ইসরায়েল শান্তি চায় না

ইসরায়েল যেন আন্তর্জাতিক আইনের ঊর্ধ্বে, বা ব্যাপারটা অন্তত সে রকম মনে হয়। ২০১৬ সালের ২৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব ২৩৩৪ পাস হয়েছে, যেখানে এই ব্যাপারটা আবারও নিশ্চিত করা হয়েছে যে ইসরায়েলের বসতি স্থাপন অবৈধ। এই ভোট দুটি কারণে তাৎপর্যপূর্ণ: জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের আগের প্রস্তাবগুলোর মতো ওবামা প্রশাসন এতে ভেটো দেয়নি। তারা বরং ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকে। দ্বিতীয়ত, এতে বোঝা গেল, ইসরায়েলের এই বসতি স্থাপন যে অবৈধ ব্যাপার, সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক ঐকমত্য আছে। এটা দেখিয়ে দিল বসতি স্থাপন শান্তির পথে অন্তরায়। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ২০১৬ সালের ২৮ ডিসেম্বরের এক বক্তৃতায় এই ব্যাপারটিতে আবারও জোর দিয়েছেন।
এরপর এ বছরের জানুয়ারিতে প্যারিসে যে শান্তি সম্মেলন হলো, সেখানেও তিনি একই কথা বলেছেন। উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে এটা ছিল সবচেয়ে বড় শান্তি সম্মেলনগুলোর একটি। সত্য হচ্ছে, ইসরায়েলের সবচেয়ে কট্টর সমর্থক যুক্তরাষ্ট্রও নিশ্চিত করেছে, এই বসতি স্থাপনের ব্যাপারটা অবৈধ। কিন্তু তারপরও বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার একই গীত গেয়ে যাচ্ছে। এর বিপরীতে দেখা গেল, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পাস হওয়ার পর ইসরায়েল তাড়াহুড়ো করে ফিলিস্তিনের ভূমিতে আরও বেশি করে অবৈধ বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। এক মাসের মধ্যে ইসরায়েলি সরকার ছয় হাজারের বেশি গৃহ নির্মাণে সবুজ সংকেত দেয়। সত্য হলো, পুরো ২০১৬ সালেও ইসরায়েলি সরকার এত বসতি স্থাপনের অনুমতি দেয়নি। এর সঙ্গে ইসরায়েলি সংসদে এক আইন পাস করা হলো, যার নাম ‘নিয়মিতকরণ আইন’, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি ভূমি দখল আইন। এর মাধ্যমে বসতি স্থাপনকারীরা ‘বৈধভাবে’ ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করতে পারবে। এর মাধ্যমে বসতি স্থাপন প্রক্রিয়া দ্রুততর হবে। এই আইন বিদ্যমান পর্যবেক্ষণ-ফাঁড়িগুলোকে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দিতে পারে, যেটা ইসরায়েলি আইনেই অবৈধ। তা ছাড়া, আন্তর্জাতিক আইনে বসতি স্থাপন ও পর্যবেক্ষণ-ফাঁড়ি উভয়ই অবৈধ। প্রকৃত অর্থে,
বৈধ বসতি স্থাপন বলতে কিছু নেই। অধিকৃত পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে ইসরায়েল সরকার ও বসতি স্থাপনকারীরা প্রায় আধা শতক ধরে বসতি স্থাপন ও পর্যবেক্ষণ-ফাঁড়ি নির্মাণ করে যাচ্ছে, এই আইন বিপজ্জনক সীমা অতিক্রম করে গেছে। ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, ইসরায়েলের অ্যাটর্নি জেনারেল আভিচাই ম্যানডেলব্লিট ঘোষণা দিয়েছেন, এই আইন চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের পরিপন্থী। তিনি এ-ও বলেছেন, আইনটি যদি ইসরায়েলি আদালতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে, তাহলে তিনি এর সপক্ষে দাঁড়াবেন না। ইসরায়েল ক্রমাগতভাবে বসতি স্থাপন করতে থাকায় স্বনির্ভর ও সংযুক্ত ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন ক্রমেই অসম্ভব হয়ে উঠছে, যার কারণে দুই-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে। কিন্তু বসতি স্থাপন এমন ইস্যু