ রানা।
অনন্যার স্বত্বাধিকারী মনিরুল হকের কথা, মিলনের নয়মাস উপন্যাসটি বেশ যাচ্ছে। আর প্রথমা প্রকাশন থেকে বের হওয়া আনিসুল হকের উপন্যাস প্রিয় এই পৃথিবী ছেড়ে পাঠকের পছন্দের তালিকার শীর্ষে রয়েছে—এমনটিই জানালেন প্রথমার বিক্রয় ব্যবস্থাপক মুহম্মদ ইউসুফ। এই লেখকদের বাইরে আন্দালিব রাশদী, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, মোিহত কামাল, মোস্তফা কামালের বইয়েরও রয়েছে নির্দিষ্ট পাঠকগোষ্ঠী। যেমন পরীবাগ থেকে এসেছিলেন আনোয়ার চৌধুরী। তিনি খুঁজছিলেন প্রথমা থেকে প্রকাশিত আন্দালিব রাশদীর উপন্যাস মোনালি। আবার অন্যপ্রকাশের স্টলের সামনে দেখা গেল সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের একাত্তর ও অন্যান্য গল্প এবং মোহিত কামালের বিষাদনদী উপন্যাসটির খোঁজ করছেন বেশ কয়েকজন পাঠক। মেলায় ঢোকার মুখেই সৈয়দ শামসুল হক চত্বর। বিকেলের ফুরিয়ে আসা আলোয় সেখানে সেলফি তোলায় ব্যস্ত ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ফয়সাল আদনান ও তাঁর বন্ধু প্রিয়তা। ছবি তোলা শেষে তাঁদের বলা হলো, বই কিনেছেন? ফয়সালের কাট কাট জবাব, ‘ফেসবুকে আমি বেশ কয়েকজন তরুণ লেখকের ফলোয়ার। আজ কিনি কাল কিনি, তাঁদের বই-ই কিনব। রাজীব হাসানের হরিপদ ও গেলিয়েন আর সাদাত হোসেনের মানবজনম উপন্যাস দুটি কিনব।’ গল্প-উপন্যাস ছাড়া আত্মজীবনী, গবেষণা, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বই ও ধ্রুপদি সাহিত্যের পাঠক বেড়েছে। কথাপ্রকাশের জাফরুল ইসলামের ভাষায়, ‘পাঠক নানা রকম। তরুণেরা যেমন গল্প-উপন্যাসে আগ্রহী, তেমনি একটু বয়োজ্যেষ্ঠ পাঠকেরা খোঁজেন আত্মজীবনী, প্রবন্ধ ও মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক বই।’ প্রায় একই কথা যেন শোনা গেল মনিরুল আলম খানের গলায়। তিনি থাকেন ইতালিতে। বইমেলা উপলক্ষে সপরিবার এসেছেন দেশে। বললেন, ‘আত্মজীবনী আমার খুব প্রিয়, প্রিয় মুক্তিযুদ্ধের বইগুলোও। আর যদি উপন্যাস কিনি, কিনতে চাই তারাশঙ্কর,
মানিক ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই।’ বিকেল মিলিয়ে যাচ্ছে, জমে উঠছে মেলা। এর মধ্যেই হয়তো আরও অনেক কৃষ্ণকলি প্রিয় মানুষটির কাছ থেকে পেয়ে গেছেন বই উপহার, সব খবর কি আমরা জানি? বই-বসন্তে, ভালোবাসার দিনে তো কত কিছুই ঘটে! মেলায় প্রথমা প্রকাশন এনেছে ফারুক চৌধুরীর অনাবিল মুখচ্ছবি। একই প্রতিষ্ঠান থেকে এসেছে শিশির ভট্টাচার্য্যের বাংলা ব্যাকরণের রূপরেখা। সময় প্রকাশন এনেছে আবদুল মান্নান সৈয়দের নির্বাচিত কবিতা। প্রকাশক ফরিদ আহমেদ বললেন, লেখক এই জীবনকালে কিছু কবিতা নির্বাচন করে গিয়েছিলেন, বাকিগুলো তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে নির্বাচন করা হয়েছে। চন্দ্রাবতী একাডেমি এনেছে আবুল মোমেনের চার বেহারার পালকি। এতে ছোটদের উপযোগী চারটি নাটক আছে। কথাপ্রকাশ এনেছে রাজীব সরকারের বহুমাত্রিক বুদ্ধদেব বসু: বৈচিত্র্যে বৈশিষ্ট্যে। অবসর এনেছে শান্তিরঞ্জন ভৌমিকের আমি নজরুল, রকিব হাসানের কিশোর মুসা রবিন: সাগরতলে। সাউন্ড বাংলা এনেছে মো. সাদেকুর রহমানের জীবন কাব্য, হাফিজুর রহমান শাকিলের মেঘের পরে আনন্দের রোদ। বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্র থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, বইমেলার ১৪তম দিনে নতুন বই এসেছে ১৪৬টি এবং ২৩টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। এদিন বিকেলে মেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের একুশের সংকলন’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি ও গানের পরিবেশনা। আজ মেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘সমর সেনের জন্মশতবার্ষিকী’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। সন্ধ্যায় রয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

No comments

Powered by Blogger.