নয়, যা ভবিষ্যতে আলোচনার জন্য ঘড়ায় তুলে রাখা যায়। এখনই ফিলিস্তিনিদের জীবনে এর মারাত্মক প্রভাব অনুভূত হচ্ছে। বসতি স্থাপন ও সম্প্রসারণের কারণে ফিলিস্তিনিরা সি অঞ্চল থেকে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে, যা পশ্চিম তীরের ৬০ ভাগ, যেটা এখন পুরোপুরি ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে। বসতি স্থাপনকারীরা নিয়মিতই আশপাশের ফিলিস্তিনিদের হামলা করে। তাদের সম্পত্তি ভাঙচুর করে। তবে এর জন্য তাদের বিচার হয় না। বলা যায়,
তারা পুরোপুরি দায়মুক্তি পেয়ে গেছে। এর লক্ষ্য হচ্ছে, ইসরায়েলিরা সি অঞ্চল থেকে ফিলিস্তিনিদের সরে যেতে বাধ্য করছে, যাতে তারা জনবহুল শহরগুলোতে চলে যায়। এ ছাড়া নতুন বসতি স্থাপন ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ইসরায়েলি বুলডোজারগুলো নিয়মিতই সি অঞ্চলের বাইরে ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর ও অবকাঠামো ধ্বংস করছে। এতে কৃষক ও বেদুইনরাই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে। তারা ঐতিহ্যবাহী পেশা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। ফলে তারা জীবিকা হারিয়েছে। কথা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইসরায়েলের এই বসতি স্থাপনের উন্মত্ততা উপেক্ষা করতে পারে না। বিশ্বশক্তি, অধিকারভিত্তিক সংগঠন ও জাতিসংঘের কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিকভাবে ইসরায়েলের নতুন করে বসতি স্থাপনের ঘোষণা ও তথাকথিত ‘নিয়মিতকরণ আইন’-এর সমালোচনা করেছেন। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, এসব বিবৃতি অকার্যকর। এগুলো ইসরায়েলকে কখনোই নিবৃত্ত করতে পারেনি। তাই জাতিসংঘের এই ২৩৩৪ নম্বর প্রস্তাব সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। কারণ, এটি জাতিসংঘ সনদের ষষ্ঠ অধ্যায়ের আলোকে গ্রহণ করা হয়েছিল। এর মানে হচ্ছে, ইসরায়েল যদি এই বিধান লঙ্ঘন করে, তাহলে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে পারবে না। এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আগের চেয়ে আরও বেশি করে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমন, তারা ইসরায়েলের ওপর অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে। এটা শুধু নৈতিক ও আইনি বাধ্যবাধকতা নয়, সবার স্বার্থেই এটা করতে হবে। আন্তর্জাতিক আইন ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সিংহভাগই প্রণীত হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকার পরিপ্রেক্ষিতে। এর লক্ষ্য হচ্ছে, এরূপ বিয়োগান্ত ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা। যে দেশগুলো আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন (সেটা করে আবার পার পেয়ে যাচ্ছে) এবং মৌলিক মানবাধিকার অকার্যকর করে দিচ্ছে, তারা প্রকৃত পক্ষে মানবতাকে অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, যখন উপনিবেশ ও জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণ একপ্রকার রীতিতে পরিণত হয়েছিল। ইসরায়েলের বসতি স্থাপন প্রক্রিয়ার কারণে ফিলিস্তিনিরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে আমরা সবাই এতে আক্রান্ত হব।
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত।
রামি হামদাল্লাহ্: ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী।

No comments

Powered by Blogger.